বিশ্ববিদ্যালয় ভয়হীন জায়গা হোক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে ভোটের আমেজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাউঞ্জে, ক্লাবে, বিভাগে, করিডরে এমনকি পরীক্ষার হলেও প্রার্থীরা সৌজন্য সাক্ষাতে ছুটছেন দলেবলে কিংবা ব্যক্তিগতভাবে। ক্লাবে-লাউঞ্জে চেয়ারের সংকট, খাবার নিয়ে ছোটাছুটি কর্মীদের। চায়ের পানি ফুটছে বারবার, প্রার্থীদের কারও হাতে নীল প্যানেলের কাগজ, কারও হাতে সাদা। আর ভোটাররা কেউ কেউ দুই হাতে নীল-সাদা দুই রঙের প্যানেলের কাগজ হাতে নিয়ে প্রার্থীদের নাম পড়ছেন, চিনছেন, চেনার চেষ্টা করছেন। এই ভোট ‘মেলা’য় ভোটাররা কখনো নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক দিয়ে সাজানো টেবিলগুলোতে প্রার্থীদের নিয়ে আলাপ পাড়ছেন, প্রার্থীদের সঙ্গে কখনো হাসিঠাট্টা করছেন, প্রার্থীদের বিনয়ী হাসিমুখের সালামের বিনিময়ে মাথা নাড়ছেন কিংবা চা-কফিতে চুমুক দিচ্ছেন। বাদ যাচ্ছে না পরীক্ষার হলগুলোও। ফোনের স্ক্রিনে কিছুক্ষণ পরপর ভেসে আসছে ভোট প্রদানের বিনীত অনুরোধসংবলিত বার্তা, বিনয়ে মোড়ানো নানা বাক্য।

এই ভোটযোদ্ধারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আজ ১১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় নির্বাচন, শিক্ষক সমিতি নির্বাচন, যেখানে ভোট দেবেন দুই হাজারের অধিক শিক্ষক। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। কারণ, শিক্ষক সমিতিতে এটি ‘সাধারণ’ শিক্ষকদের আঁকড়ে থাকা জমিন, শিক্ষকেরা এটিকে তাঁদের শক্তি মনে করেন। যদিও এটির সেই তেজস্বী চরিত্র ও ঋজুতা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগপন্থী নীল দল এবং বিএনপি ও জামায়াতপন্থী হিসেবে পরিচিত সাদা দল। প্রার্থীরা সবাই ব্যস্ত নির্বাচনী প্রচারণায়। আশার কথা হলো নীল দলে যে সশব্দ ভাঙন হয়েছিল, সেটি আপাতত কাটিয়ে উঠে কর্মযোগ্য সম্পর্ক জারি রেখেছে নীল দলের নেতৃত্ব। তবে মন থেকে নয়, মেনে নিয়েই যে এই সমঝোতা, সেটিও সহজে বোঝা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী, বিএনপি সমর্থনের বাইরে বাম ঘরানার অনেক ‘পাবলিক তারকা’ শিক্ষকের গোলাপি দল এবার নির্বাচনী মাঠে নেই। তবে গেছে বছরও ছিল। বছর কয়েক আগেও কয়েক দফা নীলের সঙ্গে থেকে নির্বাচন করেছে গোলাপি দল। তবে সেখানেও বনিবনার সমস্যা ছিল, তাই পরে নিজেদের অবস্থান খোলাসা করতে আলাদাই ছিল চিরচেনা গোলাপিরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হবে’, ‘হচ্ছের’ মধ্যে ডাকসুর ভাগ্য ঝুলে থাকলেও শিক্ষকদের প্রায় সব নির্বাচন নিয়মিতই হয়েছে। আগে শিক্ষক সমিতির একটা রেওয়াজ ছিল বছরের শেষ দিন নির্বাচন করার। তবে গত দুই বছর হামাগুড়ি দিয়ে নির্বাচন এগিয়েছে। আর এবারের নির্বাচনে একটু ভিন্নতা হলো দুই দলের প্রার্থীদের দু-একজন ছাড়া কেউই নির্বাচন জগতে নবাগত নন। তবে অনেক ভোটারই হয়তো শিক্ষক সমিতি নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ভোট দেবেন বলেই ভোটারদের কাছে প্রার্থীদের পরিচিত হতে হচ্ছে। ভোটার হিসেবে নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা জানিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব। আমরা স্পষ্টই বলতে চাই, শিক্ষক আন্দোলন সব সময়ই আমাদের কাছে শিক্ষা আন্দোলনেরই অংশ। তাই শিক্ষক নেতৃত্বকে জানান দিতে চাই শিক্ষক সমিতি শুধু শিক্ষকদের দাবিদাওয়ার পাটাতন নয়, এটি শিক্ষা আন্দোলনেরও আশার জায়গা।

