রোহিঙ্গা শিশু সুরক্ষায় করণীয়

২৯ অক্টোবর ২০১৭, প্রথম আলোর আয়োজনে ‘রোহিঙ্গা শিশু সুরক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।

সহযোগিতায়: unicef

আলোচনায় সুপারিশ

* শরণার্থীশিবিরে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন

*  শীতকালে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত শীতবস্ত্রের ব্যবস্থা করতে হবে

*  রোহিঙ্গা শিশুদের দ্রুত টিকাদানের ব্যবস্থা করা দরকার

* শরণার্থীশিবিরগুলোতে শিশুবান্ধব কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা জরুরি

*  রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য ন্যূনতম শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে

*  রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য বিনোদন ও খেলাধুলার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন

*  কিশোরী ও কিশোরী গর্ভবতী মেয়েদের স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে

*  শরণার্থীশিবিরে জন্ম নেওয়া নবজাতকের জন্মনিবন্ধনের ব্যবস্থা করা উচিত

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম: মিয়ানমারে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং এখনো করছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশে–বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে।

আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি, কিন্তু আমাদের সীমিত সাধ্যের কারণে শরণার্থীশিবিরগুলোতে খাদ্য, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষার মতো সুযোগ-সুবিধা সেভাবে প্রদান করতে পারছি না। বিশেষ করে রোহিঙ্গা শিশুরা, যাদের অনেকেই সহিংসতায় তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অথবা পরিবারের সবাইকে হারিয়ে এতিম হয়ে গেছে, তারা স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও সামাজিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

এসব শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আমরা কী করতে পারি, সে বিষয়ে আলোচনার জন্য আজকের এই গোলটেবিল বৈঠক। এখন এ িবষয় আলোচনা করবেন কাজী রিয়াজুল হক।

কাজী রিয়াজুল হক
কাজী রিয়াজুল হক

কাজী রিয়াজুল হক: বিভিন্ন হিসাব মতে, এ বছরের আগস্ট মাস থেকে এ পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু, যাদের বয়স আঠারো বছরের নিচে। অর্থাৎ প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা শিশু বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছে।

এই রোহিঙ্গা শিশুরা মিয়ানমারে থাকাকালীনই তাদের মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত ছিল। ফলে বাংলাদেশে যখন তারা আশ্রয়ের জন্য এসেছে, তখন তারা অপুষ্টি ও অসুস্থতা নিয়ে এসেছে। আবার অনেক শিশু আহত অবস্থায়ও বাংলাদেশের শরণার্থীশিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে।

প্রথম দিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরগুলোতে অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা দেখা গেলেও সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টায় বর্তমানে সেখানে অনেকটাই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তাদের নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং পয়োনিষ্কাশনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।

কিন্তু এই বিশালসংখ্যক শিশু, যারা ইতিমধ্যেই অপুষ্টিতে ভুগছে এবং যাদের হয়তো টিকা দেওয়া হয়নি, তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। যেকোনো সময় এই শিশুদের মধ্যে একটি মহামারি রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই ঝুঁকি আমাদের খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। কারণ, এর সঙ্গে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্যও ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

সৌভিক দাস
সৌভিক দাস

সৌভিক দাস: রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল সমস্যা বলে বর্তমানে পরিগণিত হচ্ছে। এই সমস্যা মোকাবিলায় সরকার ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করে যাচ্ছে। কাজ করতে গিয়ে সবাই যার যার মতো কাজ করছেন, ফলে অনেক সময় এই কাজের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও অসামঞ্জস্য তৈরি হচ্ছে। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট আইন বা নীতিমালার আওতায় থেকে কাজগুলো করা হলে সামঞ্জস্য রক্ষা ও সমন্বয় সাধন অনেকটাই সহজ হবে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের বাংলাদেশে শরণার্থী সুরক্ষা বিষয়ে পৃথক কোনো আইনি কাঠামো নেই।
|
জাতিসংঘের ১৯৫১ সালের শরণার্থী সুরক্ষাবিষয়ক যে কনভেনশন রয়েছে, সেখানেও বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেনি। ফলে শরণার্থী সুরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের একটা আইনি ফঁাক রয়ে গেছে।

