সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন করবে না: সন্তু লারমা

>পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রথম আলো মুখোমুখি হয় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা
সন্তু লারমা
সন্তু লারমা

প্রথম আলো: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর হয়ে গেল। চুক্তির আগে ও পরের অবস্থার মধ্যে কী পার্থক্য দেখেন?
সন্তু লারমা: চুক্তি স্বাক্ষরের সময় প্রত্যাশা ছিল অনেক। স্বাভাবিকভাবে মনে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল। কিন্তু ২০ বছর পর অবস্থাটা ঠিক বিপরীত। চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। আর এর অর্থ হলো পার্বত্য সমস্যার সমাধান না হওয়া। এখন সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়ে উঠেছে।

প্রথম আলো: তাহলে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে আপনারা হতাশ?
সন্তু লারমা: পরিস্থিতি এমন যে এখন বাস্তবায়নের আশাও করি না। এ সরকার বা এ জাতীয় সরকার চুক্তির বাস্তবায়ন করবে বলে আমরা মনে করি না। এই নেতিবাচক অনুভূতি আমাদের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে।


প্রথম আলো: কোন ধরনের সরকার এ চুক্তি বাস্তবায়ন করবে?

সন্তু লারমা: অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সরকার।

প্রথম আলো: অথচ এখন যে দল ক্ষমতায় আছে তাদের সময়েই তো চুক্তি করেছিলেন।

সন্তু লারমা: তখন মনে করেছিলাম সরকার করবে। কিন্তু গত ২০ বছরে দেখেছি, সরকারগুলো তো তেমন না। তারা জাত্যভিমানী এবং অসাম্প্রদায়িক না। এদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নেই। না হলে ২০ বছর ধরে এমন একটা চুক্তি বাস্তবায়িত হবে না, এটা তো বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়।

প্রথম আলো: বুধবার সংবাদ সম্মেলনে আপনি বলেছেন, চুক্তির মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়ন হয়েছে। তাহলে কিছু বাস্তবায়ন তো হয়েছে।

সন্তু লারমা: এ সরকার ২০০৯ সাল থেকে একটানা ক্ষমতায় আছে। তারা কী করেছে? হ্যাঁ, একটা দেখাতে পারে। এ সময়ে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিরোধাত্মক ধারা ছিল, সেগুলো সংশোধন করা হয়ছে। এ ছাড়া দৃশ্যমান কিছু করেনি, বরং চুক্তির বিরোধী সমস্ত কর্মকাণ্ড করেছে।

প্রথম আলো: উদাহরণ দিতে পারবেন?

সন্তু লারমা: ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন করা হলেও বিধিমালা করেনি। কমিশন গঠিত হয়েছে, কিন্তু এর প্রয়োজনীয় লোকবল নেই, তহবিল নেই। চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সব অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের কথা ছিল। কিন্তু এখনো চার শর বেশি ক্যাম্প আছে। পাহাড়ে যত্রতত্র অভিযান, তল্লাশি, ধরপাকড় চলছে। চুক্তি অনুযায়ী, পুলিশ ও বন আইন সংশোধন করার কথা থাকলেও তা করেনি। পর্যটনকেন্দ্র স্থাপন করে নির্বিচারে জায়গা দখল করা হচ্ছে। পার্বত্য চুক্তির প্রথম ধারাতেই এ অঞ্চলকে ‘উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চল’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। অথচ প্রতিদিন সেখানে বাঙালিদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে, জেলা প্রশাসকেরা বহিরাগতদের স্থায়ী বাসিন্দার সনদ দিচ্ছেন। এসবের লক্ষ্য পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা।

প্রথম আলো: আপনি বলছেন, চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, তাঁরা আন্তরিক। ধীরগতি হলেও চুক্তি বাস্তবায়িত হচ্ছে।

সন্তু লারমা: সরকার এবং এর মন্ত্রীরা সত্যের অপলাপ করেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ই চুক্তিবিরোধী, জুম্ম স্বার্থবিরোধী। পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী, সচিব সবাই চুক্তিবিরোধী।

প্রথম আলো: চুক্তির পর তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার, এক মেয়াদে বিএনপি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারও ছিল দুই বছর। এসব সরকারকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন।

সন্তু লারমা: এসব সরকারের মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। তারপর বিএনপি। কিন্তু কোনো সরকারই আন্তরিকতা নিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি।

প্রথম আলো: চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে বছর দুয়েক আগে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

সন্তু লারমা: ২০১৫ সালের ২ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে ওই সময় ১০ দফাভিত্তিক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। এখনো সেটা চলছে। এবারও সেই আন্দোলন জোরদার করার কথা বলা হয়েছে।

প্রথম আলো: আন্দোলনের অর্জন কী।

সন্তু লারমা: চুক্তির বাস্তবায়ন না হলে অর্জন কীভাবে হবে। যেহেতু চুক্তির বাস্তবায়ন হয় নাই, তাই অর্জনও নেই।

প্রথম আলো: এই অসহযোগ চলার মধ্যেই গত দুই বছরে জেএসএস ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন নিয়ে সরকারের সঙ্গে বসেছে। তার মানে এই অসহযোগের পাশাপাশি সহযোগিতাও আছে?

সন্তু লারমা: হ্যাঁ, সহযোগিতা তো আছেই। এটা তো বাদ দিচ্ছি না।

প্রথম আলো: প্রতিষ্ঠার পর থেকে জেলা পরিষদ চলছে অনির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। এর নির্বাচন নিয়ে আপনারা কথা বলছেন না কেন?

সন্তু লারমা: নির্বাচন তো করবে সরকার। নির্বাচন করতে গেলে একটি বিধিমালা দরকার। বিধিমালা প্রণয়ন করবে সরকার। ভোটার তালিকা বা বিধিমালার বিষয়ে চুক্তিতে বলা আছে। পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে একটি ভোটার তালিকা হবে। ওই ভোটার তালিকা দিয়ে জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন হবে।

প্রথম আলো: ২০ বছরে পাহাড়ের উন্নয়নকে কীভাবে দেখেন? কিছু তো কাজ হয়েছে। দারিদ্র্য কমেছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা বেড়েছে।

সন্তু লারমা: উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো সুষ্ঠু, সাধারণ ও গণতান্ত্রিক প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি। এর কোনো কিছুই নেই পার্বত্য চট্টগ্রামে। প্রচুর রাস্তাঘাট হয়েছে। দালানকোঠা হয়েছে। এগুলো প্রকৃত উন্নয়ন নয়। উন্নয়নের মূল শর্ত হলো, এলাকার প্রশাসন গণতান্ত্রিক ও জনমুখী করে তোলা। সেটা নিশ্চিত হলে উন্নয়ন অর্থবহ হয়। সামাজিকভাবে আমরা আতঙ্কিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন কমপক্ষে সাত লাখ বহিরাগত আছে। পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে। সেটেলাররা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গেছে। স্বাধীনভাবে সভা-সমাবেশ করার অধিকার নেই। গুটিকয় মানুষ লুটপাট করে ভালো আছে। যেমন ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ভালো আছে। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্যরা ভালো আছেন। আমি তো উন্নয়ন বলে কিছু দেখি না।

প্রথম আলো: এখন জেএসএস কী করবে?

সন্তু লারমা: পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়নে আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন চলতে থাকবে।

প্রথম আলো: ভবিষ্যতের পাহাড়ের চিত্র কেমন হবে বলে আপনার মনে হয়?

সন্তু লারমা: পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ অন্ধকার মনে হয়। এক অশান্ত পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।