জার্মানিতে সরকার গঠনে সংকট

গত ২৪ সেপ্টেম্বর জার্মানির ১৯তম পার্লামেন্ট নির্বাচনে মোট ৪২টি দল অংশ নিলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল ক্ষমতাসীন কোয়ালিশন দলের দুই প্রধান শরিক ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন দল ও সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে। চার বছর ধরে একই সঙ্গে দেশ শাসন করলেও নির্বাচনের সময় তারা পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল। তবে এর বাইরে ছিল বিগত পার্লামেন্টের বিরোধী দল, বাম দল, পরিবেশবাদী সবুজ দল, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও কট্টর ডানপন্থী অলটারনেটিভ ফর জার্মানি নামের দলটি।

জোট সরকার গঠনের লক্ষ্যে ক্ষমতাসীন দুই জোট ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টি ও ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়ন পার্টি এবং আট বছর পর পুনরায় পার্লামেন্টে ফিরে আসা দল ফ্রি ডেমোক্রেটিক পার্টি ও পরিবেশবাদী সবুজ দল অংশ নিয়েছিল। কী কারণে সরকার গঠনের এই আলোচনা ভেস্তে গেল, তা কোনো দলই তাদের দায়বদ্ধতা থাকার কারণে পরিষ্কার করে বলছে না। তবে এই আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার কারণ ফ্রি ডেমোক্রেটিক পার্টি বা লিবারেল গণতান্ত্রিক দলটি। এই দলের সভাপতি ক্রিশ্চিয়ান লিন্ডেনার হঠাৎ করেই আলোচনা ছেড়ে বেরিয়ে এসে বলেছেন, ‘ভুল পন্থায় দেশ শাসনের চেয়ে দেশ শাসনের অংশীদারত্ব না নেওয়াই ভালো।’

ক্ষমতায় গিয়ে দলটি ধনিক সমর্থক গোষ্ঠীর স্বার্থ কায়েম করতে পারবে না বিধায় আলোচনা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে বলে মনে করা
হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে জার্মানিতে পুঁজিবাদের সমর্থক ও রক্ষণশীল দল চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন ক্ষমতায় থাকলেও জার্মানিতে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক রাজনীতি অন্যান্য ইউরোপীয় পুঁজিবাদী দেশগুলোর তুলনায় অনেক উদার।

জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় থাকা চারটি দলের মধ্যে পরিবেশবাদী সবুজ দল ছাড়া অন্য তিনটি দলই পুঁজিবাদ ও ধনিকশ্রেণি-গোষ্ঠীর সমার্থক। তদুপরি রক্ষণশীল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের সভানেত্রী এবং বর্তমান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলকে অনেক আধুনিক ও মানবিক বলে মনে করা হয়।

১২ বছর ধরে ক্ষমতাসীন চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল নিজের দেশে দল ও জনগণের কাছে বেশ জনপ্রিয় এবং ইউরোপীয় ঐক্যসহ ইউরো মুদ্রার প্রসার ও বাজার ধরে রাখতে অগ্রগণ্য নেত্রী হিসেবে পরিচিত। ইউরোপের বিভিন্ন বড় দেশ যখন রাষ্ট্রীয় বাজেট নিয়ন্ত্রণ ও পূর্বতন প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন জার্মানিতে পুঁজির বিস্তার, রপ্তানি খাতে রেকর্ড পরিমাণ আয়, ক্রয়ক্ষমতাসহ প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে। এককথায়, জার্মানির অর্থনীতি এগোচ্ছে। তবু এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করছে, জার্মানির অর্থনৈতিক সাফল্যের সমবণ্টন ঘটছে না। পারমাণবিক জ্বালানি বন্ধের সিদ্ধান্তসহ তার পরিবেশবান্ধব রাজনীতিও সুবিদিত।