এই ফঁাক পূরণের জন্য আমাদের দুটি নির্দেশনা রয়েছে। একটি হলো ২০১৩ সালে মন্ত্রিসভায় গৃহীত কৌশলপত্র এবং অন্যটি হলো সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রণীত ২২টি নির্দেশনা। এ ছাড়া ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করেছে, যেখানে ২২ নম্বর অনুচ্ছেদে শরণার্থী শিশুদের অধিকারের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে।

তা ছাড়া বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নিপীড়নবিরোধী কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে, যার ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে যে কোনো রাষ্ট্র কোনো মানুষকে এমন কোনো পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে না, যেখানে গেলে তারা নিপীড়নের শিকার হবে।

ফলে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে শুধু যে মানবিক দিক থেকেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা নয়, আইনগত দিক থেকেও এটি একটি সঠিক সিদ্ধান্ত হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরগুলোতে প্রতিদিন নতুন শিশু জন্মগ্রহণ করছে। এই নবজাতকদের জন্মনিবন্ধনের বিষয়টি জরুরি। কারণ, জন্মনিবন্ধন করা না হলে এই নবজাতকদের পরিচয় নিয়ে একটি জটিলতা তৈরি হতে পারে। জন্মনিবন্ধন করা মানে এদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া নয়। এটি একটি সনদ, যেখানে উল্লেখ থাকবে যে এই শিশুটির জন্ম বাংলাদেশের শরণার্থীশিবিরে অবস্থানকালে হয়েছে। ফলে, তারা যখন নিজ দেশে ফিরে যাবে, তখন তাদের পরিচয় নিয়ে জটিলতা তৈরি হবে না।

রেজাউল করিম চৌধুরী
রেজাউল করিম চৌধুরী

রেজাউল করিম চৌধুরী: রোহিঙ্গা সমস্যার সঙ্গে বর্তমানে আঞ্চলিক ভূরাজনীতির বিষয়টি জড়িয়ে গেছে। ফলে, আশ্রয় গ্রহণ করা এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোটি একটি সময়সাপেক্ষ বিষয় হবে বলেই মনে হচ্ছে। তাই আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে এবং বিকল্প পরিকল্পনাও থাকতে হবে।

বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী আগমনের কারণে কক্সবাজার জেলার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এ বছরের ডিসেম্বর নাগাদ ৪১ শতাংশের বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতি বর্গকিলোমিটারে কক্সবাজারে জনসংখ্যার ঘনত্ব দঁাড়াবে ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি, যেখানে সারা দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব ৯১৯। জনসংখ্যার এই চাপ মোকাবিলা করার সক্ষমতা কক্সবাজার জেলার রয়েছে কি না, সেটি একটি চিন্তার বিষয়।

রোহিঙ্গা শিশুদের স্বাস্থ্যের সুরক্ষার ক্ষেত্রে তাদের পয়োনিষ্কাশনের বিষয়ে লক্ষ করতে হবে। বড়দের জন্য যে শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো অনেক সময় শিশুরা ব্যবহার করছে না। তারা তাদের ঘরের কাছে খোলা স্থানে মলত্যাগ করছে। শিশুদের পয়োনিষ্কাশনের জন্য পৃথক ব্যবস্থা করা যায় কি না, সেটি বিবেচনা করতে হবে।

সামনে শীতকাল আসছে, শীতে শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। শীতে শিশুদের ঠান্ডা থেকে সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে শীতবস্ত্রের ব্যবস্থা করতে হবে। 

রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে শিশুদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে। এই শিশুদের চর্মরোগ ইতিমধ্যেই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আশ্রয়শিবিরগুলোতে স্বাস্থ্যকর্মীরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু বড় রোগগুলোর চিকিৎসা দিতে হলে এই শিশুদের হাসপাতালে নিয়ে আসতেই হবে। এই বিষয়টিতেও আমাদের নজর দেওয়া দরকার।

রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরের কাছাকাছি বড় হাসপাতাল হলো উখিয়া হাসপাতাল। রোহিঙ্গা কিশোরী ও শিশুদের চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতাল ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সেটি করতে হলে অবশ্যই এই হাসপাতালটির সক্ষমতা ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

মনিরা হাসান
মনিরা হাসান

মনিরা হাসান: রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবিলার জন্য ইউনিসেফ তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা, মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে।

তাৎক্ষণিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বর্তমানে যে সমস্যাগুলোর সমাধান সবচেয়ে বেশি জরুরি, সেগুলো নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে পুরো সমস্যাটির একটি স্থায়ী ও নির্ভরযোগ্য সমাধান করার চেষ্টা করছি আমরা।

এই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে আমরা সরকার এবং আমাদের সহযোগী বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করে যাচ্ছি।

আমরা শরণার্থীশিবিরগুলোতে একটি করে শিশুবান্ধব এলাকা প্রতিষ্ঠা করার কাজ করছি, যেখানে শিশুরা এসে বিভিন্ন খেলাধুলা করতে পারবে এবং বিভিন্ন বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারবে। এর ফলে তারা মানসিক যে আঘাত পেয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে পারবে।

আমরা রোহিঙ্গা শিশু ও কিশোরীদের নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সহায়তা প্রদান ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে সাহায্য করার জন্য একটি ব্যবস্থা শুরু করতে যাচ্ছি। এ ছাড়া রোহিঙ্গা শিশুদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য আমরা একটি ডেটাবেইস তৈরির কাজও করছি।

আমরা কাজ করতে গিয়ে যে বিষয়টির মুখোমুখি হয়েছি, সেটা হলো রোহিঙ্গা শিশু ও কিশোরীদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প শুরু করলেও তারা এই প্রকল্পগুলো কীভাবে গ্রহণ করছে, সে বিষয়ে আমাদের সঠিক কোনো ধারণা নেই। কারণ, রোহিঙ্গা সমাজব্যবস্থা বা যে সামাজিক পরিবেশে এই শিশুরা বেড়ে উঠেছে, সে সম্পর্কে আমাদের আগের কোনো ধারণা নেই। এই বিষয়টি আমাদের কাজকে আরও কঠিন করে তুলছে।

তানিয়া নুসরাত জামান
তানিয়া নুসরাত জামান

তানিয়া নুসরাত জামান: প্রায় সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শিশু। এদের মধ্যে পঁাচ বছরের কম বয়সী শিশু রয়েছে ৫০ শতাংশের কিছু বেশি আর বাকিদের বয়স ছয় বছর বা তার বেশি।

এই বিশালসংখ্যক শিশুর স্বাস্থ্য ও অন্যান্য চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে আমাদের মাথায় রাখতে হবে, সবার চাহিদা একেবারে পূরণ করার মতো সক্ষমতা আমাদের সরকার ও বেসরকারি সাহায্যকারী সংস্থাগুলোর নেই। ফলে আমাদের ছোট ছোট অংশে ভাগ করে কাজ করতে হবে। আমাদের চিহ্নিত করতে হবে কোন শিশুদের সবচেয়ে বেশি এবং দ্রুত সহায়তা দরকার। তাদের চাহিদা পূরণ করে আমাদের অন্যদের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

সাধারণত এমন পরিস্থিতিতে যেসব শিশু তাদের পরিবার বা মা-বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। আমাদের এই শিশুগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের সবার আগে সাহায্যের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

এ ক্ষেত্রে একটি সমস্যা হবে যে আসলেই কোন শিশুগুলো পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, সেটি চিহ্নিত করা একটি কঠিন কাজ।

এই বিষয়গুলো সঠিকভাবে ও দ্রুততার সঙ্গে চিহ্নিত করা এবং তালিকাবদ্ধ করার জন্য আমাদের যঁারা সমাজকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী রয়েছেন, তঁাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

