চা-বাগানে কর্মরত মায়েদের প্রজননস্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়

>

গত ১৯ নভেম্বর ২০১৭, প্রথম আলোর আয়োজনে ‘চা-বাগানে কর্মরত মায়েদের প্রজননস্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

সহযোগিতায়: UNFPA

গত ১৯ নভেম্বর ২০১৭, প্রথম আলোর আয়োজনে ‘চা-বাগানে কর্মরত মায়েদের প্রজননস্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
গত ১৯ নভেম্বর ২০১৭, প্রথম আলোর আয়োজনে ‘চা-বাগানে কর্মরত মায়েদের প্রজননস্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।


আলোচনায় সুপারিশ

চা-শ্রমিক মায়েদের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে

স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো ও ওষুধের পর্যাপ্ত সরবরাহ জরুরি

গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন

চা-বাগান অঞ্চলের যাতায়াতব্যবস্থার উন্নয়নসহ রোগীদের রেফারেল ব্যবস্থা িনশ্চিত করা জরুরি

শ্রমিকদের স্বাস্থ্য উন্নয়নে মালিক–শ্রমিকদের মধ্যে আলোচনা দরকার    

মা ও শিশুদের পুষ্টি কার্যক্রম জোরদার করতে হবে

বাল্যবিবাহ রোধসহ পরিবার পরিকল্পনা জোরদার করতে হবে

স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল যেমন িমডওয়াইফ নিয়োগ করতে হবে

আলোচনা 

আব্দুল কাইয়ুম: মৌলভীবাজারসহ দেশের বিভিন্ন চা-বাগানে অনেক নারী শ্রমিক কাজ করেন। তাঁদের বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে।

িবশেষ করে তাঁদের প্রজননস্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু চা–বাগানে সুযোগ–সুবিধা থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় কম। প্রসূতি মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। এসব বিষয় নিয়েই আজকের আলোচনা। এখন আলোচনার সূচনা করবেন মো. আব্দুস শহীদ।

মো. আব্দুস শহীদ
মো. আব্দুস শহীদ

মো. আব্দুস শহীদ: চা-শ্রমিকেরা ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছেন। ইংরেজরা তাঁদের এ দেশে নিয়ে এসেছিল। এখনো তাঁরা এ দেশে অবস্থান করছেন। আমি ২৭ বছর ধরে নির্বাচিত হয়ে আসছি।

আমার ভোটদাতাদের বিরাট একটি অংশ চা-শ্রমিক। প্রায়ই চা-বাগানে যাই। তাঁদের সঙ্গে আমার আলাদা একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাঁরা আমাকে ভালোবাসেন। আমিও তাঁদের ভুলতে পারি না। তাঁদের উন্নয়নে কাজ করার চেষ্টা করি। এ ধরনের আলোচনার গুরুত্ব অনেক বেশি।

সমাজে বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারের জন্য অনেক ক্ষেত্রে চা–বাগানের নারী শ্রমিকেরা বৈষমে্যর শিকার হন। চা-বাগানে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। মা সুস্থ না হলে সমৃদ্ধ জাতি পাব না। চা-শ্রমিকদের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে হবে। শ্রমিকেরা যদি অতিরিক্ত কাজ করেন, অবশ্যই অতিরিক্ত মজুরি দিতে হবে। নারী শ্রমিকদের প্রজননস্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে আইন দরকার।

মো. আশরাফুল আলম খান
মো. আশরাফুল আলম খান

মো. আশরাফুল আলম খান: এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) অর্জনে মা ও শিশু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশ বা উন্নত দেশের জন্য আমরা কাজ করছি। চা-বাগানে আগে যে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল, তার থেকে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এর পেছনে মিডওয়াইফ একটি বড় ভূমিকা রাখছে।

এ জন্য ইউএনএফপিএ কাজ করছে। চা-বাগানের যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত না। তাই মা ও শিশু উন্নত চিকিৎসার জন্য শহরে আসতে পারে না। চা-বাগানের মায়েদের মাতৃত্বকালীন সময়েও কাজ করতে হয়। চা-বাগানে কুসংস্কার কাজ করে। নবজাতকের ভালোভাবে যত্ন নেওয়া হয় না।


