'নিখোঁজ চার মেয়েকে এখনো খুঁজছি'

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

আনোয়ারা বেগমের হাতে একটা নিবন্ধন কার্ড। তাতে তাঁর বয়স লেখা ৩৫। পবিত্র ঈদুল আজহার সপ্তাহখানেক পর অনেক 

ঝুঁকি নিয়ে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে চলে এসেছেন। রাখাইন রাজ্যের মংডুর পাশে মেরুল্লা গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন
তাঁরা। চার মেয়ে ও এক ছেলে। ওরা নিখোঁজ। কে কোথায়, জানেন না। পরিবারের অন্য সদস্যদেরও কোনো খোঁজ নেই। তিন ও চার বছর বয়সের দুই নাতিকে নিয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন টেকনাফের শামলাপুর ক্যাম্পে। এটা প্রথমদিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা একটা ক্যাম্প। পরে সেনাসদস্যদের ব্যবস্থাপনায় সেখানে ত্রাণ বিতরণের ব্যবস্থা হয়েছে। সুশৃঙ্খলভাবে সবকিছু চলছে।

‘হারানো চার মেয়েকে এখনো খুঁজছি’, বললেন আনোয়ারা বেগম। শুনেছেন, এক মেয়ে নাকি কুতুপালং আশ্রয়শিবিরে আছে। কিন্তু কোনো যোগাযোগ হয়নি।

এ রকম আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। নুরজাহান, নুর আলম, শিশু মরিয়ম বিবি। তঁারা আতঙ্কে আছেন। তাঁদের সবার কথা প্রায় একই রকম। রাখাইন রাজ্যে সে দেশের সেনারা তাঁদের গ্রামের লোকজনকে নির্বিচারে গুলি করে মেরেছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। বললাম, কবে যাবেন ফিরে। একটা আলোচনা তো চলছে। তাঁরা এসব কথা বিশ্বাস করেন না। বলেন, ‘আমরা কোথায় যাব? আমাদের ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পত্তি, এমনকি জমির ফসল পর্যন্ত জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। দেখামাত্র গুলি করে। সেখানে আমরা যাব?’

‘তবে যদি সবাই বলে, আর আমাদের স্বজনেরা সবাই যেতে চায়, তাহলে একসঙ্গে যাব। কিন্তু জীবনের নিশ্চয়তা চাই। আর তা ছাড়া আমরা কী খেয়ে বাঁচব, তারও ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আমাদের হারানো সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতে হবে।’ এখানেই রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীদের নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা। বিরাট চ্যালেঞ্জ। আমরা কত দিন তাদের এখানে রিলিফ খাইয়ে রাখতে পারব?

আমাদের সঙ্গে ছিলেন রেজা ভাই। তিনি কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক। আরও ছিলেন আমাদের কক্সবাজার নিজস্ব প্রতিবেদক আব্দুল কুদ্দুস। আমরা বলছিলাম শুধু খাওয়া আর থাকা তো নয়। তাদের যদি এখানে বেশ কিছুদিন থাকতেই হয়, তাহলে তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি—সব ব্যবস্থা করতে হবে। আগের দিন আমরা কুতুপালং আশ্রয়শিবিরে দেখেছি ইউনিসেফের উদ্যোগে বাচ্চাদের একটা স্কুল চলছে। তিন শিফটে পড়ানো হয়। উখিয়ার তিনজন শিক্ষক রয়েছেন। আপাতত ইংরেজি, গণিত ও আরবি শেখানো হচ্ছে। শিশুরা উৎসাহ নিয়ে পড়ছে।

কোস্ট ট্রাস্টের উদ্যোগে সেখানে একটি স্বাস্থ্য ক্যাম্প পরিচালিত হচ্ছে। মালয়েশিয়া থেকে এসেছেন কয়েকজন চিকিৎসক। তাঁরা রোগী দেখছেন। আতঙ্কগ্রস্ত রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। দিনে প্রায় ২০০ রোগী তাঁরা দেখছেন। ওষুধ দিচ্ছেন। কোস্ট ট্রাস্ট উখিয়ায় তাদের জন্য একটি হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে।