যেসব রোহিঙ্গা শিশুকে চিহ্নিত করা হচ্ছে বা নিবন্ধিত করা হচ্ছে, তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে যুক্ত করে দিতে হবে। শুধু তালিকা করে চিহ্নিত করলেই কাজ শেষ হয়ে যাবে না। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধায় তাদের অন্তর্ভুক্তিও নিশ্চিত করতে হবে।

আসফিয়া আজিম
আসফিয়া আজিম

আসফিয়া আজিম: রোহিঙ্গা শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য আমাদের দুইভাবে পরিকল্পনা করে কাজ করতে হবে। প্রথমত, আমাদের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পরিকল্পনা করতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, দীর্ঘ মেয়াদে রোহিঙ্গা শিশুদের পুষ্টিগত উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা করতে হবে।

তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা বলতে যে শিশুগুলো তাদের মা–বাবার সঙ্গে সাত বা আট দিনের পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসছে, তাদের তাৎক্ষণিক পুষ্টিকর খাবার ও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, এই শিশুগুলো মিয়ানমারে থাকা অবস্থাতেই অপুষ্টির শিকার ছিল। তারপর এই সহিংসতার মধ্যে তাদের এই অপুষ্টি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি চরম আকার ধারণ করেছে।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে তারা বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশের পরপরই চিকিৎসাটা পাচ্ছে না। ফলে এই শিশুদের বাংলাদেশে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

আর আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে, যেন দেশীয় অবকাঠামোর ওপর কোনোভাবে চাপ সৃষ্টি না করি। একটি হাসপাতালের শয্যা বৃদ্ধি করাটা এখন হয়তো আমাদের জন্য কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। কিন্তু শরণার্থীশিবিরগুলোতে অস্থায়ীভাবে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার সুবিধা বাড়াতে পারি।

রোহিঙ্গা শিশুদের জরুরি ভিত্তিতে টিকা দেওয়া দরকার। কারণ, অনেক দিনের চেষ্টার পর আমরা আমাদের দেশকে পোলিওমুক্ত করতে পেরেছি। কিন্তু রোহিঙ্গা শিশুদের মধ্যে পোলিও রোগটি রয়েছে। এই শিশুদের টিকা দেওয়া না হলে এখান থেকে আমাদের দেশের অভ্যন্তরে পোলিও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়।

এম নজরুল ইসলাম
এম নজরুল ইসলাম

এম নজরুল ইসলাম: বর্তমানে শরণার্থীশিবিরগুলোতে একটা বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে যে সেখানে যে ঘরগুলো রয়েছে, সেগুলো খুব ছোট আকারের। অন্যদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পরিবারের আকার অনেক বড় হয়ে থাকে। ফলে ছোট পলিথিনের তৈরি ঘরগুলোতে একেকটি পরিবারের ২০ বা ২৫ জন সদস্য গাদাগাদি করে থাকছে। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হচ্ছে শিশুদের। তারা পর্যাপ্ত বিনোদন ও খেলাধুলার জায়গা পাচ্ছে না।

একটা বিষয় আমি লক্ষ করেছি, নতুন করে যে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এসেছে, তাদের মধ্যে শিক্ষা কিছুটা রয়েছে। রোহিঙ্গা শিশুদের অনেকেই মিয়ানমারে থাকতে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণিতে লেখাপড়া করত।

আমাদের রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরগুলোতে এই শিশুদের ন্যূনতম লেখাপড়ারও ব্যবস্থা নেই। ফলে এই ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে দেখা যাচ্ছে শরণার্থীশিবিরের এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের বিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই আবার খেলাধুলা করার জন্য পর্যাপ্ত জায়গাও নেই।

আমি অনেক রোহিঙ্গা শিশুর সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের প্রায় সবাই বলেছে যে তারা ইংরেজি শিখতে চায়, তারা বার্মিজ ভাষায় পড়াশোনা করতে চায়। তারা ফুটবল, ভলিবলসহ অন্যান্য খেলা খেলতে চায়।

খেলাধুলা ও লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে এই শিশুগুলো মানসিক অবক্ষয়ের একটি ঝুঁকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের শরণার্থীশিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট খেলার জায়গা এবং ন্যূনতম লেখাপড়া করার সুযোগ থাকা দরকার বলে আমি মনে করি।