সাথীয়া দোরাসস্বামী
সাথীয়া দোরাসস্বামী

সাথীয়া দোরাসস্বামী: বাংলাদেশ এখন আধুনিক একটি দেশ। বাংলাদেশ যে ধরনের সম্মান অর্জন করছে, এই অঞ্চলে তা তুলনাহীন। প্রধানমন্ত্রী শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার জন্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। একটু সচেতন হলেই শিশুমৃত্যুর হার আরও কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে পাশাপাশি প্রজননস্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করতে হবে।

সাধারণত পরিবারের সদস্যদের গর্ভবতী মায়ের সঠিক পরিচর্যা সম্পর্কে না জানা, অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, হাসপাতালে সঠিক সময়ে পৌঁছাতে না পারা এবং দক্ষ নার্স বা মিডওয়াইফ না থাকায় মাতৃমৃত্যু হয়ে থাকে।

বাংলাদেশকে একটি স্থিতিশীল ও উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বদরবারে পরিচিতি পাওয়ার লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে একটি অঞ্চলের সবাইকে সমানভাবে গণ্য করার এবং সত্যিকার অর্থে যারা পিছিয়ে আছে, তাদের দিকে বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে। বৈষম্য দূর করতে হবে। মানসম্পন্ন সেবা দিতে হবে।

পার্থ সারথী দত্ত কানুনগো
পার্থ সারথী দত্ত কানুনগো

পার্থ সারথী দত্ত কানুনগো: স্বাস্থ্যসেবা, প্রতিরোধমূলক সেবা ও চিকিৎসাসেবা—সুস্থ ও সবল থাকতে হলে এই তিন ধরনের সেবা প্রয়োজন। তবে সবার আগে অবশ্যই আমাদের প্রতিরোধমূলক সেবা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। শুধু নির্দিষ্ট কিছু বাগানেই না, সব চা-বাগানে জরিপ করে স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করে সময়মতো সরকারি হাসপাতালে মায়েদের পাঠাতে হবে।

চা-বাগানের প্রায় অধিকাংশ শ্রমিক কম লেখাপড়া জানেন। ফলে তাঁদের গর্ভবতী মা বা কিশোরী গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে কোনো ধারণা থাকে না। আমাদের উচিত বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে চা–বাগানে কর্মরত গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন করা এবং তাঁদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রমুখী করা।


সত্যকাম চক্রবর্তী
সত্যকাম চক্রবর্তী

সত্যকাম চক্রবর্তী: মৌলভীবাজারে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন করতে হলে অবশ্যই চা-বাগানে কর্মরত মায়েদের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন করতে হবে। চা-বাগানে বাল্যবিবাহ কমাতে হবে। জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমেরও উন্নতি করতে হবে। পাশাপাশি স্যানিটেশন–ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। এই অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নের জন্য মিডওয়াইফ সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে মিডওয়াইফ নিয়োগ দিতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা খাতে প্রশিক্ষিত জনশক্তি বাড়াতে হবে।

চা-বাগানে জন্মনিবন্ধন ও প্রসবকালীন পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে পরিবার পরিকল্পনার বিষয়টি নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। চা-বাগানে মা ও শিশুস্বাস্থ্যসেবায় সরকার পঞ্চায়েত, শ্রমিক প্রতিনিধি, মালিকপক্ষ ও ইউপি জনপ্রতিনিধির সমন্বয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

অনিমেষ বিশ্বাস
অনিমেষ বিশ্বাস

অনিমেষ বিশ্বাস: ভৌগোলিক অবস্থান ও দুর্গম এলাকা থাকার কারণে অন্যান্য বিভাগের তুলনায় সিলেট বিভাগে মাতৃমৃত্যুর হার বেশি। ২০১৪ সালে স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী মৌলভীবাজার জেলায় ১২০টি মাতৃমৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে ৪৭টি মৃত্যুই চা-বাগানসংলগ্ন এলাকায়, যা মাতৃমৃত্যুর প্রায় ৩৯ শতাংশ। চা-বাগানের হাসপাতালে মাতৃস্বাস্থ্যব্যবস্থা দেওয়া হলেও দক্ষ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর ঘাটতির কারণে সেবার মানকে উন্নত করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, ওষুধ ও উপকরণের ঘাটতি রয়েছে।

