এটা 'বিকল্প সত্যের' যুগ

১৫ নভেম্বর জিম্বাবুয়ের রাজধানীর রাস্তায় সেনাবাহিনীর ট্যাংক নেমে এলে সামরিক মুখপাত্র মেজর জেনারেল সিবুসিসো মোয়ো জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তবে মোয়ো সামরিক পোশাকে ছিলেন না। তিনি দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেন, এটা সামরিক অভ্যুত্থান নয়, যদিও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে গৃহবন্দী ছিলেন, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ছিল সামরিক নিয়ন্ত্রণে এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

ব্যাপারটা হলো, সেনাদের ক্ষমতা নেওয়ার পর অভ্যুত্থানের কথা অস্বীকার করার ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়, বিশেষ করে স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর থেকে এটা হয়ে আসছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে সারা পৃথিবীতেই এ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক হচ্ছে যে বক্তৃতা-বিবৃতি শুধু শব্দের অর্থের বিকৃতি বা ভিন্নরূপ করছে না, বরং তা একদম খোলামেলাভাবে বাস্তবতা অস্বীকার করছে। হারারে থেকে কায়রো এবং ব্যাংকক থেকে ওয়াশিংটন পর্যন্ত এটা চলছে।
আমরা জানি, যাঁরা ভাষা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁরা অর্থও নিয়ন্ত্রণ করেন। আর যাঁরা অর্থ নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁরা বাস্তবতা নিয়ন্ত্রণ করেন। কিন্তু ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা যখন বাস্তবতা অস্বীকার করেন, তখন ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়?
এর আগে ৬ আগস্ট জিম্বাবুয়ে থেকে দূরের এক দেশ ভেনেজুয়েলায় এক উর্দি পরিহিত ব্যক্তি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ক্যাপ্টেন হুয়ান কাগুয়ারিপানো ভেনেজুয়েলার মানুষকে আশ্বস্ত করেন যে তাঁরা যে প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে উৎখাতের চেষ্টা করেছেন, তা ‘অভ্যুত্থান নয়’-যেটা দ্রুতই ব্যর্থ হয়। তাঁর ভাষায়, এটা ছিল ‘সাংবিধানিক শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সামরিক ও নাগরিক উদ্যোগ’।
এ দুটি নাটকের পাণ্ডুলিপি কিন্তু একই রকম। এর তিন বছর আগে থাইল্যান্ডের জেনারেল প্রায়ুথ চান-ওচা একই ভাষা ব্যবহার করেছেন। ২০১৪ সালের ২০ মে এই কঠোর সমরনেতা দেশটির নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রাকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। জাতীয় টেলিভিশনে হাজির হয়ে তিনি বলেন, ‘এটা অভ্যুত্থান নয়।’ তবে এ কাজে মিসরের একনায়ক আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি ওস্তাদ, ওচাও তাঁর কথার প্রতিধ্বনি করেছেন।
এর আগে সিসি মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু সিসি দাবি করেন, তাঁর কাজের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের সম্পর্ক নেই। বহু ইহজাগতিক মিসরীয় ভাষ্যকার তাঁর কথার সাফাই গেয়েছেন।
তবে পাঠকদের কাছে এসব কথা খুব একটা বিস্ময়কর না-ও ঠেকতে পারে। সর্বোপরি অভ্যুত্থানকারীদের সত্য অস্বীকারের অনেক কারণই থাকতে পারে। প্রথমত, যে সরকার কেবল বন্দুক ও কামানের জোরে ক্ষমতায় এসেছে, তাদের পক্ষে তো দেশের ভেতরে নিজেদের কাজের যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করা কঠিন। সর্বোপরি, অভ্যুত্থানের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া কঠিন।
উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কথাই বলা যায়। এ দেশে এমন আইন আছে, কোনো দেশে যদি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার ক্ষমতায় আসে, তাহলে তাকে অনুদান দেওয়া যাবে না। একইভাবে আঞ্চলিক সংগঠন, যেমন আফ্রিকান ইউনিয়নও ক্রমেই সামরিক অভ্যুত্থানকারীদের স্বীকৃতি দেওয়ার পথ থেকে সরে আসছে। কারণ, এতে অন্যরা লাই পেয়ে যায়।
শেষত, পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের সরলীকৃত নৈতিকতার জগতে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের ব্যাপারটা হালে পানি পায় না। কারণ, সেখানে অভ্যুত্থান ‘খারাপ’ আর নির্বাচিত সরকার ‘ভালো’ জিনিসের সমতুল্য। ফলে অভ্যুত্থানের ব্যাপারে মিথ্যা বলা অভ্যুত্থানকারীদের তরফে যৌক্তিক।
জেনারেল মোয়ো ও তাঁর সমমনাদের এই ভণিতাকে আমরা দ্বিচারণের সমসাময়িক নজির হিসেবে আখ্যা দিতে পারি। তা সত্ত্বেও আমরা যদি এক ধাপ পেছনে গিয়ে সব সূত্র এক বিন্দুতে মেলাই এবং তাদের বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরের পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করি, তাহলে নতুন ও অশুভ কিছু একটা ব্যাপারের বিশুদ্ধ রূপ দেখা যায়-ট্রাম্পের প্রচারণা কৌশলবিদ ও উপদেষ্টা কেলাইন কনওয়ে এ কথা বলেছেন।
ব্যাপারটা হলো, ট্রাম্পের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মানুষের উপস্থিতি নিয়ে সিন স্পাইসার নিজের সন্দেহাতীত মিথ্যা বক্তব্যের সাফাই গাইলে কনওয়ে বলেন, স্পাইসারের বক্তব্যে মিথ্যা নেই, তিনি ‘বিকল্প সত্য’ হাজির করেছেন। আল-সি­সি, প্রায়ুথ ও মোয়োর মতো তাঁর কথা দ্বিচারণেরও অধিক।
অরওয়েলের শব্দবন্ধে মতামত ও সত্যের পার্থক্যবিষয়ক সচেতনতার ইঙ্গিত আছে। একই সঙ্গে সেখানে এ দুটির ভেদরেখা ঘুচে যাওয়ার ব্যাপারটাও আছে। দ্বিচারণে সত্য বিকৃত করা যায়, কিন্তু তাতে এই বোঝাপড়াটা থাকে যে সত্য অন্য স্তরে আছে। অর্থাৎ, সত্যটা সত্যই থেকে যায়।
তবে নতুন ধরনের বাগাড়ম্বরে এই পার্থক্য অস্বীকার করা হয়েছে, এটা বাস্তবতার ওপর আঘাত। আবার দ্বিচারণে যেখানে দ্ব্যর্থকতা ও উদ্দেশ্যহীন যুক্তি থাকে, সেখানে এই নতুন রূপ তার স্বচ্ছতার জন্য গর্বিত। এটা সত্য বর্জনের বলে আত্মবিশ্বাসী, এর অনুসরণকারীরা সত্যের অকার্যকারিতা প্রদর্শনে উদ্ধত।
রাজনীতিকদের ব্যাখ্যায় ধোঁয়াশা থাকে, কিন্তু এখন তাঁরা গর্বের সঙ্গে সত্যের বিরুদ্ধে মতামতের বিজয় ঘোষণা করছেন। এই চিন্তাধারার মধ্যে দ্বিচারণ নেই, নেই সত্যের সচেতনতা, সত্য নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাও নেই। এটা স্রেফ এক নতুন বাস্তবতা। এটাই সমসাময়িক কর্তৃত্ববাদের চূড়ান্ত বৈশিষ্ট্য।
এই অসুখের কেবল একটি দাওয়াই আছে, সেটা হলো, বাস্তবতায় জোর দিয়ে তার দাবি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এমনকি সেটা যদি আমাদের পছন্দমতো না-ও হয়। আমাদের কথা ও কাজে গভীর আস্থা রাখতে হবে, এমনকি সেই ক্ষমতা যদি আমাদের মধ্যেও থাকে, তার সঙ্গে অখণ্ডতা রক্ষা করতে হবে, এমনকি তার জন্য যদি আমাদের সত্তার কিছু অংশ কেটে বাদও দিতে হয়। জিম্বাবুয়ে, থাইল্যান্ড ও মিসরে এখন সামরিক একনায়কতন্ত্র কায়েম হয়েছে, সে আমরা নতুন নেতাদের পছন্দ করি বা না করি। কর্তৃত্ববাদের বাড়বাড়ন্ত ঘটছে, যেখানে কিছু ক্ষেত্রে নির্বাচনের মধ্য দিয়েও তার আগমন ঘটছে। চরম ডানপন্থী ও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা ইউরো-মার্কিন পুঁজিবাদের ফাটল গলে বেড়ে উঠছে, সে আমরা এই ব্যবস্থাকে গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলি আর নাই বলি।
এই সত্য অস্বীকার করা বা চীনা প্রভাব ও রুশ হ্যাকারদের ওপর এর দায় দিয়ে লাভ নেই, ‘চরমপন্থী ইসলামবাদ’ বা গণমানুষের বোকামিতে আমাদের চেহারাটা জেনারেল মোয়োর মতো হয়ে যায়। যে লোকটা অদ্ভুত পোশাক পরে টিভিতে হাজির হয়ে চারপাশের ঘটনাপ্রবাহকে অস্বীকার করছিলেন, আমাদেরও তাঁর মতো দেখায়।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, অনূদিত।
ক্লাউদিও সোপ্রানজেতি: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অল সোলস কলেজের ফেলো।