তাসাদ্দুক হোসেন
তাসাদ্দুক হোসেন

তাসাদ্দুক হোসেন: রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের প্রথম দিকে শরণার্থীশিবিরগুলোতে খুবই অরাজক ও অস্থিতিশীল একটা পরিবেশ বিরাজ করছিল। মিয়ানমার থেকে আসা মানুষগুলো দিশেহারার মতো এদিক-ওদিক ছুটেছে, আবার যঁারা তাদের সাহায্যের জন্য গিয়েছেন, তঁারাও বুঝে উঠতে পারছেন না কীভাবে কী করবেন। কিন্তু সেনাবাহিনী যখন শৃঙ্খলার দায়িত্ব গ্রহণ করল, তখন এই পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন সবকিছুর মধ্যে একটা শৃঙ্খলা এসেছে।

শরণার্থীশিবিরগুলোতে মানুষের চাপের কারণে সেখানকার পরিবেশ ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করেছে। এখন বৃষ্টি কমে গেলেও রোদ ও গরম কিছুটা বেড়েছে। আবার সামনে শীতকাল আসছে। এই পরিবেশে যঁারা প্রাপ্তবয়স্ক আছেন, তঁাদেরই অনেক কষ্ট হচ্ছে। এই পরিবেশে শিশুদের অবস্থা কী, তারা কীভাবে বেঁচে আছে, সেটা ভাববার বিষয়।

২০ হাজারের মতো শিশুর মা–বাবা নেই, এই পরিবারবিচ্ছিন্ন শিশুদের অবস্থা আরও করুণ। সরকার রোহিঙ্গা  শিশুদের জন্য একটি শিশুপল্লি গঠন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ২০০ একরের মতো জায়গায় এটি করা হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে আমরা যঁারা বেসরকারিভাবে সেখানে কাজ করছি, তঁাদের এই কাজে সহায়তা করা উচিত।

শরণার্থীশিবিরগুলোতে আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলোরও বিনোদনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। তারা একটি ভয়াবহ নির্যাতন থেকে পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। তাদের সামাজিক পরিবেশটাকে যদি আমরা একটু আনন্দময় না করতে পারি, তাহলে তারা মানসিকভাবে বেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে আর এর ফলে তাদের বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজেও জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

শারমিন খান
শারমিন খান

শারমিন খান: আমাদের মোবাইল টিম ইউএনএইচসিআরের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী শরণার্থীশিবিরগুলোতে ঘরে ঘরে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকা মানুষদের তালিকা তৈরি করছে। এই তালিকায় শিশু, কিশোর ও কিশোরী এবং গর্ভবতী নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এখানে একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা গর্ভবতী রয়েছেন, তঁাদের বয়স অনেক কম, কিশোরী বয়সেই মেয়েরা গর্ভবতী হয়ে যাচ্ছে। ফলে তঁাদেরও এই তালিকায় যুক্ত করা হচ্ছে।

আমরা রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরগুলোতে কিছু শিশুবান্ধব কেন্দ্র গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। এখন শরণার্থীশিবিরগুলোতে দেখা যাচ্ছে, যঁারা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ আছেন, তঁারা হয়তো খাবারের সন্ধানে বা সাহায্যের সন্ধানে দীর্ঘ সারিতে দঁাড়িয়ে আছেন সারা দিন ধরে।

কিন্তু ছোট শিশু এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা কী করবে, তা বুঝে উঠতে পারছে না। আর এই সময়টাতে তারা যে যা বলছে, তা–ই করছে। ফলে তাদের নিপীড়িত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। ফলে শিশুবান্ধব কেন্দ্র গড়ে তুলে তাদের নিরাপত্তা দেওয়াটা এখন খুবই জরুরি।

শিবিরগুলোতে স্থানীয় আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো একসঙ্গে কাজ করছে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যাচ্ছে যে তাদের কাজের মধ্যে সমন্বয় নেই। ফলে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ছে বা কাজের ফলাফল ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সংস্থার কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে।

