অগ্রহায়ণেও গ্রাম ভাঙছে

গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্রের বালাসী খেয়াঘাট
গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্রের বালাসী খেয়াঘাট

বড় বন্যা মানেই বড় তোলপাড়, চরের ভাঙা-গড়া। মরা কার্তিকের পর থেকেই নদী শান্ত হতে থাকে—অগ্রহায়ণে প্রায় নিথর হয়ে যায়। পুরোনো ধারা বা চ্যানেল কোনো সময় সঞ্জীবিত হয়, কখনো মরণদশা থেকে জেগে ওঠে। আবার কোনো বলশালী ধারা হারিয়ে যায় ধুধু চরের নিচে। বিআইডব্লিউটিএর কর্মীরা গলদঘর্ম হন নৌচলাচলের নতুন পথের নকশা তৈরিতে। অগ্রহায়ণ থেকে চৈত্র পর্যন্ত বারবার মাপতে হয় জলপথের গভীরতা আর সরাতে হয় নির্দেশিকার ফলক। চৈত্র মাসের শেষে নদী আবার জেগে ওঠার আগে তার পাড় ভাঙার খেলা মুলতবি থাকে। অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুনে নদীর পারের মানুষেরা কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকে। রবি ফসলের চাষবাস আর ফসল তোলায় মন দেয়।

কিন্তু এবার সে রকম ঘটছে না ব্রহ্মপুত্রের গাইবান্ধা অঞ্চলে। এই ভরা অগ্রহায়ণে ভাঙছে গ্রাম, ভাঙছে খেতখামার, নদীর পাড়। মানুষ দিশা পাচ্ছে না। চর খাড়জানি ভাঙছে দুদিক থেকে। খাড়জানি সাতকাঠা এখন মাকড়সার পেটের আকৃতি নিয়েছে। সাতকাঠায় তৈরি আদর্শ গ্রাম (গুচ্ছগ্রাম) এখন নদীর কিনারে। কুন্দেরপাড়ার মানুষের চোখে ঘুম নেই। অগ্রহায়ণ মাসে এমন ‘খাড়া’ স্রোত আর পাক কখনো দেখেনি তারা।

ব্রহ্মপুত্রের বুকে ছড়ানো-ছিটানো হাজার চরের একমাত্র হাইস্কুল কুন্দেরপাড়া স্কুলে পৌঁছাতে নদীর ঘাট থেকে শীতের সময় এক মাইল আর বর্ষায় আধা মাইলের একটু কম হাঁটতে হতো। এখন সেখানে হাঁটাহাঁটির বালাই নেই। এই শীতে হয়তো টিকে যাবে কিন্তু আগামী বর্ষাপূর্ব ভাঙনের ধকল সে সহ্য করতে পারবে কি না, কে জানে। এই স্কুলে প্রথম লেখাপড়া শুরু করে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসছে ছেলেমেয়েরা। উত্তরবঙ্গের নানা বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজে তারা পাঠ গ্রহণে এগিয়ে আছে। কুন্দেরপাড়ার মানুষদের এখন রাতদিনের চিন্তা স্কুলটাকে কীভাবে বাঁচানো যায়। তাদের ধারণা, ষাট-সত্তর হাজার টাকা জোগাড় হলেই স্বেচ্ছাশ্রমে তারা ভাঙন ঠেকাতে পারবে। শিগগির তারা চরে চরে গিয়ে সভা করে মানুষকে এককাট্টা করবে। একটা গরুর দামের টাকায় একটা আস্ত স্কুল বেঁচে যাবে। বাঁচবে এক হাজার প্রান্তিক পরিবার। কিন্তু সেই টাকা জোগাড়ের পথ তাদের জানা নেই। শ্রম দিতে রাজি কিন্তু হাতে যে কানাকড়িও নেই। এবারের বন্যার পর এখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি তারা।

নদী কেন ভাঙছে এই অসময়ে?
এই প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে একটা ধারণা ছিল। এবারের বন্যায় গাইবান্ধার বালাসী ঘাটে জলের উচ্চতা সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। মানুষ চূড়ান্ত বন্যার ভয়ে দোয়া-দরুদ পড়তে থাকে; ঢাকা শহরের অনেক নাগরিক দেশের নানা মফস্বল আর গো-গ্রামে থাকা বৃদ্ধ মা-বাবাকে ঢাকায় নিয়ে আসবে কি না, সে চিন্তায় টিভি দেখা ছেড়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত ঢাকায় আর পানি ওঠে না, এমনকি পূর্ব ঢাকাও শুকনো থেকে যায়। এটা ছিল খুবই রহস্যময়, কিন্তু পানির মতো পরিষ্কার একটা ঘটনা। এরেন্ডাবাড়ী (বাহাদুরাবাদ ইউনিয়ন, দেওয়ানগঞ্জ), পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের মুখ বন্ধ হয়ে যায় কয়েক বছর আগেই। রৌমারী, চিলমারী, রাজীবপুর দিয়ে ছুটে আসা ব্রহ্মপুত্রের জল এরেন্ডাবাড়ীতে এসে আরও দুর্ভোগ হচ্ছে না, পুরোটাই চলে যাচ্ছে গাইবান্ধা অংশে। দুই পারের জল এক প্রবাহে এলে জলের উচ্চতা তো বাড়বেই। কুন্দেরপাড়ার মানুষেরও সে রকম ধারণা। দুই নদীর পানি এখন এক নদী দিয়ে চলছে তাই নদীর এত ধার, এত ভাঙন। এরেন্ডাবাড়ীর নদীমুখটা খনন করে দিলে গাইবান্ধার দুর্ভোগ কমবে। ময়মনসিংহও পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের কল্যাণে দুফোঁটা জল পাবে।