চা-বাগানে প্রায় ৫৪ শতাংশ মায়ের গর্ভকালীন সেবা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ মা কোনো গর্ভকালীন সেবা গ্রহণ করেননি। ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ মা তাঁর সর্বশেষ গর্ভাবস্থায় একটি মাত্র গর্ভকালীন সেবা গ্রহণ করেছেন এবং মাত্র ৪ দশমিক ৭ শতাংশ মা তাঁর সর্বশেষ গর্ভাবস্থায় চার বা ততোধিক সেবা গ্রহণ করেছেন। ৭৭ শতাংশ মায়ের প্রসব হয় বাড়িতে।

শামসুজ্জামান
শামসুজ্জামান

শামসুজ্জামান: আমরা চা-বাগানগুলোয় মিডওয়াইফের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে কিছু পরিবর্তন করেছি। কিন্তু এই পরিবর্তনের পরিসর খুবই কম। বিরাট এই চা-বাগান অঞ্চলের সব শ্রমিকের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন করতে হলে বড় পরিসরে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আর তা করতে হলে অবশ্যই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে।

তার পাশাপাশি চা-বাগানগুলোর মালিকপক্ষকেও এই কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। যে চা-শ্রমিকেরা বিশাল এই শিল্পের চালিকাশক্তি, তাঁদের কল্যাণে কাজ করা মালিকদের দায়িত্ব। একটি পরিবারে একটি মা মারা গেলে বা একটি শিশু মারা গেলে সেই পরিবারের লোকজনকে কী দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তা আমরা জানি। এই করুণ দুর্ভোগ থেকে তাদের রক্ষা করার জন্য সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

রিতা তাঁতী
রিতা তাঁতী

রিতা তাঁতী: বর্তমানে আমার একটি সন্তান আছে। এই সন্তানের আগে সঠিক স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ায় আমার আরও দুটি সন্তান মারা গেছে। আগের দুটি সন্তান যখন আমার গর্ভে ছিল, তখন গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্যের যত্ন সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। ফলে, আমার দুটি সন্তান মারা গেছে। তখন আমি সচেতন থাকলে হয়তো আমার সন্তান দুটি আজ বেঁচে থাকত।

আমার মতো হাজারো মায়ের সন্তান হারানোর বেদনাদায়ক গল্প চা-বাগানগুলোতে রয়েছে। একটু সচেতনতার অভাবে তারাও তাদের আদরের সন্তানকে হারিয়েছে।

হাসনা আক্তার
হাসনা আক্তার

হাসনা আক্তার: জন্মের সঙ্গে রিতা তাঁতীর দুটি সন্তান মারা গিয়েছিল। কারণ তখন কোনো দক্ষ ধাত্রী ছিল না। প্রথম সন্তানের জন্মের সময় নবজাতকের পা প্রথমে চলে আসে। দ্বিতীয় সন্তান জন্মদানের সময় শিশুর মাথা আটকে যায়। একজন মিডওয়াইফ হিসেবে রিতা তাঁতীকে পরামর্শ দেওয়ায় শেষ সন্তান হয়েছে স্বাভাবিকভাবে। মা ও সন্তান দুজনই সুস্থ আছে। রিতা তাঁতীর মতো অসংখ্য মা একটু যত্ন আর সচেতনতার অভাবে তাঁদের আদরের সন্তানকে হারিয়েছেন। অথচ গর্ভাবস্থায় চা–বাগানে কর্মরত মায়েদের জন্য একটু উন্নত সেবা আর সঠিক পরামর্শের ব্যবস্থা করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। সরকারি–বেসরকারি ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা উদ্যোগ গ্রহণ করলে এবং রিতা তাঁতীদের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে পারলে হাজারো মা ও শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব।

