কাগমারীর অর্জন ও মওলানা ভাসানী

বাংলাদেশে রাজনীতি ও সংস্কৃতির স্রোতোধারা এক মোহনায় মেশার উদাহরণ খুব বেশি নেই। রাজনীতির কুশীলবেরা বরাবর ক্ষমতাকে মোক্ষ ভাবেন এবং তার হাতিয়ার হলো রাজনীতি। এর ব্যতিক্রম ছিল বাহান্ন, উনসত্তর ও একাত্তর, যেখানে জনগণ ছিলেন ‘নায়ক’। আন্দোলন-সংগ্রামের উত্তাল সেই সময়ে রাজনীতি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটেছিল। স্বাধীনতার পর আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও দেখেছি কীভাবে সমাজমানস আন্দোলিত হয়েছে। ছাত্র-তরুণদের পর লেখক-বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিসেবীরাই প্রথম রাজপথে নেমে এসেছিলেন। সেই সময়ের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আর এখনকার জোটে কত ফারাক।

বাংলাদেশ এক ক্রান্তিলগ্ন অতিক্রম করছে। রাজনীতিকেরা ক্ষমতার চশমায় নিজেরা যেমন সবকিছু দেখতে অভ্যস্ত, তেমনি অন্যদেরও দেখতে বাধ্য করেন। তঁারা ভুলে যান যে সমাজমানস তৈরিতে সংস্কৃতির ভূমিকাই মুখ্য। যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর দেশ। কিন্তু সংস্কৃতির বিচারে দেশটি যে খুব উন্নত নয়, তার প্রমাণ ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটির প্রেসিডেন্ট।

বাংলাদেশে বর্তমানে যে ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের অশনিসংকেত শোনা যাচ্ছে, তারও পেছনে রয়েছে আমাদের সংস্কৃতির দীনতা। আমরা যুক্তি দিয়ে অন্যের যুক্তিকে খণ্ডন করতে চাই না; হাতুড়ি দিয়ে মাথা গুঁড়িয়ে দিতে চাই। রাজনীতি মানুষকে যুক্তি ও জ্ঞানের পথে নিতে পারছে না বলেই সামাজিক অনাচার ও অন্ধত্ব বাড়ছে। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ধর্মবাদী পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে আমরা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। বাহাত্তরের সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি প্রতিস্থাপন করেছি। কিন্তু এগুলো বিনির্মাণ করতে যে যুক্তিবাদী সমাজ ও সংস্কৃতির প্রয়োজন, রাজনীতি সেটি তৈরি করতে যারপরনাই ব্যর্থ হয়েছে।

একটি রাজনৈতিক দলের সম্মেলনে দলীয় বা রাজনৈতিক সংস্কৃতির সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে থাকে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় সম্মেলনে এই সংস্কৃতিকে অপরিহার্য অংশ হিসেবে যুক্ত করে না; খুব বেশি হলে অনুষঙ্গ হিসেবে অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে থাকে। ডান–বাম–মধ্য—কোনো দলই যখন এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি, তখন ভাবতে অবাক লাগে, এই বাংলাদেশেই ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে টাঙ্গাইলের অজপাড়াগঁা কাগমারীতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী লীগের সম্মেলন সামনে রেখে একটি আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন।

কাগমারী সম্মেলনের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদের কাগমারী সম্মেলন: মওলানা ভাসানীর পূর্ব বাংলার স্বাধিকার ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম বইটি আমাদের ইতিহাসের পাতায় চোখ ফেরানোর সুযোগ করে দিয়েছে। আমরা অনেকেই ইতিহাস ভুলে যাই এবং বর্তমানকে নিয়ে মশগুল থাকতে পছন্দ করি। কিন্তু ইতিহাসে যার যেটুকু ভূমিকা, স্বীকার না করলে একদিন ইতিহাসই মুখ ফিরিয়ে নেবে। নেবে বললেও পুরোটা বলা হয় না। ইতিমধ্যে নিতে শুরু করেছে। ১৯৭১ ও ২০১৭–এর ফারাকটি বড় বেশি বেদনাদায়ক।

