ধীরে হলেও বাস্তবায়ন হচ্ছে: বীর বাহাদুর

>পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রথম আলো মুখোমুখি হয় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা
বীর বাহাদুর
বীর বাহাদুর

প্রথম আলো: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ফসল পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু জেএসএস নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলছেন, তিনি প্রতারিত বোধ করছেন। চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে তিনি হতাশ।
বীর বাহাদুর: তৃতীয় কোনো পক্ষের সহায়তা ছাড়াই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা স্থাপন করে জেএসএস এ চুক্তি করে। দুই পক্ষই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেছিল এবং দীর্ঘদিনের সংঘাতের অবসান করে শান্তি চেয়েছিল। সবাই চায় এ চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হোক। প্রধানমন্ত্রীরও এ নিয়ে আন্তরিকতার অভাব নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য নানা শাখা আছে। যেমন শরণার্থীদের জন্য টাস্কফোর্স আছে। চুক্তির অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে একটি কমিটি আছে জাতীয় সংসদের উপনেতাকে প্রধান করে। এখানে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান আছেন। তাঁরা চুক্তির পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ন করে আমাদের কাছে পাঠাবেন। আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করব।

এখন জেএসএস যে হতাশার কথা বলছে, আমি এর কোনো কারণ দেখি না। সন্তু লারমা পার্বত্য এলাকার নেতা। সেই হিসেবে মানুষের প্রত্যাশার বিষয়টি হয়তো তাঁর ভাবনায় থাকে। মানুষের প্রত্যাশা তিনি পূরণ করতে চান। কিন্তু তিনি যে গতিতে চাচ্ছেন তা হয়তো হচ্ছে না। চুক্তি বাস্তবায়নের গতি ধীর হতে পারে, কিন্তু প্রক্রিয়া তো বন্ধ হয়ে যায়নি।
প্রথম আলো: অন্যান্য মন্ত্রণালয় বিষয়ভিত্তিক। ব্যতিক্রম পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় কতটুকু ক্ষমতা নিয়ে কাজ করতে পারছে?
বীর বাহাদুর: এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেওয়া যাবে না। কারণ পুলিশ বা প্রশাসনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগছে। তারপরও আমরা সবাই মিলে সমন্বয় করে কাজ করার চেষ্টা করছি। বিভিন্ন বিভাগ জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরের কথা থাকলেও বাস্তবায়ন হয়নি এখনো। সমস্যাগুলোর সমাধানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে আমরা বলছি। এটা ঠিক, কিছু বিষয় চুক্তির আলোকে হস্তান্তর করা হয়নি। তবে স্থানীয়ভাবে সমন্বয় করে কাজ করছি। সমস্যাটি আমরা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীকেও বলছি।
প্রথম আলো: চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৩৬টিই জেলা পরিষদ-সংক্রান্ত। এ চুক্তির মূল চেতনাই হচ্ছে বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা।
বীর বাহাদুর: জেলা পরিষদ বা আঞ্চলিক পরিষদ চলছে অনির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা। জেলা পরিষদ কাঠামোর চেয়ে কম সদস্য নিয়ে চলছে। যেখানে ৩১ সদস্য নিয়ে জেলা পরিষদের কাজ করার কথা, সেখানে ১৫ জন সদস্য আছে।
প্রথম আলো: চুক্তির পর আওয়ামী লীগই বেশি সময় ধরে সরকারে আছে। দায়টা কি আপনাদের বেশি না? এত দিন ধরে অনির্বাচিত প্রতিনিধি আছে কেন?
বীর বাহাদুর: আমরা নির্বাচনের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বলেছি। নির্বাচিত প্রতিনিধি এলে গতি যে বাড়বে, সে বিষয়েও তাগাদা দিয়েছি।
