গণ-আন্দোলন ও রাজনীতির নতুন সমীকরণ

১৯৮১ সালের মে মাসের এক গভীর রাতে জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার সাংবিধানিক পথে নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন ভালো ছিল না। জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ থেকে ক্ষমতা সংহত করার প্রক্রিয়ায় রাজনীতিতে শৌখিন উচ্চাভিলাষী নেতা ও বেপরোয়া উচ্চাভিলাষী কর্মীদের সম্পৃক্ত করতে শুরু করেন। এতে ক্ষমতার রাজনীতির একটি স্বতন্ত্র স্বার্থসর্বস্ব চতুর ধূর্ত রূপ দাঁড়াতে থাকে। এর যূপকাষ্ঠে আদর্শ বা নীতি ক্রমাগত বলি হয়েছে। তবে জিয়ার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রসমাজের আন্দোলনে গণতান্ত্রিক আদর্শের বীজ তখনো ছিল।

বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে জেনারেল এরশাদ যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন জিয়ার স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের রেশ একদম থামেনি। তাই এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় পরপর ছাত্রসমাজের আন্দোলন শুরু হয়েছে। সে আন্দোলন দিনে দিনে বেগবান হয়েছে এবং এরশাদের নয় বছরের শাসনামলে সেলিম-দেলোয়ার থেকে নূর হোসেন পর্যন্ত অনেকে শহীদ হয়েছেন। সেই ক্ষমতার রাজনীতি যে আদর্শহীন চাতুর্যের পথেই চলবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এরশাদ সুদীর্ঘ নয় বছর ক্ষমতায় ছিলেন, এর সঙ্গে জিয়ার রাজনৈতিক আমলের তিন বছর যোগ করলে টানা বারো বছর ধরে রাজনীতির আদর্শ ও নীতি থেকে বিচ্যুতির কাজ চলেছে। ১৯৯০ সালে যখন এরশাদের পতন হচ্ছে তখন আন্দোলনরত ছাত্রসংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় নেতারা যেন সেই ‘বিপ্লবের’ নায়ক। তাঁরা দ্রুত প্রকাশ করলেন এরশাদের দোসর রাজনীতিক, আমলা ও ব্যবসায়ীদের নামের তালিকা, যাঁরা তখন কালো তালিকাভুক্ত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। হয়তো সব নাম তখনকার উত্তেজনাকর সময়ে সঠিকভাবে তালিকাভুক্ত হয়নি, কিন্তু অধিকাংশের ভূমিকা অবশ্যই এরশাদকে তোষণ, তাঁর কাছ থেকে প্রাপ্তি, তাঁকে ক্ষমতায় রাখার চেষ্টায় ব্যয়িত হয়েছিল।
পরবর্তীকালে এই তরুণ নায়কদের অনেকের সম্পর্কেই কালো তালিকাভুক্ত বণিকদের সঙ্গে আপস করার অভিযোগ উঠেছিল। আমরা কেবল প্রকাশ্যে দেখতে পাই ১৯৯০ যেন আমাদের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে এক বিভাজনরেখা। নব্বই পর্যন্ত এ রাজনীতি ছিল কেবল গৌরবের। ত্যাগে, সংগ্রামে, বীরত্বে ও আদর্শিক নৈতিকতায় এর গতি ছিল ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু নব্বইয়ের পর থেকে ধীরে ধীরে ছাত্ররাজনীতি অধোগামী হয়েছে, অর্থবিত্তের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে নেতৃত্ব। আদর্শ, ত্যাগ ইত্যাদি অতীতের ইতিহাসে পরিণত হয়েছে।
মূল রাজনীতিতেও সুবিধাবাদ জায়গা করে নিয়েছে তত দিনে। দুই বড় দল তখন ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। আমরা লক্ষ করি, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে যৌথ আন্দোলনে সম্মত হয়। দুটি পৃথক জোট গঠিত হলেও সমকালীন একজন সামরিক স্বৈরাচারীর দলের সঙ্গে তখনকার মতো আপস অসুবিধা হয়নি। তখন যুক্তি ছিল যে ক্ষমতার বাইরে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপিও একটি গণতান্ত্রিক দল। কিন্তু সে যুক্তিতে পরবর্তীকালের জন্য জেনারেল এরশাদের বৈধতার একটা ক্ষেত্রও প্রস্তুত হয়ে যায়।
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে এরশাদ বিএনপির কাছ থেকে ক্ষমতা দখলের জন্য দায়ী ছিলেন বলে বিএনপি তাঁর বিরুদ্ধে ছিল।
এ সময় আওয়ামী লীগও যে এরশাদবিরোধী অবস্থানেই ছিল, তার কারণ আওয়ামী লীগ নিশ্চিত ছিল যে তারা নির্বাচনে বিজয়ী হবে, পরাজয় তাদের কল্পনাতেও ছিল না। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় থেকে স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা সবাই একই রকম ভেবেছিলেন। ফলে এই পরাজয় তাঁদের হতবিহ্বল করে দেয়। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থেকে এর খেসারত দলকে কতটা দিতে হয়, তা নেতারা ভালোভাবেই জানতেন। আবার জামায়াতে ইসলামী ও সমমনা দলের প্রতি সরকারের প্রশ্রয় থাকলে জাতীয়ভাবে কী ক্ষতি হয়, তা সমাজের বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীরা ভালোভাবেই জানেন। তাঁরা এ রকম ভাবনা থেকেই এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ব্যাপকভাবে যুক্ত হয়েছিলেন এবং স্বৈরাচারের পতনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বেগম জিয়া তাঁর স্বামীর ধারাতেই জামায়াতকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে রাজনীতি করতে থাকায় তাঁদের পক্ষে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামা ছাড়া গতি ছিল না। কিন্তু তত দিনে ছাত্ররাজনীতির আগেকার গণমুখী সংগ্রামী ধারার অবসান হওয়ায় এ আন্দোলন ক্রমেই অনেক বেশি পেশিশক্তি, কালোটাকা ও সহিংস রূপ ধারণ করে। এতে রাজনীতি আরও রাজনীতিবিহীন তথা নীতিহীন, আদর্শহীন হয়ে উঠতে থাকে।