জার্মানিতে জোট সরকার গঠনের আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর জার্মানির প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক-ভালটার স্টাইনমায়ার বলেছেন, ৭০ বছর আগে সরকার গঠনে এ ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল আর সেই ইতিহাস আমাদের ভুলে গেলে বা কবর রচনা করলে চলবে না। দেশ ও জনগণের যে দায়বদ্ধতার কথা বলে আপনারা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছেন, সেই দায়বদ্ধতা থেকেই জোট সরকার গঠনের
জন্য নতুন করে প্রচেষ্টা চালানো প্রয়োজন বলে তিনি জানিয়েছেন। তিনি ইতিমধ্যে বিভিন্ন দলের সঙ্গে জোট সরকার গঠনের ক্ষেত্রে পুনরায় একটি সম্ভাবনা খুঁজে বের করতে আলোচনা শুরু করেছেন।

এখানে উল্লেখ্য, জার্মানির ঐতিহাসিক ভাইমার প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট ফ্রিডরিশ এবার্টের ১৯২৫ সালে মৃত্যুর পর প্রগতিশীল সামাজিক গণতন্ত্রী ও বামদের অনৈক্যের পথ ও সরকার গঠনে ব্যর্থ হওয়ার পথ বেয়ে রক্ষণশীল ও নাৎসিদের প্রার্থী সাবেক ফিল্ড মার্শাল হিন্ডেনবুর্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আর ১৯৩৩ সালে ফিল্ড মার্শাল হিন্ডেনবুর্গের হাত ধরেই স্বৈরাচার অ্যাডলফ হিটলার ক্ষমতায় এসেছিলেন। আর সেই কথা স্মরণ করেছেন জার্মানির বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক-ভালটার স্টাইনমায়ার। জার্মানির সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট পদ কোনো ক্ষমতাধর পদ না হলেও সবচেয়ে সম্মানীয় পদ এবং এ ধরনের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকটে তিনিই পরামর্শদাতা ও প্রস্তাবক।

জার্মানির দ্বিতীয় বৃহত্তম দল ও বর্তমান ক্ষমতাসীন জোটের শরিক সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা মার্টিন শুলজ ২৪ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনের পরপরই পুনরায় জোটবদ্ধ হয়ে ক্ষমতায় যাবেন না বলে জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া এবারের নির্বাচনে দ্বিতীয় বৃহত্তর দল সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি জোট সরকারে যোগ দিলে নির্বাচনে বিজয়ী তৃতীয় বৃহত্তম দল কট্টরবাদী ডানপন্থী অলটারনেটিভ ফর জার্মানি নামের দলটি জার্মান পার্লামেন্টে বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত হোক, সেটিও সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি চাইছে না। তবে এই সংকটময় পরিস্থিতিতে পুনরায় জোটে যোগ দেওয়ার জন্য দলটির প্রতি চাপ বাড়ছে।

জার্মানির সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী ২৪ সেপ্টেম্বর নির্বাচন-পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে নতুন পার্লামেন্ট অধিবেশন এবং স্পিকার নির্বাচনও ২৪ অক্টোবর সম্পন্ন হয়েছে। আপাতত রাজনৈতিক সংকটে চার দলের জোট সরকার গঠনের আলোচনা ভেস্তে গেলেও ফ্রি ডেমোক্রেটিক পার্টিকে বাদ দিয়ে অন্য তিনটি দল মিলিতভাবে সংখ্যালঘু সরকার গঠন করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ক্ষমতায় না থেকেও জোট সরকারকে সমর্থন জানাতে হবে। শেষ পর্যন্ত তা-ও না ঘটলে প্রেসিডেন্ট সংসদ ভেঙে দিয়ে ৬০ দিনের মধ্যে পুনরায় নির্বাচন করবেন আর নতুন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান চ্যান্সেলর ম্যার্কেল ক্ষমতায় থাকবেন।

জার্মানিতে সরকার গঠনের সংকটে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ব্রেক্সিট, নানা দেশে ডানপন্থীদের উত্থান, শরণার্থী প্রভৃতি অমীমাংসিত বিষয়ের মীমাংসা আরও পিছিয়ে পড়বে। জার্মানিতে যত দ্রুত সরকার গঠন সম্ভব হবে, তা জার্মানির জনগণ তথা ইউরোপের জন্য মঙ্গল।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর হ্যানোভার (জার্মানি) প্রতিনিধি৷