চরমপন্থার কাছে আত্মসমর্পণ

নাজাম শেঠি
নাজাম শেঠি

গত দুই সপ্তাহে পাকিস্তানে যা হলো তাতে মানুষের মনে ভয় ঢুকেছে, এটা যেন তাদের ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে। একজন যন্ত্রণাক্লিষ্ট বিশ্লেষক লিখেছেন, ‘রাষ্ট্র একদল ধর্মীয় চরমপন্থীর সামনে অপমানজনকভাবে আত্মসমর্পণ করেছে। রাষ্ট্র এখানে আপস করেছে, এটা শুধু প্রশমিত করার ব্যাপার ছিল না, ছিল আত্মসমর্পণ।’ কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীকে সরকারের অনিচ্ছা সত্ত্বেও পদত্যাগ করতে হয়েছে। এই ধরনা (অবরোধ) বন্ধে যে ছয় দফা ঐকমত্য হলো, সেই আলোচনায় নেতৃত্ব দিয়েছে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, সরকার নয়। এরপর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সেই কাগজে সই করার আদেশ দেওয়া হয়।
আধা সামরিক বাহিনী পাকিস্তান রেঞ্জার্জের মহাপরিচালক প্রতিবাদকারীদের মধ্যে যেভাবে চেক বিতরণ করেছেন, তাতে মনে হয় ভালো ছেলে হিসেবে তাদের এটা দেওয়া হয়েছে। তেহরিক-ই-লাব্বাইক ইয়া রাসুল আল্লাহ (টিওয়াইএলআরএ) নামের দলটিও এই আন্দোলনে ছিল, দলটির নেতা খাদিম হোসেন রিজভি বলেছেন, সামরিক বাহিনীর নির্দেশে সবকিছু করা হয়েছে। আন্দোলনের সময় রিজভি দলীয় নেতাদের প্রকাশ্যে সেনা অভিযানের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন না হতে পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ, সেনাবাহিনী ‘আমাদের সঙ্গেই আছে’। নির্বাচিত সরকার যেহেতু জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, তাই সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র টুইট করেছেন, ‘সিওএএস (সেনাপ্রধান) প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছেন। সেনাপ্রধান শান্তিপূর্ণভাবে ধরনা মোকাবিলার পরামর্শ দিয়েছেন, কারণ সহিংসতা আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও ঐক্যের পক্ষে নয়।’
তবে এই ঘটনা যে রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্রের আত্মসমর্পণ, তা সবাই বিশ্বাস করে না। নওয়াজ শরিফ জানতে চান, ‘এই ধরনার পেছনে কারা আছে, কে এটার শর্ত নির্ধারণ করেছে?’ ব্যাপারটা ঠিকঠাক সামাল দিতে না পারার জন্য এবং সামরিক বাহিনীর হাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া ছেড়ে দেওয়ার জন্য তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধুয়ে দিয়েছেন। তাঁর সন্দেহ সত্ত্বেও অনেক প্রশ্নের উত্তরই জানা যায় না। কথা আরও আছে, কয়েক মাস আগে পাঞ্জাবের উপনির্বাচনে ওই তেহরিক-ই-লাব্বাইক ইয়া রাসুল আল্লাহ দলটি হঠাৎ করে জীবন পেল কী করে? শুধু তা-ই নয়, তারা নওয়াজের দল পিএমএলএনের ১০ হাজার ভোটই বা পেল কীভাবে? হজরত মুহাম্মদ (সা.) শেষ নবী এবং আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করার ব্যাপারটা তারা এত বড় ঘটনা বানাল কী করে? যখন সেই ১৯৭৪ সালে তাদের অমুসলিম ঘোষণা করা হয়েছিল? পাঞ্জাবের ভেতর দিয়ে এদের ছোট ছোট দলে যেতে দেওয়া হলো কেন? এরপর তারা ফয়েজাবাদে গিয়ে মারাত্মক ধরনা শুরু করল। ইসলামাবাদ হাইকোর্টই বা নিজেদের কর্তৃত্ব ফলাতে সরকারকে বলপ্রয়োগ ছাড়া এদের ছত্রভঙ্গ করার আদেশ দিল কী করে? অথচ গত বছর ইমরান খানের চার মাসব্যাপী আক্রমণাত্মক ধরনার সময় কোনো আদালতই যখন কিছু করল না, তখন সুপ্রিম কোর্টই বা কেন তাদের অনুসরণ করল? আর পাঞ্জাব সরকারের একজন মুখপাত্রই বা কেন সুনির্দিষ্টভাবে বললেন, তাঁর মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন? এর মধ্য দিয়ে কি শাহবাজের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধাচরণ না করার নীতি আবারও পরিষ্কার হয়ে গেল না?
