ট্রাম্পের কারণে সংকটে সৌদি আরব

গত মে মাসে সৌদি আরব সফরের সময় বাদশাহ সালমান মালা পরিয়ে দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে।
গত মে মাসে সৌদি আরব সফরের সময় বাদশাহ সালমান মালা পরিয়ে দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে।

জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের আগুনে নতুন ঘি ঢেলে দিলেন। কয়েক দিন ধরেই ট্রাম্পের এই আশু পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সমালোচনা হচ্ছিল। তেহরান থেকে বৈরুত, বার্লিন, প্যারিস সর্বত্রই বিরূপ মন্তব্য করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, এই সিদ্ধান্তকে তারা স্বাগত জানাবে না। আরব লিগ কড়া প্রতিবাদ করেছে। 

হামাস, হিজবুল্লাহ, ইরান, তুরস্কের হুমকিধমকি আছেই। তুর্কি প্রেসিডেন্ট তো এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে ইসরায়েলে সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কচ্ছেদেরই ঘোষণাই দিয়েছেন। চীনও এর বিরোধিতা করেছে। সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের সারথি ব্রিটেনও ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারছে না। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে প্রকাশ্যেই দ্বিমত পোষণ করেছেন। তুমুল বিরোধিতা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই ইসরায়েলের পাশে থেকেছে।

জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে সারা বিশ্বেই এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হবে—এটি জেনে-বুঝেই ট্রাম্প প্রশাসন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন ঠিক এই মুহূর্তে মার্কিন প্রশাসন এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল, যেখানে তার কোনো মিত্রই সমর্থন করছে না? একই সঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে, জেরুজালেম বিতর্কে সৌদি আরবের আবস্থান কী হবে। সৌদি আরবের প্রসঙ্গ এখানে বলা হচ্ছে, কারণ মধ্যপ্রাচ্যে এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র তেলসমৃদ্ধ এই দেশ। এই দুই দেশের অনেক এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করার জন্য কাজ করছে সৌদি আরব।

জেরুজালেম সংকটের কারণ হিসেবে বিবেচনা করলে আরব অঞ্চলে ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব ফিরিয়ে আনার জন্য নতুন এক ফ্রন্ট খোলাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য। স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা হচ্ছে, জেরুজালেম বিতর্ক কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে যে বিভাজন ছিল, সেটি আরও পোক্ত হবে। সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন ফ্রন্টে ইরান-তুরস্ক-রাশিয়া অক্ষের কাছে মার্কিন-সৌদি অক্ষের কূটনৈতিক পরাজয়ের পর নিজেদের হেজেমনিক অবস্থান টিকিয়ে রাখার জন্য এ রকম একটি সিদ্ধান্ত মার্কিন প্রশাসনের প্রয়োজন ছিল। জেরুজালেম বিতর্ক এমন এক জটিল ইস্যু, যেখানে ইরান-তুরস্ক-রাশিয়ার জোট সঠিকভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না। ইউরোপ, রাশিয়া বা চীন যতই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলি লবি ও কৌশলগত কারণে এর কঠোর বিরোধিতাও করতে পারবে না। এখন এই ফ্রন্টে ইরান-তুরস্ককে একাই লড়াই করতে হবে। বড়জোর লেবানন প্রকাশ্যে এদের পাশে থাকতে পারে। অ্যান্টিসেমেটিক হওয়ার ভয়ে ইউরোপীয় দেশগুলো খুব বেশি এগিয়ে বলে মনে হচ্ছে না। সিরিয়া ফ্রন্টে যেভাবে রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেছে, এ ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব না। এই সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তার অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানে পুনরায় ফিরে আসার চেষ্টা করবে।

ট্রাম্পের ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় সবাই কমবেশি এক বাক্যে বলছে, জেরুজালেম সংকট মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিপ্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে। এই ধরনের বক্তব্য নতুন কিছু না। সত্যি বলতে, আমরা এখন পর্যন্ত এমন কোনো সিদ্ধান্ত দেখিনি, যা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিপ্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে। বস্তুত জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির কোনো হেরফের হতো না। বাস্তবতা হচ্ছে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে মেনে নেওয়া, ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা বন্ধ না করলে শান্তি মধ্যপ্রাচ্যে কখনোই আসবে না; যতই আলোচনা, কূটনীতি করা হোক না কেন। সর্বোপরি আরব রাষ্ট্রগুলোর বিভাজন দূর না হওয়ার পর্যন্ত ফিলিস্তিন ইস্যুতে কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত আসা সম্ভব নয়। বিভাজন দূর করার জন্য আরবের রাষ্ট্রগুলোতে প্রথমেই গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনয়নের আগে আরবে আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন করতে হবে আরব দেশগুলোকে।

তাই এখানে বিবেচনা করতে হবে, আরবের রাজনৈতিক মানচিত্রে এর কী প্রভাব পড়বে। জেরুজালেমে কোনো রাষ্ট্রের দূতাবাস নেই। এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র যদি শেষ পর্যন্ত দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরিত করে, তবে সারা বিশ্ব থেকেই একঘরে হয়ে যেতে পারে। যদি তা হয়ও, সেটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুব বেশি ক্ষতিকর হবে না। কারণ, বিশ্ব ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্র এমনিতেই তার অবস্থান হারাচ্ছে।

সবচেয়ে বেকায়দায় পড়বে সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক সংকটে সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেন ফ্রন্টে সৌদি আরব ইরান-তুরস্কের কূটনীতির কাছে পর্যুদস্ত হয়েছে। সৌদি আরবে জন্য যেকোনো পক্ষাবলম্বন করাই বিপজ্জনক। সৌদি আরব মার্কিন-ইসরায়েল বলয়ে থাকার কারণে মুসলিম বিশ্বসহ সবার কাছেই গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। আবার পক্ষ বদল করলে মার্কিন-ইসরায়েলের কুনজরে পড়ে যাবে। বিশেষ করে রাজপরিবারসমূহ বিপদের মুখে পড়বে। তবে শেষ পর্যন্ত সৌদি আরব এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না, যা ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও অস্তিত্বের জন্য ক্ষতিকর হবে। কিছুদিন আগে অবশ্য এক ইসরায়েলি মন্ত্রী হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন। ইসরায়েলের ওই মন্ত্রীর বরাতে জেরুজালেম পোস্ট জানায়, সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের গোপন যোগাযোগ অনেক আগে থেকেই আছে। এবং তারা পরস্পরের স্বার্থ রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আরব অঞ্চলের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে মার্কিন প্রশাসনের আরেকটি কৌশল হচ্ছে, আরবে শিয়া-সুন্নি লড়াই জারি রাখা। ইতিমধ্যে সৌদি নেতৃত্বে সুন্নি দেশগুলোর সামরিক জোট গঠন করা হয়েছে। জেরুজালেম বিতর্কে সেই জোটের নেতা সৌদি আরবকে সামনে ঠেলে দিয়ে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার পথে আরেক ধাপ এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে যুক্তরাষ্ট্র। তাতে সবচেয়ে ক্ষতি হবে সৌদি আরবেরই। এতে করে সৌদি আরব আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার অবস্থান হারাবে। এমনকি সৌদি আরব যদি কয়েকটি রাষ্ট্রে বিভক্তও হয়, তাতে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। ট্রাম্পের জ্বালিয়ে দেওয়া আগুনে সবচেয়ে বেশি পুড়তে পারে সৌদি আরবই।

ড. মারুফ মল্লিক: রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি