নেপালের নির্বাচন জনগণের হাতেই: ড. আয়োধী প্রসাদ যাদব

নেপালের প্রধান নির্বাচন কমিশনার আয়োধী প্রসাদ যাদব একাধারে অর্থনীতির অধ্যাপক, গবেষক ও প্রশাসক। নির্বাচন কমিশনে যোগদানের আগে তিনি নাগরিক সমাজের নেতা, গবেষক, মানবাধিকার সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। ২৪ বছর অধ্যাপনা করেছেন কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১৩ সালের শুরুতে নেপালের অন্যতম নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১৬ সালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে শপথ নেন। এর আগের এক বছর ছিলেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান কমিশনার। নেপালের প্রাদেশিক ও জাতীয় প্রতিনিধি সভা নির্বাচনের পরদিনই, গত ২৭ নভেম্বর কাঠমান্ডুতে তাঁর কার্যালয়ে তিনি প্রথম আলোকে এই সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ

প্রথম আলো: নেপালে এ বছর তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ বছরই এত নির্বাচন কেন?

আয়োধী প্রসাদ যাদব: মূল কারণ হলো, নির্বাচিত সংবিধান সভার দ্বারা নেপালে নতুন সংবিধান কার্যকর করা হয়েছে। এর জন্য সংবিধান সভার প্রতিনিধি নির্বাচন করতে হয়েছে। এই প্রথম নেপালে নির্বাচিত সংবিধান সভার প্রতিনিধিদের দ্বারা সংবিধান প্রণয়ন ও কার্যকর করা হলো। সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্র পুনর্গঠন করার বাধ্যবাধকতা ছিল। আর তা অবশ্যই ২০১৮ সালের ২১ জানুয়ারির আগেই অনুষ্ঠিত হতে হবে। তা পূরণে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, প্রাদেশিক সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি নির্বাচন করা হচ্ছে। প্রতিটি নির্বাচন একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। স্থানীয় নির্বাচনে চেয়ারম্যান এবং মেয়র ও ভাইস মেয়র নির্বাচত হন। প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যরা প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করবেন। কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সভা থেকে নির্বাচিত হবেন নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী।

গত দুই দশকে নেপালে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়নি। নির্বাচন কমিশন এত সব চ্যালেঞ্জ হাতে নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই সব সম্পন্ন করছে। তাই এটা আমাদের নির্বাচনী উৎসবের বছর। ২০ বছর পর ১৮ দিনের মধ্যে আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচন শেষ করেছি। এর দুই মাস পর প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় নির্বাচন হচ্ছে। চিন্তা করা যায়?

প্রথম আলো: নেপালে এখন দুটি কর্তৃপক্ষ: নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে আপনি কি নির্বাচন আয়োজনের বেলায় কোনো টানাপোড়েন বা বাধার সামনে পড়েছেন?

আয়োধী প্রসাদ: এটা খুবই স্বাভাবিক যে নির্বাচনের সময় সংঘাত ও ভুল–বোঝাবুঝি হবে। কিন্তু আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার জায়গা থেকে দেখলে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে সম্পর্ক খুব ভালো। আমাদের আর্থিকসহ অন্য যা যা সাহায্য দরকার, তা পাচ্ছি। নিরাপত্তা পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ রাখায়ও সরকার সহযোগিতা করছে। ২০১৩ সালের সংবিধান সভা নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তৎকালীন দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি ছিলেন সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু নতুন সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিধান নেই। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার চালাবে। এবার এই সরকারে অংশ নিয়েছে চারটি প্রধান দল। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দল, মাওবাদী দল এবং আরপিপি ও আরপিপি (ডেমোক্রেটিক)। যদিও মাওবাদী মন্ত্রীরা দপ্তরহীন মন্ত্রী হিসেবে থাকছেন। কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউএমএল) থাকছে বিরোধী দলে। সবার সঙ্গে কথা বলেই নিরপেক্ষভাবে আমরা কাজ করছি।

প্রথম আলো: স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটদানের হার ছিল ৭৫ শতাংশ। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বলছে, এবারের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রথম দফায় ভোট দিয়েছেন ৬৫ শতাংশ। কম ভোট পড়ার কারণ কী?

আয়োধী প্রসাদ: ৬৫ শতাংশও কিন্তু খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। ভোট কিছু কম পড়ার প্রধান কারণ হলো প্রতিকূল আবহাওয়া এবং ভৌগোলিক অবস্থা। পাহাড়ি অঞ্চলে এখন খুব শীত পড়েছে। ভোটকেন্দ্রগুলো অনেক দূরে দূরে অবস্থিত। এ রকম কঠিন শীতে অনেকের পক্ষেই দূর-দূরান্তের ভোটকেন্দ্রে আসা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়ত, অনেকেই কাজের সন্ধানে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে চলে গেছেন। এটাও একটা কারণ।

প্রথম আলো: নিয়ম অনুসারে প্রথম দফা ভোটের ব্যালট বাক্সগুলো খোলা ও গণনা করা হবে ৭ ডিসেম্বর দ্বিতীয় পর্বের ভোট গ্রহণের পর। দূর-দূরান্তের এবং প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশে ব্যালট বাক্সগুলো ১০ দিন নিরাপদ থাকবে কী করে?

