ট্রাম, হাতে টানা রিকশা হারিয়ে যাচ্ছে?

কলকাতা পৌর কর্তৃপক্ষ হাতে টানা রিকশা তুলে দেওয়ার িসদ্ধান্ত িনয়েছে
কলকাতা পৌর কর্তৃপক্ষ হাতে টানা রিকশা তুলে দেওয়ার িসদ্ধান্ত িনয়েছে

কলকাতায় আজও টিকে আছে হাতে টানা রিকশা আর ট্রাম। এ দুটি যানবাহনই কলকাতার শতবর্ষের ঐতিহ্য। বিদেশি পর্যটকেরা এখনো কলকাতায় এলে শখ করে হাতে টানা রিকশায় আর ট্রামে চড়েন। কিন্তু এই দুটি যান কি এবার হারিয়ে যাবে? প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে কলকাতার আনাচকানাচে।

পশ্চিমবঙ্গের সরকার এখন কলকাতার রাস্তায় ট্রাম চালানো কমিয়ে দিয়েছে। ট্রাম চলাচলের অনেক রুট বন্ধ করে দিয়েছে। পাশাপাশি কলকাতা পৌর করপোরেশনও হাতে টানা রিকশা তুলে দিয়ে ব্যাটারি বা যন্ত্রচালিত স্কুটার চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু হাতে টানা রিকশাচালকদের অনেকেই তাঁদের ঐতিহ্যবাহী রিকশাকে চিরদিনের মতো বিদায় দিতে চাইছেন না। অতীতের ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে হাতে টানা রিকশা চালাতে চাইছেন অনেকেই। কিন্তু কলকাতা পৌর করপোরেশন তাতে সায় দিচ্ছে না। পৌর করপোরেশন মনে করছে, হাতে টানা রিকশা চালানোর ব্যাপারটি অমানবিক। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাও দাবি তুলেছে এই অমানবিক পেশা থেকে মুক্তি দেওয়া হোক হাতে টানা রিকশাচালকদের। তাই কলকাতাবাসীও ধারণা করছে, ট্রামের আগেই কলকাতার রাস্তা থেকে বিদায় নিতে পারে হাতে টানা রিকশা।

আর ট্রাম? ট্রাম এখনো চলছে। এখনো এই ট্রাম কলকাতার ঐতিহ্য। ভারতে এখন একমাত্র কলকাতাতেই ট্রাম চলে। কিন্তু ট্রামের গতি কম। ভিড়ের রাস্তায় চালানো দায়, তাই রাজ্য সরকার ট্রামকেও ধীরে ধীরে বিদায় দিতে অনেকটাই উদ্যোগী।

কলকাতায় প্রথম ট্রাম চালানো হয় ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। সেটা ছিল ঘোড়ায় টানা ট্রাম। প্রথম চালু করা হয় কলকাতার শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়া ঘাট পর্যন্ত। দূরত্ব ছিল ৩ দশমিক ৯ কিলোমিটার। তারপর অবশ্য ট্রাম চলাচল কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। পরে গঠন করা হয় ক্যালকাটা ট্রামওয়ে কোম্পানি লিমিটেড। এই কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন হয় লন্ডনে। তারপর ১৮৮০ সালের ২২ ডিসেম্বর থেকে ট্রাম আবার চালু করা হয়। তখন ট্রামের ছিল ছোট্ট একটি বগি। আর তা টেনে নিত ঘোড়ায়। এখন ট্রাম চলছে বিদ্যুতে। রয়েছে দুটি বড় বগি।

কলকাতার ট্রাম প্রথম বিদ্যুতে চলা শুরু করে ১৯০২ সালের ২৭ মার্চ থেকে। চালু হয় ধর্মতলা থেকে খিদিরপুর পর্যন্ত। ১৪ জুন ফের চালু করা হয় ধর্মতলা থেকে কালীঘাট পর্যন্ত। ১৯০৩ সালে চালু হয় ধর্মতলা থেকে টালিগঞ্জ পর্যন্ত। একই বছরে চালু হয় ধর্মতলা থেকে বেলগাছিয়া ও শিয়ালদহের মধ্যে। আর ১৯০৫ সালে চালু করা হয় ধর্মতলা থেকে কলেজ স্ট্রিট রুটে।