এই আলাপের প্রাসঙ্গিকতার খুঁটি কোথায়? কেন শিক্ষক সমিতি নির্বাচনটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ? কী কারণে এটি ভিন্ন মর্যাদা বহন করে? প্রথমত, এটি এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে বছর বছর শিক্ষকদের নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশের আভাস দেয়। কিন্তু এর বিপরীত চিত্রও সমানভাবে অস্তিত্বশীল। বিশ্ববিদ্যালয়ের তো মুক্তবুদ্ধির চর্চাকেন্দ্র হওয়ার কথা, কিন্তু সেখানে এক বছর ধরেই একধরনের ভয়ের সংস্কৃতি জারি আছে। এই ভয় নানা ধরনের। সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে আগে চিঠি না দিয়েই সিন্ডিকেট থেকে পরপর কয়েকটি ‘বাধ্যতামূলক ছুটি’ এই সংস্কৃতিকে আরও পাকাপোক্ত করেছে। কারও প্রতি কারও সমর্থন কিংবা বিরোধিতা নির্ভর করছে ক্ষমতার পরিবর্তনশীল মেরুকরণের ওপর। ফলে ভোটাররূপী শিক্ষকেরা যেন নজরদারির মধ্যে আছেন। তাই শিক্ষক সমিতির কাছে প্রত্যাশা, তাঁরা প্রথমে শিক্ষকদের জন্য একটি ভয়হীন জায়গা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে হাজির করার জন্য প্রশাসনের সঙ্গে দেনদরবার করবেন।  

দ্বিতীয়ত, শিক্ষক সমিতি শুধু ১৫ জনের একটি কমিটিই নয়, একটি বড় ক্যানভাস। এই ক্যানভাস বাংলাদেশের শিক্ষার মানচিত্রের ক্যানভাস। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষক সমিতির কাছে আমাদের চাওয়ার পরিসরটি অনেক বড়। আর বড় বলেই গত বছর দুজন অসুস্থ শিক্ষকের প্রতি সর্বোচ্চ সমর্থনসহ বন্যার্ত ও রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা—প্রভৃতি বিষয়ে বেশ কিছু মানবিক উদ্যোগ এই শিক্ষক সমিতি নিয়েছে। শিক্ষক সমিতির শেষ সময়ে দীর্ঘদিন ধরে ‘ঝুলন্ত’ অবস্থায় থাকা বঙ্গবন্ধু স্কলারশিপের চাকাও কিছুটা গন্তব্যের দিকে ঘুরছে। বাড়ানো হয়েছে শিক্ষক সমিতির ভাষায় কিছু ‘প্রান্তিক’ সুবিধা। তবে এটি শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সার্বিক মান বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট নয়, এটি আমরা সবাই নিশ্চিতভাবেই জানি।

আমরা চাই শিক্ষক সমিতির বৃহৎ পরিসরে আসা-যাওয়া করবে মুক্তচিন্তার মানুষদের নানা ধরনের শিক্ষা উদ্যোগ ও ভাবনা। শিক্ষকনেতারা সেগুলো আমলে নেবেন, সেগুলো নিয়ে এগোবেন। সেখানে থাকবে না কোনো ধরনের প্রশাসনিক অথবা ক্ষমতার ভয়। শিক্ষক সমিতি তিন মাস পরপর সাধারণ সভা ডাকবে। শুধু নির্বাচনের সময়ই ভোটারদের ভোট প্রত্যাশা নয়, নির্বাচনের পরও তাঁদের সঙ্গে থাকতে হবে, যোগাযোগ রাখতে হবে তাঁদের নির্বাচিত নেতৃত্বকে। কোনো কোনো শিক্ষক নির্বাচনের পর আর ভোটারদের চেনেন না। ‘কোথায় যেন দেখেছি’ বিস্ময় নিয়ে সহকর্মীর দিকে তাকান, নাম মনে করা তো আরও দূরের বিষয়। নির্বাচনের সময় ভূরি ভূরি ফোনের বাঁশি বাজলেও অন্য সময়ে সেই সব ভোটপ্রার্থী শিক্ষকদের ভোটারদের সঙ্গে খুব কমই যোগাযোগ থাকে। সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষকনেতারা সব শিক্ষকের সঙ্গে বসবেন, দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে তাঁদের কথা শুনবেন, শিক্ষার পরিবেশ ও সমস্যা নিয়ে ভাববেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাবেন।

আর আমরা আরও আশা করি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির হাত ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নতুন মাত্রা পাবে। যে কমিটি নির্বাচিত হবে, তার প্রতি অগ্রিম শুভকামনা ও অভিনন্দন। 

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।