যেসব রোহিঙ্গা শিশুর কোনো পরিবার নেই, তাদের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি কঠোর দিকনির্দেশনা অনুসরণ করা উচিত। কারণ, অনেক সংস্থা আছে, যারা এই শিশুদের দায়িত্ব নিতে আগ্রহী কিন্তু তাদের দায়িত্ব নেওয়ার সক্ষমতা নেই। তখন দেখা যায়, তাদের কাছে গিয়ে শিশুরা আবার নিপীড়নের শিকার হয়। ফলে শিশুদের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা থাকা দরকার এবং তা কঠোরভাবে অনুসরণ করা দরকার।

হুমায়রা ফারহানাজ
হুমায়রা ফারহানাজ

হুমায়রা ফারহানাজ: আমরা রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরগুলোতে নারী ও কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য কাজ করছি এবং গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী প্রদান করছি। শরণার্থীশিবিরগুলোতে অল্প বয়সী কিশোরী ও শিশুরা যৌন নিপীড়ন এবং পাচার হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

পাশাপাশি অল্প বয়সী অনেক কিশোরও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে শরণার্থীশিবিরগুলোতে। বিষয়টি আমরা সেভাবে খেয়াল করছি না।

শরণার্থীশিবিরগুলোতে যৌন নিপীড়ন রোধ করতে এবং যৌন নিপীড়নের শিকার কিশোরী ও শিশুদের সাহায্যের জন্য বেশ কিছু কেন্দ্র ইতিমধ্যেই চালু করা হয়েছে। কিন্তু যারা এই নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, তারা সবাই এই সাহায্যের জন্য আসছে কি না, সেটি ভাববার বিষয়।

রোহিঙ্গা কিশোরীরা সাধারণত দিনের বেলা ঘর থেকে বের হয় না, ফলে তারা এই সাহায্যগুলো নেওয়ার জন্য আসতে পারে না। তাদের কাছে এই সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে নারীদের যৌন স্বাস্থ্যসেবার জন্য যে কাজ করা হচ্ছে বা বিভিন্ন সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে, সেগুলো প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের জন্য উপযোগী।

এই সেবা ও সামগ্রীগুলো অল্প বয়সী কিশোরীদের জন্য ততটা উপযোগী নয়। অল্প বয়সী কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার জন্য পৃথকভাবে কাজ করা দরকার বলে আমি মনে করি।

এ কে এম খায়রুল আলম
এ কে এম খায়রুল আলম

এ কে এম খায়রুল আলম: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ১২ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শনের পর রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার জন্য বেশ কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

সেই ধারাবাহিকতায় ১৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে ১৭ নম্বর সিদ্ধান্তটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের জন্য প্রদত্ত হয়।

এই সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা এতিম শিশুদের তালিকা তৈরি করে তাদের কল্যাণে কীভাবে কাজ করা যায়, সে বিষয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিকল্পনা গ্রহণ করবে।

ইতিমধ্যেই সমাজসেবা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে একটি তথ্য সংগ্রহকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এই কেন্দ্রে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত ২৩ হাজার ৫৯০টি শিশুর বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১২ হাজার শিশুর তথ্য আমরা ইতিমধ্যেই যাচাই করে তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের উদ্যোগে প্রায় ৪৯ কোটি টাকার একটি কর্মসূচি আমরা তৈরি করেছি, যার মধ্যে ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা বাংলাদেশ সরকার প্রদান করবে এবং বাকি টাকা বিভিন্ন দাতা সংস্থা প্রদান করবে। এই বিষয়ে বিভিন্ন দাতা সংস্থার সঙ্গে ইতিমধ্যেই সমঝোতা স্মারক চূড়ান্ত করেছি।

২০০ একর জায়গা সমাজসেবা অধিদপ্তরকে দেওয়ার জন্য আমরা ইতিমধ্যেই কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের বরাবর আবেদন করেছি।