যোগসাজশের নীতির ব্যাপারটা হলো সামরিক সরকার নওয়াজ শরিফের জায়গায় শাহবাজ শরিফকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। কারণ, নওয়াজ সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করেন, যেখানে শাহবাজ তাদের শাসনব্যবস্থায় ঢুকতে দিতে চান। এতে বোঝা যায়, সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রথমে ইমরান খান ও তাহিরুল কাদরিকে দিয়ে নওয়াজকে হটাতে চেয়েছে। কিন্তু যখন এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হলো তখন তারা পানামা পেপারসের ফাঁস-কাণ্ড ধরে যৌথ তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে এই কাজ করল। নওয়াজ শরিফকে এখনো মুছে ফেলা যাচ্ছে না। তিনি আশা করছেন, আগামী বছরের মার্চ মাসের সিনেট নির্বাচনে সংসদের উচ্চকক্ষও পিএমএলএনের হাতে যাবে এবং তারা সাধারণ নির্বাচনে সংসদেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। এর মধ্য দিয়ে নওয়াজ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সেই অযোগ্যতার ঘোষণা উল্টে দিতে পারবেন। সামরিক কর্তৃপক্ষ সে কারণে দুঃস্বপ্ন দেখছে, ফলে আগামী সিনেট নির্বাচনের আগে এই সরকারকে উৎখাতের প্রয়োজনীয়তা আবারও সৃষ্টি হয়েছে।
সে কারণে পিপিপিকে হুমকি দিয়ে প্রতিহত করা হয়েছে, যাতে তারা নওয়াজ শরিফকে বাঁচিয়ে দিতে না পারে। আগামী সাধারণ নির্বাচনের জন্য ইমরানকে ভোটার ধরতে বলা হয়েছে। মাওলানা সামি উল হকের সঙ্গে ইমরান খানের জোট গড়ে দেওয়া হয়েছে, পিএমএলএনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ তৈরি করতে এটা করা হয়েছে। এই সরকারকে অস্থিতিশীল করতে রিজভিকে রাস্তায় শক্তি দেখাতে উৎসাহিত করা হয়েছে। আর সর্বশেষ যে বাঁক পরিবর্তন ঘটল, সেখানে দেখা গেল যে সিয়াল শরিফের পীরদের উসকানি দেওয়া হলো যাতে তাঁরা পিএমএলএনের সংসদীয় দলের একটি অংশকে খণ্ডিত করতে পারেন। সামরিক বাহিনীর অপছন্দের ও নওয়াজ শরিফের অনুগত পাঞ্জাবের রানা সানাউল্লাহকেও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করতে বলা হয় তাঁদের। এই তত্ত্বের আলোকে বলতে হয়, রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্র চরমপন্থীদের কাছে সরকারের এই আত্মসমর্পণের কলকাঠি নেড়েছে। অন্য কথায়, এই ঘোড়সওয়ারেরা চরমপন্থীদের সামনে দুর্বল বা অসহায় হয়ে পড়েনি, নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই।
ফলে সত্যটা একদম সোজাসাপ্টা নয়, সামরিক বাহিনীর ষড়যন্ত্র ও পিএমএলএনের হোঁচট খেয়ে পথ চলার মধ্যে কোথাও তা লুকিয়ে আছে। আরও বড় সত্যটা হলো পাকিস্তানে মোল্লাদের ক্ষমতা দিনকে দিন বাড়ছে। সেই দিন হয়তো বেশি দূরে নয়, যখন তালেবানদের মতো এরাও তাদের প্রতিপালক, অর্থাৎ রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রকৃত অর্থেই দাঁড়িয়ে যাবে। আর তখন পাকিস্তানে নরক নেমে আসবে।
পাকিস্তানের ফ্রাইডে টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
নাজাম শেঠি: পাকিস্তানি সাংবাদিক।