বিসিএস পরীক্ষা ছাড়া শিক্ষা ক্যাডারে আত্মীকরণ আর না

শিক্ষা ক্যাডারে আত্মীকরণ সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। বিষয়টি নিয়ে নিয়মিত ক্যাডার সদস্যদের আপত্তি ও প্রতিবাদ বর্তমানের মতো অতীতেও ছিল। এখন জোরালোভাবে হচ্ছে বলে তা সবার চোখে পড়ছে। অতীতে শিক্ষা ক্যাডারে আত্তীকৃত শিক্ষকদের আধিপত্যের কারণে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে আত্মীকরণ করা হয়েছে। নানা ধরনের নিপীড়নমূলক আচরণের কারণে আত্মীকরণের বিপক্ষে যৌক্তিক বক্তব্যগুলো অতীতে জোরালোভাবে তুলে ধরা যায়নি। শিক্ষা ক্যাডার নিয়ন্ত্রণকারী ওই সকল আত্তীকৃত শিক্ষা সাম্প্রতিক সময়ে অবসরে গেছেন এবং বিসিএস ক্যাডারভুক্ত শিক্ষক-কর্মকর্তারা শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব নিতে শুরু করেছেন। এতে যোগ্য শিক্ষক-কর্মকর্তা দ্বারা সুষ্ঠু ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার সম্ভাবনা এবং শিক্ষা ক্যাডারে সুদিনের আভা দেখা দিয়েছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ঢালাওভাবে আত্মীকরণের উদ্যোগ শিক্ষা ক্যাডারের সকল সদস্যকে চরমভাবে হতাশ করেছে।

অতীতে বিক্ষিপ্তভাবে বেসরকারি কলেজশিক্ষককে ক্যাডারে আত্মীকরণ করা হলেও বর্তমানে একযোগে উদ্যোগ নেওয়ার কারণে কর্মরত ক্যাডার সদস্যের চেয়েও বেশি সংখ্যক বেসরকারি শিক্ষক ক্যাডারভুক্ত হতে যাচ্ছে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় যদি ১৮০০০ বেসরকারি শিক্ষককে শিক্ষা ক্যাডারে আত্মীকরণ করা হয় তবে পরবর্তী বিসিএস পরীক্ষায় কঠিনতম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মনোনীত হয়ে যারা শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করবেন। তাদের প্রথম পদোন্নতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে এই ১৮০০০ জনের পদোন্নতি হওয়া পর্যন্ত, অন্তত পরবর্তী ২০ বছর। শিক্ষা ক্যাডারে পদের স্বল্পতা, ও পদ বৈষম্যের করণে পদোন্নতি ছাড়াই হয়তো একজন বাছাইকৃত মেধাবী শিক্ষককে চাকরি থেকে অবসর নিতে হবে। বিষয়টি মেধা, এবং বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের মর্যাদার প্রতি অবমূল্যায়ন।

বেসরকারি কলেজশিক্ষকদের ক্যাডার ভুক্তির দাবি কতটা যৌক্তিক? ক্যাডার বহির্ভূত থাকলে তারা কি কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন? বিসিএস ক্যাডার সদস্যদের বঞ্চিত করে ক্যাডারভুক্ত হওয়ার দাবি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে নজর রেখে যদি চলমান কাঠামোতে তাদের বেতন-ভাতা সহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করা হয় তাহলে তাদের আর ÿক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কিছু থাকে না। সেখানে তাদের চাকরি যদি বেসরকারি থেকে সরাসরি রাজস্ব খাতে নেওয়া হয় তা তাদের ন্যায্য প্রাপ্যতার থেকে অনেক বেশি। এরপরও যদি তারা বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ও পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া বিবিএস ক্যাডারভুক্ত হওয়ার দাবি করেন তা অন্যায্য আবদার ছাড়া আর কি হতে পারে? এটি সংবিধান, পিএসসি’র নিয়োগসংক্রান্ত প্রচলিত আইন, চাকরি বিধি, ও সামাজিক ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। সর্বোপরি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের অন্তরায়।

বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিতে, অনুচ্ছেদ ১১ তে বলা আছে “...মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে...”; অনুচ্ছেদ ২০ (১) উল্লেখ রয়েছে “প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী”-এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন। ” সরকারি নিয়োগলাভে সুযোগের সমতা বিষয়ে ২৯ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী “প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে। ” বেসরকারি কলেজশিক্ষকদের বর্তমান ব্যবস্থায় ক্যাডারভুক্ত করা হলে উপর্যুক্ত বিধানগুলো লঙ্ঘিত হয়। কেননা বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শিত হয়। ‘যোগ্যতানুসারে ও কর্মানুযায়ী’-নীতির ব্যত্যয় ঘটে, এবং সকল নাগরিকের সুযোগের সমতা বিনষ্ট হয়। কারণ, বিসিএস পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর যোগ্য সকলেরই আবেদনের সুযোগ থাকে এখানে সুযোগের সমতা বিনষ্ট হয় না। কিন্তু কোনোরূপ মানদণ্ড ছাড়াই যখন কোনো কলেজকে জাতীয়করণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয় তখন শুধুমাত্র ওই সকল বেসরকারি কলেজের শিক্ষকবৃন্দ নিরঙ্কুশভাবে আত্মীকরণের সুযোগ লাভ করে এবং অন্য সকলে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮১ অনুযায়ী ৪ (১) কমিশনের সুপারিশ ব্যতীত চাকরিতে সরাসরি নিয়োগ করা যাইবে না; ৪ (৩) কোনো চাকরিতে নিয়োগ করা যাইবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না; (এ) নিয়োগের জন্য বাছাইকৃত ব্যক্তির স্বাস্থ্য পরীক্ষার উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কর্তৃক গঠিত মেডিকেল বোর্ড এই মর্মে প্রত্যয়ন করেন যে, উক্ত ব্যক্তি স্বাস্থ্যগতভাবে অনুরূপ নিয়োগের জন্য যোগ্য এবং তিনি এইরূপ কোনো দৈহিক বৈকল্যে ভুগিতেছেন না, যাহা চাকরির দায়িত্ব পালনে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করিতে পারে; এবং (বি) এইরূপ বাছাইকৃত ব্যক্তির পূর্ব কার্যকলাপ যথাযোগ্য এজেন্সির মাধ্যমে তদন্ত না হইয়া থাকে ও তদন্তের ফলে দেখা না যায় যে, প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিযুক্তির জন্য তিনি অনুপযুক্ত নহেন। ৪ (৪) কোনো ব্যক্তিকে কোনো চাকরিতে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হইবে না, যদি তিনি-উক্ত চাকরির জন্য কমিশন কর্তৃক দরখাস্ত আহ্বানের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত ফিসহ যথাযথ ফরম ও নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে দরখাস্ত দাখিল না করেন; এবং (বি) সরকারি চাকরি বা অন্য কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষের চাকরিতে নিয়োজিত থাকাকালে স্বীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মাধ্যমে দরখাস্ত দাখিল না করেন। এত দিনে এ সকল সুস্পষ্ট বিধিবিধানকে পাশ কাটিয়ে, নানাভাবে ছাড় দিয়ে শিক্ষা ক্যাডারে আত্মীকরণ করা হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশ যেখানে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ও ভবিষ্যতের বিশ্বনাগরিক তৈরির জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ সেখানে এ অবস্থা কোনোভাবেই আর চলতে পরে না।

২৮৩টি কলেজে ১৮০০০ বেসরকারি শিক্ষক আত্তীকৃত হতে চায়, কলেজ প্রতি প্রায় ৬৪ জন। এর মধ্যে এমন কলেজও রয়েছে যেখানে পাবলিক পরীক্ষায় ৩-৪ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে অথচ সেখানে শিক্ষক আছেন ৫০-৬০ জন। ২০ বছর আগে জাতীয়করণ হয়েছে এমন অনেক কলেজ আছে যেখানে আজও নতুন পদ সৃষ্টি হয়নি ১৫-২০ জন শিক্ষক দিয়ে যেনতেনভাবে কার্যক্রম চলে। গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড ছাড়াই কলেজগুলোকে জাতীয়করণের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। অবকাঠামোগত দিক দিয়ে উন্নত, দীর্ঘকাল ধরে কর্মরত শিক্ষক রয়েছে, এবং বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে এমন কলেজগুলোকে বাদ দিয়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত, যেখানে অতিসম্প্রতি গণহারে নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে-এমন কলেজ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এখানে প্রতীয়মান হয় শিক্ষার্থী তথা জনস্বার্থকে বিবেচনায় না নিয়ে গোষ্ঠী স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

বিসিএস ক্যাডারে নিয়োগের আগে গোয়েন্দা সংস্থা, ও পুলিশি তদন্তের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ঢালাও আত্মীকরণের ক্ষেত্রে এটি করা হয় না। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিষয়ে বর্তমান সরকারের অবস্থানের সঙ্গে এরূপ ঢালাও আত্মীকরণ সাংঘর্ষিক। বেসরকারি কলেজে নিয়োগের ক্ষেত্রে যেহেতু প্রার্থীর পূর্ব কার্যকলাপ তদন্ত হয় না সেহেতু রাষ্ট্রবিরোধী কেউ সেখানে কর্মরত আছে কিনা তা যাচাই করাও সম্ভব হয় না। ঢালাওভাবে আত্মীকরণ করার সুযোগে রাষ্ট্রবিরোধী কারও রাষ্ট্রের কর্মে ঢুকে যেতে পারে। কেননা বিসিএস ক্যাডার বিধি অনুযায়ী যেকোনো ক্যাডার থেকে উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব বা সচিব পদে পদোন্নতির সুযোগ রয়েছে।

বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যরা আজ যে যৌক্তিক দাবি তুলেছে তা শুধুমাত্র ক্যাডারের মর্যাদা রক্ষার জন্য নয়। এর সঙ্গে জাতীয় স্বার্থও জড়িত। ২০৩০ সালের মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শিক্ষকদের গুরুত্ব যদি স্বীকার করা হয়, তাহলে অবশ্যই যোগ্য শিক্ষক নির্বাচনের জন্য সঠিক প্রক্রিয়ায় অনুসরণ করতে হবে। জনস্বার্থে কলেজ জাতীয়করণ করতে হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ কমিশন গঠন করা হোক। কমিশন প্রথমে আত্মীকরণের গ্রহণযোগ্য বিধিমালা এবং প্রতিষ্ঠান বাছাইকরণের মানদণ্ড নির্ধারণ করুক। এরপর উপযুক্ত কলেজ বাছাই করুক। প্রয়োজনে বয়সসীমা শিথিল করে জাতীয়করণকৃত কলেজের শিক্ষকদের বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। পিএসসির প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের অপরাপর বিধিবিধান প্রতিপালন সাপেক্ষে ক্যাডারে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। বিসিএস পরীক্ষা ছাড়া শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তি আর না।

মো. জাহিদুল ইসলাম: বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার সদস্য, সহকারী অধ্যাপক ও পিএইচডি গবেষক