২০০ একর জায়গায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এতিম রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করব, যেখানে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য শিশু পরিবার গড়ে তোলা হবে। আমরা সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ইতিমধ্যেই সারা দেশে ৮৫টি শিশু পরিবার সফলভাবে পরিচালনা করছি, যেখানে প্রায় ২০ হাজার ছেলে ও মেয়ে শিশুকে লালন-পালন করছি।

এই ২০০ একর জায়গায় এতিম ও পরিবারবিচ্ছিন্ন রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য শিক্ষা, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বিনোদনসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে।

কাজী রিয়াজুল হক: রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় আমাদের সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যেভাবে কাজ করেছে, সেটি আসলেই প্রশংসাযোগ্য।

কিন্তু একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে মধ্য মেয়াদে এই সমস্যা কিছুটা মোকাবিলা করতে পারছি কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এই সমস্যার মোকাবিলা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

কারণ, এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে দীর্ঘদিন আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশ সরকারের পক্ষেও সম্ভব নয় এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর জন্যও কষ্টকর হয়ে যাবে। ফলে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবশ্যই মিয়ানমারে ফিরে যেতে হবে।

রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ অত্যন্ত প্রশংসনীয় একটি ভূমিকা পালন করেছে এবং এই ভূমিকা আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশ তার ভূমিকা পালন করেছে, এখন আন্তর্জাতিক মহলেরও তাদের নিজেদের ভূমিকা পালন করতে হবে।

রোহিঙ্গা সংকটে মিয়ানমারকে নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যে প্রস্তাব তুলে ধরা হচ্ছে, সেটি বারবার নিরাপত্তা পরিষদ থেকে ফেরত আসছে।

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর এই অমানবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের কাছ থেকে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই বেশ কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। রাশিয়াও শেষ পর্যন্ত নিন্দা প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছে।

কিন্তু তারপরও নিরাপত্তা পরিষদের একটি সদস্যদেশের বিরোধিতার কারণে এই প্রস্তাব গৃহীত হচ্ছে না। ওরা মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে আসছে।

এর ফলে মিয়ানমার মানবতার বিরুদ্ধে এত জঘন্য অপরাধ করতে এবং হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করছে না।

সারা বিশ্ব যে বিষয়ে একমত, সেখানে একটি দেশ স্বার্থের কারণে বিরোধিতা করার ফলে প্রস্তাব গৃহীত হচ্ছে না। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। নিরাপত্তা পরিষদের এই কার্যপ্রণালি পরিবর্তনের সময় এসে গেছে।

আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে মিয়ানমারের এই মানবতাবিরোধী অপরাধকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে, যেভাবে সাবেক যুগোস্লাভিয়া বা রুয়ান্ডার অপরাধের বিচার করা হয়েছিল।

আব্দুল কাইয়ুম: রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও আমাদের সবার করণীয় রয়েছে। তা না হলে এসব িশশুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। আলোচনায় অংশ গ্রহণের জন্য সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।

যাঁরা অংশ নিলেন

কাজী রিয়াজুল হক          : চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

এ কে এম খায়রুল আলম  : অতিরিক্ত সচিব, পরিচালক, সমাজসেবা অধিদপ্তর, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়

এম নজরুল ইসলাম         : কর্মসূচি সমন্বয়কারী, ব্র্যাক শিক্ষা কার্যক্রম

আসফিয়া আজিম            : পুষ্টি বিশেষজ্ঞ, কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড

তানিয়া নুসরাত জামান     : হেড অব চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড প্রোটেকশন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ

শারমিন খান                  : ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনাল

হুমায়রা ফারহানাজ         : ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার, জেন্ডার, এডোলেসেন্ট অ্যান্ড ইয়ুথ, ইউএনএফপিএ

রেজাউল করিম চৌধুরী     : নির্বাহী পরিচালক, কোস্ট ট্রাস্ট

সৌভিক দাস                   : এক্সটারনাল রিলেশন অফিসার,    ইউএনএইচসিআর

তাসাদ্দুক হোসেন             : উপপরিচালক, কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার

মনিরা হাসান                 : শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ

সঞ্চালক

আব্দুল কাইয়ুম             : সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো