রোবটের পৃথিবীতে যে উত্তর এখনো অজানা

প্রযুক্তি ব্যবহারকারী মানুষ কি প্রাযুক্তিক বিপ্লবের ধাক্কা সামলাতে প্রস্তুত?
প্রযুক্তি ব্যবহারকারী মানুষ কি প্রাযুক্তিক বিপ্লবের ধাক্কা সামলাতে প্রস্তুত?

সোফিয়া নামে একটি রোবটের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে ভবিষ্যৎ দুনিয়ায় রোবটের উপস্থিতির ধরন নিয়ে যেমন আগ্রহ তৈরি হয়েছে, তেমনি উদ্বেগও লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশেও রোবটকেন্দ্রিক আলোচনার সূত্রপাত ঘটেছে ঢাকায় খাবারের দোকানে রোবটের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর। তবে ভবিষ্যৎ দুনিয়ায় প্রযুক্তির কল্যাণে আরও চমক ও অনিশ্চয়তা আসবে। রোবটের আলোচনা তাই সামগ্রিকভাবে মানবসভ্যতায় প্রযুক্তির ব্যবহারের আলোচনা।

মার্কিন ভবিষ্যদ্বাদী লেখক অ্যালভিন টফলারের ১৯৭০ সালের বই ‘ফিউচার শকে’ করা ভবিষ্যদ্বাণী বর্তমান দুনিয়ার সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়। যেমন: ইন্টারনেটের বিস্তার, বিশ্বায়িত অর্থনীতি, কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের বদলে অনানুষ্ঠানিক কোম্পানি এবং প্রযুক্তি বিষয়ে বৃহত্তর সামাজিক ধাঁধা ও উদ্বেগের ভবিষ্যদ্বাণী তিনি করেছিলেন। তাঁর মতে, মানুষ ও প্রযুক্তির ক্রমবিকাশমান সম্পর্কই নির্ধারণ করবে সমাজ ও অর্থনীতির অগ্রগতি।

নতুন এই পৃথিবীতে প্রবেশের আগে বেশ কিছু অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। শুধু বাংলাদেশই নয়, সারা বিশ্বই এসব অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হবে।

প্রথম অনিশ্চয়তা ইন্টারনেটের বিস্তৃতির ব্যাপারে। এ ব্যাপারে সবাই একমত যে পরবর্তী প্রজন্মে হয় ‘সবখানে’, নতুবা ‘প্রায় সবখানে’ ইন্টারনেটের উপস্থিতি থাকবে। বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন, ইন্টারনেট বিদ্যুতের মতো হয়ে যাবে—কম দৃশ্যমান হলেও মানুষের সব কাজেই তা গভীরভাবে প্রোথিত থাকবে। এমনকি যাদের অক্ষরজ্ঞান নেই, তারাও কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে ডিজিটাল দ্রব্যাদি ও অ্যাপস ব্যবহার করবে। এর ফলে জ্ঞান ও শিক্ষণের এক অভূতপূর্ব বিস্তৃতি ঘটবে।

ফলে নতুন সম্ভাবনা যেমন তৈরি হবে, তেমনি অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপন্নতাও বাড়বে। অবস্থা এমন দাঁড়াবে যে সমস্যা সমাধানের পথ কারোরই জানা থাকবে না। যাদের স্বার্থ আছে, তারা খারাপ উদ্দেশ্যে বহুদূরে বসেই ব্যাপক আকারে সামাজিক ভাঙন তৈরি করতে পারবে। এর ফলে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে আমাদের। এই ধরনের জটিল ব্যবস্থার আতিশয্য কতটুকু হবে? কীভাবে এর প্রতিকার করা হবে এবং কে করবে? কীভাবে দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির ধারণা পুনঃসংজ্ঞায়িত করা হবে? কারণ, সমস্যাগুলো বৈশ্বিক। আক্রমণও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।


দ্বিতীয় অনিশ্চয়তা কর্মসংস্থান নিয়ে। রোবট নিয়ে যেসব উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো মানুষের কর্মসংস্থান নিয়ে। ম্যাককেনজি গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে ৮০ কোটি চাকরি যাবে রোবটের হাতে। প্রযুক্তি বহুল আকারে মানবশ্রম অপ্রয়োজনীয় করে তুলবে। তার চেয়ে বেশি কর্মসংস্থান প্রযুক্তির কল্যাণে সৃষ্টি হবে কি না, সে বিষয়ে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। যন্ত্রের অগ্রগতি হবে, এটা স্পষ্ট। তবে এর ফলে মানুষের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা পরিষ্কার নয়।