প্রথম আলো: তারা কী বলছে?
বীর বাহাদুর: তারা বলছে, চেষ্টা করছে।
প্রথম আলো: এসব চেষ্টার পর নির্বাচন করতে না পারাটা কি ব্যর্থতা নয়? মূল উদ্দেশ্য এসব প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ?
বীর বাহাদুর: ব্যর্থতা নয়। আমরা চেষ্টা করছি। আর দলীয়করণ করেছি, এটা ঠিক নয়।
প্রথম আলো: জেলা পরিষদে আপনাদের দলের লোকই তো আছে।
বীর বাহাদুর: কাউকে না কাউকে তো রাখতে হবে। আর দলের লোক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যাদের দিয়ে দ্রুত কাজ করা যাবে, সেসব লোকই আমরা বেছে নেব। তবে আমরাও চাই নির্বাচন হোক।
প্রথম আলো: কোনো সময়সীমা, এ সরকারের তো এক বছরের মতো সময় আছে, এর মধ্যে নির্বাচন হতে পারে না?
বীর বাহাদুর: আমি জানি না। এ সময়ে তো সিটি করপোরেশনের নির্বাচনগুলো আছে।
প্রথম আলো: দিন দিন জেলা পরিষদগুলো তাদের ক্ষমতা হারাচ্ছে বলে মনে হয়। যেমন ধরুন, পরিষদের চেয়ারম্যানদের পদমর্যাদা কী হবে, তা এখনো পরিষ্কার না। আগে তাঁরা উপমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করতেন। তাই সচিব কোনো বৈঠক আহ্বান করলে তাঁরা আসতেন না। এখন সচিবের আহ্বানে সবাই এসে হাজির হন। এটা কি বাধ্যতামূলক?
বীর বাহাদুর: না বাধ্যতামূলক নয়। তাঁরা আসেন কাজের খাতিরে। আমরাও চাই পদমর্যাদার বিষয়টি পরিষ্কার হোক। সচিবের সভাপতিত্বে কোনো সভায় থাকা মানে মান কমে যাওয়া নয়।
প্রথম আলো: পার্বত্য সমস্যার মূলে আছে ভূমি-এটা সর্বজনগ্রাহ্য। অথচ ভূমি ও পুলিশ জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর নিয়ে ততটা আলোচনা নেই। মন্ত্রণালয় এ দুটি বিষয় হস্তান্তরে কী ভূমিকা নিয়েছে?
বীর বাহাদুর: এ বিষয়ে আমাদের কিছু করার নেই। তবে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি। যেমন ভূমির জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় এবং পুলিশের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একাধিকবার চিঠি দিয়েছি।
প্রথম আলো: এভাবে একাধিকবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও আপনার কথা শোনা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীকে কখনো জানিয়েছেন এসব বিষয়?
বীর বাহাদুর: অভিযোগ করিনি। তবে চুক্তির বাস্তবায়নের প্রশ্ন এলে বিষয়টি তাঁকে বলেছি। আলোচনা হয়েছে।
প্রথম আলো: ২০ বছরে উন্নয়ন কতটুকু হয়েছে?
বীর বাহাদুর: ১৯৯৭ সালে সরকার থেকে ৪৪ দশমিক ৮০ কোটি টাকা পেতাম। এখন ২০১৭-১৮ সালে ৯১৫ দশমিক ৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দ এসেছে। ৮ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আগে হাসপাতাল ছিল ৩টি এখন ২৫টি। কুটির শিল্প ছিল ১৯৩টি এখন ১৩৮২টি। বান্দরবানের থানচিতে আগে একটি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল। সেখানে যেতে লাগত দুই থেকে তিন দিন। প্রধানমন্ত্রী নিজে সেখানে গেছেন। এখন স্কুল সরকারি হয়েছে। রাস্তা ধরে যেতে লাগে দুই ঘণ্টা। বিদ্যুৎ গেছে। কলেজ সরকারি ঘোষণা হয়েছে। উন্নয়নে ১০০ পেয়েছি বলব না। তবে আগের তুলনায় অনেক হয়েছে।
প্রথম আলো: এসব খাতে উন্নয়ন হলেও পর্যটনসহ পাহাড়ের অর্থনীতির মূল ক্ষেত্রগুলোতে পাহাড়ি মানুষের অবস্থান দুর্বল।
বীর বাহাদুর: এক দিনে সবকিছু অর্জন হবে না। ব্যবসা-বাণিজ্যে পাহাড়িদের এগিয়ে আসতে হবে। এলে ধীরে ধীরে উন্নতি হবে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় পাহাড়ে কি অপরাধ বেশি?
বীর বাহাদুর: চাঁদাবাজি বেশি অন্য এলাকার চেয়ে। পাহাড়ে সেনাবাহিনী মানুষকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। আর সেনা ক্যাম্প তো কমে গেছে। পর্যায়ক্রমে আরও কমবে।