রোহিঙ্গারা কিন্তু চিকিৎসার ব্যাপারটা ভালো বোঝে না। এত দিন তারা দেখে এসেছে, অসুখ হলেই কেবল ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। কিন্তু রোগ প্রতিরোধক টিকা যে নিতে হয়, এটা তাদের বোঝানোই মুশকিল। বলেন, ‘অসুখ নেই, তাহলে টিকা নেব কেন?’ রাখাইন রাজ্যে তাদের টিকার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। চিকিৎসার সুযোগ ছিল সীমিত। তবে তারা কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির কিছু ব্যবহার জানত। তাদের অস্থায়ী ছাপরার চালায় দেখেছি ছোট আকারের সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল। রাতে ঘরে একটা বাতি জ্বলে। আর মোবাইলের ব্যাটারি চার্জ দেওয়া যায়। নিজ দেশ থেকে উচ্ছেদ হয়ে আসার সময় ওই সৌরবিদ্যুৎ প্যানেলটি অনেকেই নিয়ে এসেছে।

ওদিকে পাহাড় কেটে সাফ। গাছপালা সাফ। কোস্টপ্রধান বললেন, তাঁরা এখন পরিবেশবান্ধব বন্ধুচুলা ও ধানের তুষের তৈরি জ্বালানি সরবরাহের উদ্যোগ নিচ্ছেন। প্রকৃতি সুরক্ষায় এটা দরকার। আর যেন গাছপালা কেউ না কাটে।

কিন্তু তারা কত দিন এখানে থাকবে? কত দিন আমরা তাঁদের আশ্রয় দিয়ে রাখতে পারব? বিদেশি এনজিও আসছে। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা থেকে মূল অফিসের বড় কর্মকর্তারা প্রতিদিন দলে দলে আসছেন। বিদেশিদের পদচারণে কক্সবাজার এখন মুখর। তাঁরা ভাবছেন। চেষ্টা করছেন। সরকারের সহযোগিতায় তাঁরা এগিয়ে আসছেন।

এলাকার লোকজন বলছেন, তাঁদের আসা-যাওয়ায় ইতিমধ্যে ভাটা পড়তে দেখা যাচ্ছে। প্রাথমিক ধাক্কাটা কমে এলে  উদ্যোগেও ভাটা পড়বে। তখন কী হবে?

৪ ডিসেম্বর টেকনাফের শামলাপুর ক্যাম্প থেকে ফেরার সময় দুই কিশোরী ছাত্রীর সঙ্গে কথা হলো। জিজ্ঞেস করলাম, এই যে রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীরা এখানে থাকছে, তোমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে? তোমরা কি চাও ওরা ফিরে যাক?

ওরা হাসছে। কোনো উত্তর নেই।

ইতিমধ্যে তাদের চারপাশে আশ্রয়শিবিরের বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ ভিড় জমিয়েছেন। তাঁদের একজন একটু উঁচু গলায় বললেন, ‘বলো না যে তোমরা আমাদের ওপর বিরক্ত না, বরং সাহায্য করতে চাও? বলো না কেন যে আমরা না বাঁচলে তোমরাও বাঁচবে না, অন্তত তোমাদের মানবিকতার মৃত্যু হবে?’

এটা কিন্তু একটা সাংঘাতিক কথা। রোহিঙ্গারা না বাঁচলে তো আমরাও বাঁচব না। ওরা মরবে রোগ-শোক, ক্ষুধা-যন্ত্রণায় আর আমরা মরব মানবিকতার প্রতি নির্বিকার থাকার কারণে।

সবাই মিলে কীভাবে বাঁচা যায়, তার একটা সমাধান খুব দ্রুত দরকার। এখানে বিশ্বের সব দেশের দায়িত্ব আছে। বড় ভূমিকা পালন করতে হবে জাতিসংঘকে। আমরা নিশ্চিত, শিগগিরই একটা সম্মানজনক, স্থায়ী সমাধান হবে।

আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।