হারিয়ে যাচ্ছে ছাত্রছাত্রী
ভাঙা-গড়ার এই মারাত্মক খেলার প্রথম শিকার হচ্ছে স্কুলের শিক্ষার্থীরা। তারা ঝরে পড়ছে শিউলি-বকুলের মতো। কুন্দেরপাড়া হাইস্কুলের পাঁচ শ শিক্ষার্থীর মধ্যে বন্যার পর ১৪০ জন আর ফিরে আসেনি। জুনিয়র ফাইনাল আর স্কুল ফাইনালের জন্য এই দুই শ্রেণিতে ঝরে পড়ার সংখ্যা কম হলেও ষষ্ঠ, সপ্তম আর নবম শ্রেণিতে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী চলে গেছে। বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েশিক্ষার্থীরাও ঝরে পড়ার তালিকায় আছে।
শিশু সুরক্ষার সমীকরণ নিয়ে যারা বন্যাত্রাণে নেমেছিল, তাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়ার কথা সব শিশুকে স্কুলে ফিরিয়ে আনা। স্পষ্টতই সেটা হয়নি। কেন হয়নি? খাদ ছিল কোথায়? কী বলবে শিশুদের জন্য বড় বড় তহবিলের মালিক নীল পতাকার মালিক আর তাদের দেশি সহযোগীরা। কী জবাব সরকারের?

ত্রাণ-ক্ষতিপূরণের অপেক্ষায় কেউ কি থাকে?
হাফিজার (ছদ্মনাম) বাবা খেতে কাজ করার সময় বজ্রপাতে মারা যায়। সে এখন ভাইয়ের সঙ্গে চায়ের দোকান চালাচ্ছে। এবার পিএসসি দিয়েছে। দশ-এগারো বছরের একরত্তি মেয়ে কোথায় এত শক্তি পায়। সে নিশ্চিত পরীক্ষার ফলাফল ভালো হবে। তারপর হাইস্কুলে যাবে। সেটাই তার স্বপ্ন। কুন্দেরপাড়া হাইস্কুল তার চায়ের দোকানের পাশেই। কিন্তু স্কুলটা যদি ভেঙে যায়? তখন তো সবই ভেঙে যাবে। হাফিজা বলে, ‘তবে আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব।’ কী চেষ্টা চালাবে সে? এরেন্ডাবাড়ীর নদীমুখে দুই কোদাল বালু কেটে দিলে হাফিজাদের বাড়ি, দোকান, স্কুল, ভবিষ্যৎ সবই রক্ষা পায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড, ঘুমিয়ে থাকা নদী কমিশন, জেলা-উপজেলা প্রশাসন বিষয়টা ভেবে দেখতে পারে। বজ্রপাতের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার রেওয়াজ চালু হলেও হাফিজা বা তার ভাই সেটা পায়নি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেটার বিহিত করবেন জেনে ভালো লাগল।
প্রশাসনে অনেক মানুষ আছেন যাঁরা কাজ করতে চান, মানুষের পাশে থাকতে চান। কিন্তু তাঁদের কাছে পৌঁছানোর কোনো সহজ রাস্তা হাফিজাদের নেই। কী হয় যদি চরের মানুষ একদিন দূরসংযোগের মাধ্যমে প্রশাসনের আগ্রহী মানুষদের সঙ্গে তাদের কাজকর্মের কথা নিয়ে পড়াশোনা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলার সুযোগ পায়? এটা ডিজিটাল বাংলাদেশ?

করপোরেট রেসপন্সিবিলিটি না সাইনবোর্ড চর্চা
কুন্দেরপাড়া স্কুলটি বছর তিনেক আগে ঝড়ে ভেঙে যায়। তারপর চাঁদা তুলে সেটা দাঁড় করানো হয়। বছর না ঘুরতেই আগুন লাগিয়ে দেয় কারা যেন। ছেলেমেয়েদের সে কী কান্না। কাগজে কাগজে ছড়িয়ে পড়ে সে খবর। অনেক মানুষ এগিয়ে আসে; একটা বেসরকারি ব্যাংক ঘোষণা দিয়ে বসে, আমাদের
‘ম্যালা টেকা’; আমরা করে দেব তোমাদের স্কুল। করপোরেট রেসপন্সিবিলিটি খেয়ে ফেলে গ্রামের উদ্যোগ। যত সুন্দর করে তারা তাদের ফলকটার দেয়াল আর শ্বেতপাথর বসিয়েছে, সেই তুলনায় স্কুলঘরের প্রতি যত্নের ছাপা কম। টিনের চালের পানি ঘরের ভিটেয় এসে পড়ছে। এটা ভিক্ষা নয়, করপোরেটওয়ালাদের দায়িত্ব। মাঝে মাঝে দিল দিয়ে অন্তর দিয়ে দেখতে হয়।

বন্যা হবে, নদী গোছাবে তার চলার পথ। নদীকে বুঝে নদীর সঙ্গে আমাদের বসবাস করতে হবে। নদীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। মাঝে মাঝে নদীর সঙ্গেও সমঝোতা করতে হয়। তাকে বিকল্প পথ দিতে হয়। নদীরও বিবেচনা আছে। নদীর সঙ্গে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুললে, তাকে শান্তির সঙ্গে সাগরে মেলার সুযোগ দিলে মানুষও বাঁচে, নদীও চলে।

গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী। শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।