২০১১ সালে কলকাতার ট্রাম রুট ছিল ৩৭টি। ট্রামের সংখ্যা ছিল ১৮০-১৮৫। ট্রামলাইনের দৈর্ঘ্য ছিল ৬১ কিলোমিটার। প্রতিদিন গড় যাত্রীসংখ্যা ছিল ৭০ থেকে ৭৫ হাজার। এখন ২০১৭ সালে এসে ট্রামরুট কমে দাঁড়িয়েছে ১৫টিতে। ট্রামের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৬৫-৭০টিতে। ট্রামলাইনের দৈর্ঘ্য কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২২ কিলোমিটারে। আর গড় যাত্রীর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ২০ থেকে ২১ হাজারে। এখন আবার ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোরেল চালুর জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আরও দুটি ট্রাম রুট। ধর্মতলা-খিদিরপুর ও বিবাদিবাগ রুট।

কলকাতায় হাতে টানা রিকশার প্রচলন হয়েছিল ১০০ বছরেরও বেশি সময় আগে সেই ১৮৯০ সালে। ভারতে অবশ্য এই রিকশা প্রথম এসেছিল ১৮৮০ সালে হিমাচল প্রদেশের শিমলায়। শিমলা তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ছিল। তখন লোহা দিয়ে তৈরি এই রিকশা চালাতে চারজন লোকের প্রয়োজন হতো। এরপর ১৮৯০ সালে জাপান থেকে কলকাতায় প্রথম আসে কাঠের তৈরি হাতে টানা রিকশা। সেই থেকে আজও কলকাতায় চলছে যানটি। ২০০৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কলকাতার হাতে টানা রিকশা তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। তিনি চেয়েছিলেন যাঁরা এই হাতে টানা রিকশা চালান তাঁদের এই অমানবিক পেশা থেকে মুক্তি দিতে। রিকশাচালকদের পুনর্বাসিত করার জন্য তাঁদের হাতে ব্যাটারি বা জ্বালানিচালিত স্কুটার তুলে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে সায় দেননি রিকশাচালকেরা। নেমেছিলেন আন্দোলনে।

এখন কলকাতা পৌর করপোরেশন কলকাতার ৬ হাজার হাতে টানা রিকশাচালক ও তাঁদের পরিবারগুলোকে পুনর্বাসিত করার জন্য তাঁদের হাতে স্কুটার তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এই প্রকল্প চালু হলে সত্যিই কলকাতা থেকে বিদায় নেবে হাতে টানা রিকশা। কলকাতা পৌর করপোরেশন ইতিমধ্যে শহরের অধিকাংশ রাস্তায় বন্ধ করে দিয়েছে হাতে টানা রিকশা চলাচল। তবে বিদেশি পর্যটকদের আসা-যাওয়ার এলাকা যেমন, ধর্মতলা, শিয়ালদহ, বড়বাজার এলাকায় এর চলাচল রয়েছে, যাতে বিদেশি পর্যটকেরা কলকাতায় এসে একবার চড়তে পারেন হাতে টানা রিকশায়।

তবে এটা সত্য যে কলকাতার ট্রাম আর হাতে টানা রিকশার প্রচণ্ড চাহিদা রয়েছে বিদেশি পর্যটকদের কাছে। সম্প্রতি হুমায়ুন কবির নামে বাংলাদেশের এক পর্যটকের সঙ্গে আমার কথা হয়। তিনি বলেছেন, তিনি এবার তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে কলকাতায় বেড়াতে এসেছেন। তিনি তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের এই বলে নিয়ে এসেছেন যে কলকাতায় এলে দেখাবেন কীভাবে মাটির নিচে পাতালরেল আর শহরের রাস্তার ওপর দিয়ে কারেন্টে চলছে ট্রাম ও হাতে টানা রিকশা।

শুধু বিদেশি পর্যটকেরাই নন, এখনো কলকাতার এই হাতে টানা রিকশা, কলকাতার ট্রাম আর পাতালরেলে চড়তে ছুটে আসে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মানুষ। এসব যানবাহন তাদের ভ্রমণে একটা আলাদা মাত্রা যোগ করে।

তাই কলকাতার অনেক মানুষই এখন একেবারে তুলে দিতে চাইছে না শহর থেকে হাতে টানা রিকশা আর ট্রাম। তারা চাইছে, ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে থাকুক কলকাতার এই শতবর্ষের ঐতিহ্য বহনকারী হাতে টানা রিকশা ও ট্রাম। যদি উন্নয়নের খাতিরে এবং আধুনিক প্রযুক্তির আবির্ভাবে তুলেই দিতে হয়, তবে অন্তত দু-একটি রাস্তায় রাখা হোক এই দুটি যানকে ঐতিহাসিক স্মারক হিসেবে।

অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।