বিজয়ফুল পরব না?

আজকে যাঁরা চল্লিশ পেরিয়ে চালশের ফেরে পড়েছেন, তাঁরা একাত্তর দেখেননি, একাত্তর শুনেছেন। তাঁরা হয়তো পড়েছেন বইয়ের পাতায়; সেটাও সবাই একই বইয়ের পাতায় একই একাত্তর পড়েছেন কি না কে জানে। কে কোন আমলে জন্ম নিয়েছেন, তার ওপর নির্ভর করে তিনি কী পড়েছেন আর জেনেছেন। অনেকেই বলেন, যুদ্ধের বছর; আগে অনেকেই বলতেন গন্ডগোলের বছর; নানা প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পর এখন আর কেউ তা বলেন না। অন্তত প্রকাশ্যে না; এটাও একটা অর্জন। সাদাকে সাদা বলা, কালোকে কালো বলতে পারার শক্তি কজনের আছে।

রাজপাটে বসে লোকলস্কর-ভক্ত-পেয়াদা নিয়েও স্রেফ কূটনীতি আর রাজনীতির ধান্দায় কত কিছুই না আমাদের চেপে যেতে হয়। চাপতে চাপতে তলপেট ফুলে বেলুন হয়, আমাদের চাপা কমে না। তবে একাত্তর নিয়ে কী বলব, কী পড়ব, কীভাবে উদ্‌যাপন করব, তাতে একটা সহমত ক্রমে দানা বাঁধছে। কেউ শহীদ মিনারে সন্ধ্যাদীপ-মোমবাতি জ্বালিয়ে বিজয়ের দিনে যাঁদের রক্তে আজ আমাদের এত রোয়াব, তাঁদের স্মরণ করেন; কেউ ফুল দেন শ্রদ্ধার সঙ্গে। পুরান ঢাকায় সারা রাত জেগে ছেলেমেয়েরা সাজাত রাস্তার মোড়; কাগজ আর বাঁশের ট্যাংক (আজও কি সেটা হয় বিজয়ের স্মরণে)। অনেক দিন যাওয়া হয় না সিদ্দিকবাজার, আরমানিটোলা, জিন্দাবাহার লেন। তার জন্য তো বিজয়ের মাস, বিজয় দিবস থেমে থাকে না।

প্রজন্মের কাছে একই বার্তা পৌঁছানো আমাদের পরম দায়িত্ব। আমাদের দায়িত্ব, কীভাবে সবাই মিলে একইভাবে শ্রদ্ধার সঙ্গে শহীদ আর বিজয়ের মাসটা স্মরণ করা যায়? এসব চিন্তা থেকেই বিজয়ফুলের সূচনা।

নিজেদের গৌরবগাথা স্মরণ করে পৃথিবীর অনেক জাতি ও দেশ ফুলের প্রতীক পোশাকে লাগায়। কোনো এক নভেম্বরে লন্ডনে নেমে দেখি সবার বুকে পপি ফুল। তাঁরা স্মরণ করছেন তাঁদের সব শহীদকে। লাল পপি স্মরণিকা সূচিত হয় কানাডার এক চিকিৎসকের হাত ধরে। লে. কর্নেল জন মাক্রে একটা কবিতা লিখেছিলেন ‘ইন ফ্লানডারস ফিল্ড’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্রের রক্তক্ষয়ী এক ক্ষেত্র ছিল ফ্লানডারস ফিল্ড। সেখানে ফুটত পপি ফুল, যেন নিহত সৈনিকদের রক্তে ফোটা ফুল!

লে. কর্নেল জন মাক্রের মর্মস্পর্শী সেই বর্ণনা জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিয়া মিচিলকে আলোড়িত করে। তিনি লেখেন আরেক অমর কবিতা ‘উই শ্যাল কিপ দ্য ফেইথ’। তিনি এই কবিতায় সবাইকে নভেম্বরে বুকে পোশাকে পপি ফুল ধারণের আহ্বান জানান। গোটা ইউরোপ সাড়া দেয় সেই ডাকে।

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর আনাচকানাচে যেখানই বাংলাদেশের মানুষ আছে, সেখানেই এখন কবি শামীম আজাদের ডাকে সাড়া দিয়ে ডিসেম্বরের ১ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত বিজয়ফুল ধারণের উৎসাহ ক্রমে দানা বেঁধে উঠছে। স্কুলে স্কুলে শিশুরা নিজেরা এই ফুল তৈরি করে নিজেরা পরছে, সবাইকে পরাচ্ছে। স্বাধীনতা, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতীক হয়ে উঠেছে পাঁচ পাপড়ি আর লাল সূর্যের বিজয়ফুল। আসুন, আমরাও যোগ দিই বিজয়ফুলের মিছিলে। নতুন প্রজন্ম জানুক, কেন এই দিন, কেন এই মাস।

গওহর নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণকর্মী এবং শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।