ভূমিকায় সৈয়দ আবুল মকসুদ জানাচ্ছেন, ‘কাগমারী সম্মেলনকে সাংস্কৃতিক সম্মেলন বলে অভিহিত করা হলেও এর রাজনৈতিক তাৎপর্য বিশাল এবং জাতির জীবনে সেই সম্মেলনের অভিঘাত হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। কাগমারী সম্মেলন থেকেই মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের মানুষকে প্রত্যক্ষভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেন। এই সম্মেলনেই মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের আসসালামু আলাইকুম জানিয়েছিলেন।’ একটি নিরীহ ধর্মীয় সম্বোধন কীভাবে রাজনৈতিক প্রত্যয়ে রূপ নেয়, সে কথাও সৈয়দ মকসুদ লিখেছেন। তার ভাষায় ‘আসসালামু আলাইকুম শব্দটি স্বাধীনতার সমার্থক শব্দ হয়ে দঁাড়িয়েছিল।’

আসলে কাগমারী সম্মেলনটি নামে সাংস্কৃতিক সম্মেলন হলেও সেখানে অর্থনীতি, ভূমিব্যবস্থা, কৃষি, রাসায়নিক শিক্ষা, ভাষা, শিক্ষা, সাহিত্য, নারীসহ সবকিছু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আর এসব বিষয়ে আলোচনা করেছেন নিজ নিজে ক্ষেত্রে পণ্ডিত-বুজুর্গ ব্যক্তিরা। তঁাদের কেউ নিবন্ধ পাঠ করেছেন, কেউ সেই নিবন্ধের ওপর আলোচনা করেছেন। এই সম্মেলনে দেশি পণ্ডিতেরা তো ছিলেনই, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকেও অতিথিরা এসেছিলেন। এসেছিলেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকেও। কেউ কেউ না আসতে পেরে নিবন্ধ পাঠিয়ে দিয়েছেন বা চিঠি লিখে দুঃখপ্রকাশ করেছেন।

এই সম্মেলনে প্রতিবেশী ভারত থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হুমায়ুন কবিরসহ ডজন দুই লেখক-শিল্পী এসেছিলেন, যঁাদের মধ্যে ছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী আবদুল ওয়াদুদ, নরেন্দ্র সেন, রাধারানী দেবী, প্রবোধকুমার সান্যাল, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী। বাংলাদেশের লোকশিল্পীদের মধ্যে রমেশ শীল, তাসের আলী, মোহসেন, রাম সিং, মজিব মিয়া, সুখেন্দু চক্রবর্তীও এই সম্মেলনে যোগ দেন। কেন্দ্রে ও প্রদেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল বলেই এটি সম্ভব হয়েছে।

আবার প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এ নিয়ে বিস্তর সমালোচনাও করেছে। তখনকার আজাদডন-এর রিপোর্ট দেখলেই বোঝা যায়, তারা এর মধ্যে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বের করতে সচেষ্ট ছিল। কাগমারী সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ইত্তেফাকইত্তেহাদ-এর ভূমিকা পুরোপুরি বিপরীতধর্মী না হলেও প্রথমটি সোহরাওয়ার্দী গ্রুপকে এবং দ্বিতীয়টি ভাসানীকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কাগমারী সম্মেলনের আগে থেকেই আওয়ামী লীগের বিভাজন-প্রক্রিয়া শুরু হয়। কয়েক মাসের মাথায় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে নতুন দল গঠিত হয়।

তবে সৈয়দ আবুল মকসুদও স্বীকার করেছেন, ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর স্নেহভাজন শেখ মুজিবুর রহমান দল ভাঙার বিপক্ষে ছিলেন, যিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি মওলানা ভাসানীকে পীড়াপীড়ি করেছেন দলে  থাকার জন্য। মওলানা ভাসানীর পদত্যাগের খবরটি পত্রিকায় প্রকাশ করে দেওয়ায় অলি আহাদকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। সৈয়দ মকসুদ সুভাষ চন্দ্র বসুর উদাহরণ টেনে বলেছেন, ‘কংগ্রেস ছেড়ে দেওয়ায় তিনি স্বাধীন ভারতের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ হারান। মওলানা ভাসানীর ক্ষেত্রেও অনেকটা সে রকম ঘটেছে।’

দুঃখের বিষয়, বামপন্থীরা বরাবর অভ্যন্তরীণ বিষয়ের চেয়ে বৈদেশিক বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাম্রাজ্যবাদঘেঁষা নীতির প্রতিবাদে তঁারা নতুন দল করেছেন। আবার ষাটের দশকে মস্কো-পিকিং প্রশ্নে ফের ভাগ হয়েছেন। ষাটের দশকে সেই বিভক্তির আগ পর্যন্ত বামপন্থী তরুণ ও ছাত্রকর্মীরাই দেশের রাজনীতিতে নেতৃত্বের আসনে ছিলেন। কেবল আওয়ামী লীগ ত্যাগ নয়, বারবার বিভাজনের কারণে  বামপন্থীরা ‘দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ হারিয়েছেন।’

সৈয়দ আবুল মকসুদের বইয়ে কাগমারী সম্মেলনের বিস্তারিত বিবরণ আছে, সেই সম্মেলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার, দিনলিপি, নোট ইত্যাদি ব্যবহার করে তিনি সম্মেলনের বস্তুনিষ্ঠ চিত্র তুলে ধরেছেন। উপসংহারে তঁার মন্তব্য, ‘কাগমারী সম্মেলনের ভেতর দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটে এবং সাম্প্রদায়িক মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা দুর্বল ও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।’ ষাট বছর পর কি জোর দিয়ে সে কথা বলা যায়?

বাংলাদেশের বুর্জোয়া কিংবা বাম উভয় রাজনীতিতে সেই সম্মেলনই ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম, যাতে রাজনৈতিক দলের সম্মেলনকে ছাপিয়ে সামনে এসেছিল লেখক-বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা ও দর্শন। মওলানা ভাসানী ছয় মাস বয়সী সোহরাওয়ার্দী সরকারকে কতটা জোরালো ভাষায় সতর্ক করে দিয়েছেন, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো এই সম্মেলনের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের রাষ্ট্রভাবনার প্রতিফলন। তবে এও ঠিক, তখনো পর্যন্ত কোনো বাঙালি রাজনীতিক পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামো ভাঙার চিন্তা করেননি। তঁারা সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের অধিকারকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। সৈয়দ মকসুদ লিখেছেন, মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালেই প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা ছাড়া সবকিছু প্রাদেশিক সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন।  ভাসানী একা নন, আরও অনেক রাজনীতিকই এ রকম দাবি করেছেন। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ কিংবা পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে দেওয়া ‘বাঙালি’ নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে সেটি স্পষ্ট, যদিও পরবর্তী সময়ে অনেকে ডিগবাজি দিয়েছেন।

বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে যেমন গোষ্ঠী দঁাড়িয়ে যায়, এখানেও ব্যতিক্রম হয়নি। রক্ষণশীলেরা মওলানার সমালোচনা করেছেন, বামপন্থীরা সোহরাওয়ার্দীর বিরোধিতা করেছেন; কিন্তু পরবর্তীকালে তঁাদের অনেককে বিপরীত ভূমিকায়  দেখা গেছে। অলি আহাদ বামপন্থী থাকেননি। মাহমুদ আলী-শাহ আজিজেরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন।

সৈয়দ মকসুদ কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর অসামান্য ভূমিকার কথা তুলে ধরার পাশাপাশি কিছু কিছু বিষয়ে তঁার সমালোচনাও করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘তঁার সব সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। অনেক সময় অপাত্রে দান করেছেন। তঁার আশপাশের লোকজন সুবিধার ছিলেন না।’

গণমানুষের নেতা ছিলেন বলেই ভাসানী বহু চিন্তাকে ধারণ করে এমন একটি বিশাল সম্মেলন আয়োজন করতে পেরেছিলেন। তঁাকে অনেকে ‘বিদ্রোহের বা ভাঙনের নেতা’ হিসেবে অভিহিত করেন। কিন্তু সেই বিদ্রোহের নেতা যে গঠনমূলক কাজও করতে পারেন, কাগমারী সম্মেলন তার প্রমাণ। কাগমারী সম্মেলন নিঃসন্দেহ এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাইলফলক ঘটনা।

সৈয়দ আবুল মকসুদ মওলানা ভাসানীকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা ও লেখালেখি করে আসছেন। তঁার পূর্ণাঙ্গ জীবনী লিখেছেন, রাজনৈতিক দর্শন বিশ্লেষণ করেছেন। কাগমারী সম্মেলন নিঃসন্দেহে গবেষনার মুকুটে নতুন পালক যুক্ত করেছে। লেখককে অভিনন্দন।

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।

কাগমারী সম্মেলন: মওলানা ভাসানীর পূর্ব বাংলার স্বাধিকার ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম

সৈয়দ আবুল মকসুদ

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

প্রকাশকাল: অক্টোবর ২০১৭, ১৬৬ পৃষ্ঠা

দাম: ৩৫০ টাকা।