সৈয়দ আবু জাফর মোহাম্মদ মুসা
সৈয়দ আবু জাফর মোহাম্মদ মুসা

সৈয়দ আবু জাফর মোহাম্মদ মুসা: মৌলভীবাজারে যত মা মারা গেছেন, তার ৩৯ শতাংশ চা-বাগান এলাকার। এটাই কিন্তু দিকনির্দেশনা করে আমাদের কী করণীয়। প্রজননস্বাস্থ্য একটি শব্দ। কিন্তু অনেক বিষয়ের সেবা নিয়ে এটা গঠিত। এর মধ্যে আছে প্রসব–পূর্ব, প্রসব–উত্তর, প্রসবকালীন জরুরি সেবা, প্রসূতিসেবা ও পরিবার পরিকল্পনাসেবা।

আমরা এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে পারিনি। তার একটা কারণ, স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান যতটা উন্নত করার প্রয়োজন ছিল, ততটা এখনো হয়নি।

তা ছাড়া প্রজননস্বাস্থ্যসেবা, গর্ভপাত, প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ, প্রজননতন্ত্রের মাধ্যমে সংক্রমিত রোগসমূহ, নারীর প্রতি সহিংসতা, জরায়ুর ক্যানসার—এগুলো চা–বাগানের শ্রমিকদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা। এর সঙ্গে বাল্যবিবাহও মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারা যেমন হাসপাতালে যাওয়া, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ, পরিবার পরিকল্পনায় অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অধিকার নিশ্চিত করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিজয় বুনার্জী
বিজয় বুনার্জী

বিজয় বুনার্জী: অনেক আগে থেকেই চা-শ্রমিকেরা খুবই মানবেতর জীবন যাপন করে আসছেন। তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। চা-বাগানে অনেক শ্রমিক মা আছেন। তাঁরা প্রতিদিনের মজুরি দিয়ে প্রতিদিন চলেন। অনিবন্ধিত হওয়ার কারণে কারও কারও অবস্থা আরও করুণ। তাঁদের জন্য কোনো বিশেষ সুযোগ–সুবিধা নেই।

চা-বাগান এলাকায় আরও কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রয়োজন। বর্তমানে যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো রয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। ফলে দেখা যায়, অনেক দুর্গম অঞ্চলে বসবাসকারী চা-শ্রমিকদের জন্য এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে সেবা গ্রহণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এম এ হালিম
এম এ হালিম

এম এ হালিম: চা জনগোষ্ঠী অন্তর্মুখী। তারা দরজা পেরিয়ে সাধারণত মালিকদের সঙ্গে কথা বলতে পারে না। সরকারি হাসপাতালে তারা তাদের অধিকারের কথা বলতে পারে না। সত্যিকার অর্থে চা-বাগানে বিশেষ সেবা প্রদান দরকার।

মনে হতে পারে একজন মিডওয়াইফ দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু না। মায়েদের প্রজননস্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন করা না হলে মিডওয়াইফ ও মায়েদের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি হবে না।

আমরা বাগান থেকে বাছাই করে বাগানের মেয়েদের মাধ্যমে মায়েদের সচেতন করার চেষ্টা করছি। বাগানে যে রকমই হোক, একটি হাসপাতাল আছে। ওখানে একজন ডাক্তার, কর্মী সংখ্যা বাড়ানো, মিডওয়াইফের সংখ্যা বাড়ানো ও মান উন্নত করা দরকার।

কমিউনিটি হাসপাতাল আরও সহজ ও উন্নত করা দরকার। আমরা যারা কাজ করছি, তারা একটা মডেল তৈরি করছি। এখন সরকার নজর দিলে মাতৃমৃত্যুর হার কমানো যাবে।

ফিলিপ গাইন
ফিলিপ গাইন

ফিলিপ গাইন: চা-বাগানের শ্রমিক আমাদের দেশে এক ভিন্ন ধরনের শ্রমিক। সম্ভবত এরা পঞ্চম প্রজন্মের শ্রমিক। গত কয়েক বছর ১৫৬টি চা-বাগানে গবেষণা করে ৮০টি জনগোষ্ঠী পেয়েছি। এই ৮০টি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি রয়েছে।

