ভাষার ব্যবহার ও সামাজিকতা শিক্ষার দায়

প্রথম আলোর ফাইল ছবি
প্রথম আলোর ফাইল ছবি

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আমার ছেলেবেলা’ গল্পে লিখেছিলেন, সেজদাদা বলতেন ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন।’ জানি না রবিঠাকুরের সেজদাদার অভিব্যক্তি কেমন হতো যদি অলৌকিকভাবে হলেও কিছু সময়ের জন্য তিনি আমার সঙ্গে যোগ দিতেন সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জন্মদিনের একটি উৎসবে, যেখানে মায়েদের আড্ডার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল ‘শিশুর শিক্ষার মাধ্যম বাংলা নাকি ইংরেজি হওয়া উচিত’। আলোচনার সূত্রপাত সাদামাটাভাবে হলেও একপর্যায়ে তা চরম আকার ধারণ করে। দুই পক্ষ একেবারে মারমুখী অবস্থানে চলে যায়। 

‘শিশুর শিক্ষার মাধ্যম বাংলা নাকি ইংরেজি হওয়া উচিত-অভিভাবক কিংবা সচেতন মহলে এই আলোচনা কিংবা তর্ক-বিতর্ক বাংলাদেশে নতুন নয়। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর মা-বাবা সম্ভবত প্রায়ই একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে থাকেন। আর তা হলো কেন তাঁরা সন্তানের জন্য বাংলা মাধ্যমের পরিবর্তে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বেছে নিয়েছেন। মজার ব্যাপার হলো এই প্রশ্নের বিপরীত প্রশ্নটি কিন্তু বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীর বাবা-মাকে কমই মোকাবিলা করতে হয়। কারণ যাই হোক না কেন, অনেকটা নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া যায় যে ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া আজও সেই মাত্রায় গ্রহণযোগ্যতা পায়নি এবং এই মাধ্যম নিয়ে রয়েছে নানা বিভ্রান্তি।
বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের যাত্রা শুরু হয়েছে কম করে হলেও চার দশক আগে। প্রথম দিকে হাতে গোনা অল্প কয়েকটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অস্তিত্ব থাকলেও গত দেড় দশকে ঢাকাসহ বড় বড় শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। এর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি স্কুল যুগোপযোগী মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। বাকি স্কুলগুলোর সার্বিক শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট সংশয়। এসব স্কুলের কারিকুলাম, শিক্ষাদানের কৌশল, ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা, শিক্ষকদের যোগ্যতা ইত্যাদি নিয়ে রয়েছে অনেক তর্ক-বিতর্ক। তবে সংশয়ের এই বিষয়গুলো যে কেবল ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়; বাংলা মাধ্যম এবং কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোও একই সমস্যায় জর্জরিত।
ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি প্রচলিত ধারণা হলো সেখানে সন্তানেরা ঠিকমতো সহবত শেখে না, ভীষণ অহংকারী, উচ্ছৃঙ্খল আর অসামাজিক হয়ে গড়ে ওঠে। এই বিষয়কে হয়তো সামগ্রিক অর্থে গ্রহণ করা ঠিক হবে না; তবে ব্যাপারটিকে গুরুত্বহীন বলে উড়িয়ে দিলেও চলবে না। যখন অভিভাবকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অংশ এই ধারণা পোষণ করছেন, তখন বিষয়টি স্কুল কর্তৃপক্ষসমূহকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে এবং এর কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণ মূল্যায়নের এই দৃষ্টিভঙ্গি কতখানি যৌক্তিক, তা-ও তলিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।
ইংরেজিতে কথা বলার অর্থই কিন্তু নিজেকে জাহির করা নয়। যে শিক্ষার্থীরা দিনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি সময় ইংরেজি ভাষার পরিমণ্ডলে অতিবাহিত করে, তাদের মধ্যে ইংরেজি বলার প্রবণতা বেশি থাকবে, সেটি অস্বাভাবিক নয়। তবে স্থান, কাল, পাত্র বিবেচনা না করে ইংরেজি ভাষার প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহারকারীর সঙ্গে অন্যদের দূরত্ব রচনা করতে পারে। অনেকেই আছেন যাঁদের কাছে ইংরেজি বলার এই প্রবণতা ধরা দেয় অহংকার, উচ্ছৃঙ্খলতা কিংবা অসামাজিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। তবে শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণে যদি উন্নাসিকতা প্রকাশ পায়, তবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে এবং স্কুল কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে অবশ্যই মনোযোগী হতে হবে। ইংরেজির পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা যেন বাংলা ভাষা ও সামাজিক গুণাবলি সঠিকভাবে অর্জন করতে পারে, সে ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে এবং নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ। একজন শিক্ষার্থী মানে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি। তাই বাংলাদেশে বসবাস করে বাংলা ভাষায় আনাড়িপনা কখনোই একটি স্কুলের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে না।
শিক্ষায় ভাষার ব্যবহার যা-ই হোক না কেন, শিক্ষার মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মূল্যবোধসম্পন্ন, নান্দনিক এবং মানবিক গুণাবলিসমৃদ্ধ আগামী প্রজন্ম তৈরি করা, যারা হবে যুগোপযোগী শিক্ষায় এবং কর্মদক্ষতায় পরিপূর্ণ মানবসম্পদ। শিক্ষার অর্থ বাংলায় কিংবা ইংরেজিতে কেবল বলতে, পড়তে কিংবা লিখতে পারা নয়। বরং শিক্ষা হচ্ছে এমন কিছু যা অর্জনের মাধ্যমে মনোজগতের ইতিবাচক পরিবর্তন আনা যায়, যার দ্বারা একজন মানুষ তাঁর ব্যক্তি এবং কর্মজীবনে ভালো-মন্দের তারতম্য বুঝতে সক্ষম হন, যেকোনো কিছুকে সহজেই বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণ করতে পারার সক্ষমতা অর্জন করেন, নিজেরা পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হন এবং অন্যের বিকাশেও সহায়ক ভূমিকা পালন করেন।
ভাষা ব্যক্তির আবেগ-অনুভূতি, চিন্তাচেতনা প্রকাশের এক অনন্য মাধ্যম। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তের ভাষা উৎপত্তির উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন; আর তা হলো যোগাযোগ স্থাপন। কিন্তু ভাষা যোগাযোগকে সহজতর না করে তা যদি শিক্ষার্থীদের ভিনগ্রহের প্রাণী হিসেবে গড়ে তোলে, তবে তা হবে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। প্রতিটি ভাষারই রয়েছে নিজস্ব সৌন্দর্য। প্রতিটি ভাষায় রয়েছে আন্তরিকতা, বিনয় ও সৌহার্দ্য প্রকাশের যথেষ্ট উপকরণ। তাই উন্নাসিক মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে গড়ে ওঠার জন্য কখনোই একটি ভাষা দায়ী হতে পারে না। বরং এই মানসিকতার জন্য দায়ী হলো শিক্ষার গুণগত মানের দৈন্য, সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব এবং নিম্নমানের মূল্যবোধের চর্চা।

নিশাত সুলতানা: শিক্ষা গবেষক, একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কর্মসূচি সমন্বয়কারী।