আয়োধী প্রসাদ: সব ব্যালট বাক্স সংগ্রহ করে জেলা সদরে ওই জেলার প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তার হেফাজতে নিরাপদে রাখা হচ্ছে। এসবের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা রাজধানী ও জেলা পর্যায়ে রাজনৈতিক সমঝোতা ও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি যে কেউ কোনো ব
্যাঘাত ঘটাবে না। সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো ও নিরাপত্তা বাহিনী যৌথভাবে পাহারা দিচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের জন্য এবার বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, সব সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছে। এ জন্যই সবার সহযোগিতায় ব্যালট বাক্সের নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা আত্মবিশ্বাসী।

প্রথম আলো: কিন্তু অনেকে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে সংঘাতের আশঙ্কা করছেন।

আয়োধী প্রসাদ: স্থানীয় নির্বাচনও দুই দফায় অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু কোনো সহিংসতা, মারামারি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই—এসব কিছুই হয়নি। জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনের প্রথম দফাও সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। চূড়ান্ত পর্যায়েও তেমনটাই হবে।

প্রথম আলো: কিন্তু গত এক সপ্তাহে ৩০টিরও বেশি জায়গায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

আয়োধী প্রসাদ: কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক গোষ্ঠী কিছু কিছু জায়গায় হুমকি সৃষ্টি করতে চাইছে। কিন্তু আমাদের নির্বাচনী আয়োজন কিংবা নির্বাচনী কর্মকর্তা, ভোটার কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোকে বাধাগ্রস্ত করার ক্ষমতা তাদের নেই। তাদের এসব কার্যকলাপের পরও কিন্তু ৬৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। ২০০৮ ও ২০১৩ সালে নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভয়ানক খারাপ ছিল। তার থেকে এখনকার অবস্থা অনেক ভালো। সবচেয়ে বড় কথা, ভোটাররা নির্বাচনের মালিকানা হাতে নিয়েছেন। একে ব্যাহত করা কারও পক্ষে সম্ভব হবে না।

প্রথম আলো: আপনার দায়িত্বের মেয়াদে কতটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে?

আয়োধী প্রসাদ: আমি ১১ বছর ধরে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে কাজ করছি। ২০০৮ ও ২০১৩ সালের দুটি জাতীয় নির্বাচন করেছি কমিশনার হিসেবে এবং এবার থাকছি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বে। আমি বলব, এবারের স্থানীয়, জাতীয় ও কেন্দ্রীয় নির্বাচন আগের সব নির্বাচনের চেয়ে অনেক বেশি সফল। আমার ও আমার সহকর্মীদের জন্য এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে শেষ করায় আমরা বদ্ধপরিকর।

প্রথম আলো: অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক দলগুলো মাফিয়া, কালোটাকার মালিক ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দিয়েছে। নির্বাচনী ব্যয়ও আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?

আয়োধী প্রসাদ: রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে তাদের প্রার্থী হিসেবে কাদের মনোনয়ন দেবে, সেটা তাদের বিষয়। কিন্তু সেটা অবশ্যই আইনি বাধ্যবাধকতা ও সংবিধানের নির্দেশিত শর্তেই হতে হবে। গণতন্ত্রে এ ধরনের অভিযোগ ওঠে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রার্থীদের একেবারে আটকে দেওয়া সম্ভব হয় না। তখন জনগণের ওপর দায়িত্ব বর্তায় তাঁদের ভোট না দেওয়ার। আমাদের প্রধান দায়িত্ব হলো নিরপেক্ষ, মুক্ত ও নিরাপদভাবে নির্বাচনের আয়োজন করা। এবার আমরা দুর্নীতির অভিযোগে দুজন প্রভাবশালী প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করেছি।

প্রথম আলো: নেপালের নির্বাচন কমিশনের ৬৬টি বছরের ইতিহাসের অর্জন সম্পর্কে বলুন।

আয়োধী প্রসাদ: ১৯৫০ সাল থেকে নেপালি জনগণ সংবিধান সভা ও সংসদীয় গণতন্ত্রের অধীনে নির্বাচনের দাবি করে আসছে। ১৯৫১ সালে নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠিত হলেও নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে এবারই প্রথম সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে নেপাল রাজতান্ত্রিক, কেন্দ্রীভূত ও হিন্দু রাষ্ট্র থেকে প্রজাতান্ত্রিক, ফেডারেল ও সেক্যুলার রাষ্ট্রে পরিণত হলো। এই দীর্ঘ যাত্রায় অনেক প্রাণহানি হয়েছে, জনগণ অনেক দুর্ভোগ সয়েছে। রাজারা বারবার জনগণের আকাঙ্ক্ষা দমন করেছেন। নেপালের জনগণ এবার তাদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের সুযোগ পেল। এটাই নিয়মিত নির্বাচনের শুরু। এটাই সবচেয়ে উজ্জ্বল বিষয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, তারা পূর্ণ মেয়াদে দেশ পরিচালনা করবে, এই আশা করি।

প্রথম আলো: নেপালি জনগণ সম্পর্কে কিছু বলুন।

আয়োধী প্রসাদ: নেপাল অনেক জাতি-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ে বিভক্ত। এত বৈচিত্র্য সত্ত্বেও জনগণ ঐক্যবদ্ধ। আমাদের জনগণ তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে খুবই সজাগ। এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা যাচ্ছে, কারণ নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের আস্থা অগাধ। আমার প্রতিও তারা আস্থাশীল। গত তিন মাসে প্রতিদিন সকালে টিভি ও রেডিওর মাধ্যমে আমার বার্তা জনগণের কাছে গেছে। সেটা রাজনৈতিক দলগুলো, প্রার্থী ও ভোটারদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে বলে আমার বিশ্বাস। রাজনৈতিক দলগুলোও বিবাদ বন্ধ করে সংবিধান রচনা, গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়া এবং নির্বাচন সুষ্ঠু করায় একযোগে কাজ করছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার জন্য তাদেরও ধন্যবাদ জানাতে হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আয়োধী প্রসাদ: ধন্যবাদ।