চা-শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও কর্মপরিবেশ স্বাস্থ্যবান্ধব না। একজন মা সারা দিন দাঁড়িয়ে সূর্যের তাপে, বৃষ্টিতে ভিজে দিনে দুবার ২০–৩০ কেজি চা-পাতা তুলে মাথায় করে নেন। তাঁরা যে শ্রম দেন, সে অনুপাতে খাদ্য গ্রহণ করেন না। তাঁদের খাবারের মানও স্বাস্থ্যকর না।

শ্রম নীতিমালা কতটা মেনে চলা হয় চা-বাগানে? কর্মপরিবেশ ও বসবাসের স্থানের বিষয়টিও মানা হয় না। আমরা দু-চারটা সেবা দিতে পারি। কিন্তু কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

রামভজন কৈরী
রামভজন কৈরী

রামভজন কৈরী: আজকেরআলোচনায় চা–বাগানে কর্মরত মায়েদের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু চা-বাগানে কর্মরত ছাড়াও অনেক মা আছেন। তাঁদের কথাও ভাবতে হবে।

চা-বাগান মালিকদের ধারণা, চা-শ্রমিকদের শুধু বাগানে কাজ করার জন্য জন্ম হয়েছে। তাঁদের আর কিছু নেই। এই চিন্তার উন্নতি করতে হবে। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলা বা বসার উদাহরণ খুব কম। চা-বাগানে মায়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় চা-বাগানমালিকদের অংশগ্রহণ জরুরি। চা-বাগানে যে চিকিৎসাব্যবস্থা আছে, তা উন্নত না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। নেই কোনো মা ও শিশুবিষয়ক চিকিৎসক। চা-বাগানে একজন এমবিবিএস ও একজন গাইনি চিকিৎসক দরকার।

চা-বাগানে শ্রম আইন আছে কিন্তু তার সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে না। চা-বাগানের মালিকেরা যখন আমাদের কথা শোনেন না, তখন আমরা বিভিন্ন সংগঠনের কাছে যাই। কিন্তু খুব ভালো কোনো ফল বা উত্তর আমরা পাই না।

কাজী দিল আফরোজা ইসলাম
কাজী দিল আফরোজা ইসলাম

কাজী দিল আফরোজা ইসলাম: মায়েদের প্রজননস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে চা-বাগানের মালিকদের সংযুক্ত করা প্রয়োজন। সরকার অনেক কিছু করছে। কিন্তু বাগানমালিক এ বিষয়ে কম ভূমিকা রাখছেন। ইউনিসেফ শ্রীলঙ্কা ও ভারতে কাজ করছে বাগানমালিকদের সঙ্গে। চা-বাগানের মা ও শিশু যদি সুস্থ থাকে, তাহলে উৎপাদন অনেক বেড়ে যায়। এতে বাগানের মালিকেরাই লাভবান হন। ইউনিসেফ চা-বাগানের মালিক-শ্রমিকদের সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করছে।

মাতৃমৃত্যুর অনেক কারণ আছে। একজন মা যদি সব সুবিধা না পান, তবে মাতৃমৃত্যু কমবে না। শিক্ষা, সচেতনতা, পারিবারিক আয় এ ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখে।

ইউনিসেফ ও ইউএনএফপিএ কিছু বাগানে কাজ করছে। আমরা কিছু বাগানকে উদাহরণ িহসেবে দেখাতে পারি। এ উদাহরণ যদি সব বাগানমালিক ও শ্রমিক গ্রহণ করেন, তবেই উন্নতি সম্ভব।

এস এম উমেদ আলী
এস এম উমেদ আলী

এস এম উমেদ আলী: গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আমরা যখন মাঠে যাই, তখন স্বাস্থ্যনীতির প্রয়োগ খুব কম দেখতে পাই। প্রান্তিক অঞ্চলের এই মানুষগুলোর জন্য স্বাস্থ্যনীতির প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোই এই অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের জন্য একমাত্র ভরসা।