দীর্ঘ দুই দশক পর যখন আবার নির্বাচনের সময় এল, তখন আওয়ামী লীগ স্বভাবতই ক্ষমতায় ফেরার জন্য মরিয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন, ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির জবরদস্তি নির্বাচন বাতিল নিয়ে কড়া আন্দোলন তো হলোই, সেই সঙ্গে পতিত স্বৈরাচার এরশাদের সঙ্গে সমঝোতাতেও আপত্তি থাকল না। আদতে নব্বইয়ে পতনের পর থেকেই এরশাদের পুনর্বাসনপ্রক্রিয়ার পথ খুলে যায়। প্রথমে তাঁর দোসররা নানাভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক বা ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। পরে ১৯৯৬-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সময় তাঁর পুনর্বাসন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
জেনারেল এরশাদের পতনের পরপর এবং পরবর্তী বিএনপি সরকারের আমলে তাঁর বিরুদ্ধে যত মামলা দায়ের করা হয়েছে, সেগুলো কখনো ধীরগতিতে চলেছে, কখনো থেমে থেকেছে, তবে হাত থেকে তার লাগাম আওয়ামী লীগ কখনো ছাড়েনি। ২০১৪ সাল থেকে এরশাদের দল জাতীয় পার্টি সংসদে একমাত্র বিরোধী দল এবং তাঁর স্ত্রী সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী হলেও দলের তিনজনের মন্ত্রিসভার সদস্য হতে ও দলের প্রধান জেনারেল এরশাদের মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের ভূমিকা পালনে কোনো অসুবিধা হয়নি। এটি গণতন্ত্রের এক চমকপ্রদ প্রহসন-নাট্য বলা যেতে পারে। কিন্তু নয় নয় করে এটি বাংলাদেশে আজ আট বছর ধরে চলছে। এ ব্যবস্থা যে সরকারের মেয়াদ পর্যন্ত চলবে, তাতে সংশয় নেই। হয়তো দেখার বিষয় হতে পারে, নির্বাচনে মহাজোট এরশাদকে নিয়ে পরিসর বাড়ায় কি না কিংবা তাঁর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রেখেও এরশাদ তাঁর দল নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নেন কি না।
ইতিমধ্যে কালের নিয়মে এরশাদের বয়স বেড়েছে, ৮৭ বছর বয়সেও তাঁর ক্ষমতালিপ্সা যথেষ্ট প্রবল। মামলার জুজু ব্যবহারের সুযোগ হাতে রেখেছে ক্ষমতাসীন দল, ফলে আওয়ামী লীগের স্বার্থরক্ষার বাইরে এরশাদের পক্ষে অন্য কিছু ভাবা সম্ভব নয়।
আজ ২৭ বছর পর নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন ও এর সাফল্যের দিনটির কথা ভাবা যায়। সেদিন গণমানুষ একধরনের মুক্তির আনন্দে উৎসব পালন করতে রাজপথে নেমে এসেছিল। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর দিনটি যেন একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের অনুভূতি ফিরিয়ে এনেছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই আনন্দের রেশ কাটতে বেশি সময় লাগেনি। প্রথমে বিএনপির বিজয়ের ফলে ক্রমে জামায়াত ও এই ধর্মান্ধ শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আর তার পরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একবার জামায়াতের কৌশলগত নৈকট্য ও পরে এরশাদের সঙ্গে সমঝোতার কারণে। তবে ক্ষমতার ক্রোড়ে থেকে এত দিনে বস্তুতপক্ষে এরশাদ আর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফ্যাক্টর নন। কিন্তু তা বলে এই গণ-আন্দোলনের শহীদ ডা. মিলন বা নূর হোসেন কিছুতেই নন-ফ্যাক্টর হতে পারেন না। এ বিষয়টি আওয়ামী লীগ এড়াতে পারবে না।
শেখ হাসিনা নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়েছেন এবং এরশাদকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে অতীতের অধ্যায়ে পরিণত করেছেন। তাঁর আর শাস্তি হলো নাকি হলো না, তা গৌণ বিষয় হয়ে পড়েছে। এরশাদ বা তাঁর দলবল আগামী নির্বাচনে ১৫-২০টি আসন পেতে পারেন, কিন্তু তাঁদের পক্ষে আওয়ামী লীগকে পাশ কাটিয়ে ভিন্ন রাজনীতি করা আর সম্ভব নয়।
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর আমাদের ছাত্ররাজনীতি, মূল রাজনীতিসহ শ্রমিক-কৃষক সব রাজনীতির অবক্ষয় ঘটেছে। তার পুনরুদ্ধার কোনো ফ্রন্টে আর হয়নি, তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এক নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে। সে পর্বে আদর্শহীন ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতি পিছুটান হয়ে থাকলেও মানুষের দক্ষতা এবং দক্ষ মানুষের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। এখন এরশাদকে ছাপিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে হেফাজত ও তাদের মতো ধর্মীয় কট্টরপন্থী সংগঠন ও দলগুলো। এখন প্রশ্ন হলো শেখ হাসিনা কি এরশাদের মতো এঁদেরও রাজনীতিতে নন-ফ্যাক্টর করে তুলতে পারবেন?

আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।