কীভাবে শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধিবিষয়ক প্রশিক্ষণগুলোর বর্তমান ব্যবস্থা নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেবে, তা এখন থেকেই ভাবতে হবে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নও করা হচ্ছে। এইটুকু মানিয়ে নেওয়া যথেষ্ট কি না, তা নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ অর্থনীতিতে মেধাকে কীভাবে মূল্যায়ন করা হয়, তার ওপর। সুতরাং, অনিশ্চয়তা থাকছেই।

পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশেষজ্ঞরা জোর দিচ্ছেন সেসব শিক্ষাদান পদ্ধতির ওপর, যেখানে জীবনব্যাপী শিক্ষা নেওয়ার কর্মসূচি আছে। সেখানে বিশেষজ্ঞরা এ-ও বলেন, নির্দিষ্ট মানবিক মেধা, যেমন: সামাজিক ও আবেগপ্রবণ বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীলতা, সমবায় কার্যক্রম ও জটিল যোগাযোগ দক্ষতাও যন্ত্র নকল করতে পারবে। পৃথিবীব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এসব বিষয়ের সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে নেবে, তা এখন বড় প্রশ্ন।

তৃতীয় অনিশ্চয়তা হলো আস্থা ও সত্যতা বিষয়ে। আস্থা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বন্ধনের এজেন্ট। আস্থা ও কল্যাণের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। দুটোর যোগসূত্রও সুপ্রতিষ্ঠিত। আস্থা না থাকলে সহিংসতা, বিশৃঙ্খলা ও ঝুঁকি এড়ানোর পথ বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ সব ধরনের সামাজিক দুর্দশা এসে হাজির হয়। যেভাবে মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে, তাতে আস্থাকে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। আমরা দেখছি যে ভুয়া খবর গভীর মানবিক প্রবৃত্তিগুলোয় জেঁকে বসতে পারে সহজেই। যেসব সুবিধা, আরাম ও তথ্য মানুষের নিজের বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে, সেগুলোই মানুষ আঁকড়ে ধরে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো নতুন প্রযুক্তি উপাদানগুলো মানুষের যেসব পছন্দ সুবিধাজনক, সেগুলোকে চিহ্নিত করে লক্ষ্যবস্তু বানায়। এরপর মানুষ তা স্বীয় স্বার্থে ব্যবহার করে। ফলে মানুষ হয় আরও বিপন্ন।

চতুর্থ অনিশ্চয়তা রয়েছে নতুন সমস্যা মোকাবিলা করার সামাজিক ও সাংগঠনিক উদ্ভাবন বিষয়ে। প্রযুক্তির এসব ক্রিয়ার ফলে মানুষ বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধ্য হবে। ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে সামষ্টিক পদক্ষেপ ও শক্তির একটা প্রাথমিক চেহারা আমরা দেখছি। জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া ও অন্যদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে। সমস্যা মোকাবিলায় আরও নতুন নতুন পদ্ধতি বের করতে হবে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ দুই ধরনের বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলার জন্যই প্রস্তুত হতে হবে।

নতুন আইন ও আদালত বিষয়ে দ্বন্দ্ব অনিবার্য। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আলোচনা করে থাকেন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কোন তথ্যের মালিক কে হবে, কে তা ব্যবহার করবে, কে মুনাফা পাবে, কখনো কোনো তথ্য-প্রক্রিয়ায় ঝামেলা তৈরি হলে কে দায়ী হবে (যেমন যে গাড়ি নিজে নিজে চালিত হবে, তা দুর্ঘটনা ঘটাল বা দুর্ঘটনার শিকার হলো), নজরদারি ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার মধ্যে কতটুকু ফারাক রাখতে হবে, কারও চাকরি বা বিমার অবস্থা যাচাই করার সময় কোন কোন তথ্য বৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে, যেসব অ্যালগরিদম ব্যবহার করে সমাজের ঘটনাগুলো নির্ধারণ করা হবে সেগুলো কে তত্ত্বাবধান করবে—এমন জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের হতে হবে।

বলা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এমন অনেক প্রাযুক্তিক পরিবর্তন পৃথিবীব্যাপী ঘটবে। বিশ্বব্যাপী তার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এর সব কটি বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য না হলেও বেশির ভাগই আমাদের সমাজে ঘটবে। ডিজিটাল পৃথিবীতে সত্যিকার অর্থেই ডিজিটাল হতে হলে শুধু প্রযুক্তির বিস্তার ঘটালেই চলবে না। এসব প্রশ্ন নিয়েও আমাদের এখন থেকেই ভাবনা শুরু করতে হবে।

খলিলউল্লাহ্‌: সহকারী সম্পাদক, প্রতিচিন্তা
ই-মেইল: [email protected]