একজন মা যখন গর্ভকালীন পরিশ্রম করেন, তখন তিনি যে খাবার গ্রহণ করেন, তা পুষ্টিকর না। তাঁরা পুষ্টি সম্পর্কে সচেতন নন। আবার তাঁরা যে মজুরি পান, তা দিয়ে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা খুবই কষ্টকর। সার্বিকভাবে যদি স্বাস্থ্য সম্পর্কে মায়েদের সচেতনতা বাড়ানো যায় এবং তাঁরা তাঁদের গর্ভকালীন বিপদ সম্পর্কে অবগত হন, তাহলে তাঁদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক কমে যাবে।


মো. জয়নাল আবেদীন টিটো
মো. জয়নাল আবেদীন টিটো

মো. জয়নাল আবেদীন টিটো: সব নারীর প্রতিই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সমান। চা-বাগানের গর্ভাবস্থায় একজন নারীর স্বাস্থ্যশিক্ষা সম্পর্কে যে সচেতনতা দরকার, তার অভাব আছে। আবার নানা রকম কুসংস্কারও রয়েছে। এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না। চিকিৎসার জন্য কোথায় যাবেন, কী করবেন—এ সম্পর্কে জানার অভাব আছে। যদি হাসপাতালে কেউ না আসেন, তাঁকে বুঝিয়ে বলতে হবে। তাঁর মধ্যে যদি কোনো বিপদের লক্ষণ দেখা যায়, তাঁকে হাসপাতালে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

আমরা আমাদের হাসপাতালে সব ধরনের সেবা দিচ্ছি। চা-বাগানে নারীদের স্বাস্থ্যসেবায় প্রথমেই বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে। কুসংস্কার দূর করতে হবে। তাঁদের সচেতন করে তুলতে হবে। প্রসবের সময় অবশ্যই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা হাসপাতালে নিতে হবে। দুর্গম এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করতে হবে। যেসব এলাকায় যোগাযোগ খারাপ, সেখানে মিডওয়াইফ নিয়োগ দিতে হবে।

এম এ মান্নান
এম এ মান্নান

এম এ মান্নান: চা-বাগানে প্রসবকালীন মৃত্যু বেশি। নিউমোনিয়া, পুষ্টিহীনতা, ইনফেকশনসহ নানা রকম জটিলতায় মৃত্যু হচ্ছে। চা-বাগানে কম্পাউন্ডারদের দক্ষতা বাড়াতে হবে।

এ ছাড়া মৌলভীবাজার অঞ্চলের বেশির ভাগ চা–বাগানই দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ার কারণে এসব অঞ্চলে জরুরি ওষুধের সরবরাহ ঠিকমতো থাকে না। চা–বাগানের শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।


অর্ধেন্দু কুমার দেব
অর্ধেন্দু কুমার দেব

অর্ধেন্দু কুমার দেব: অনেক চা-বাগানের ভেতরে যাওয়া যায় না। আমরা প্রতিটি চা-বাগানের ভেতর দিয়ে রাস্তা নিয়ে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে ৭০ শতাংশ চা-শ্রমিকের এলাকায় পাকা রাস্তা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রায় ৮০ শতাংশ চা-শ্রমিকের ঘরে বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান, পরিবেশ, পানি, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। তা সমাধানের লক্ষ্যে কাজ চলছে। চা-বাগান এলাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হচ্ছে।

লাজ্জাত এনাব মহছি: চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকার অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে চা-বাগানের মালিক বা কর্তৃপক্ষ কতটুকু করছে, তা পরিষ্কার না। এটা জানা দরকার।

আমরা বলছি, কুসংস্কারের কারণে তাঁরা হাসপাতালে যেতে চান না। তাঁরা কি আসলে হাসপাতালে যাওয়ার সময় পান! তাঁকে কি সময় দেওয়া হচ্ছে? আমরা বলছি, পুষ্টিকর খাবার দরকার। কিন্তু পুষ্টিকর খাবার কেনার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, তাঁদের মালিক কি সেই মজুরি দিচ্ছেন!

যে টাকা মজুরি পান, প্রতিদিনের চাল কিনতেই তা শেষ হয়ে যায়। পুষ্টিকর খাবার কোথা থেকে আনবে? তাঁরা যে অতিরিক্ত শ্রম দেন, তার জন্য কি তাঁরা অতিরিক্ত টাকা পাচ্ছেন? যতটা বিশ্রাম দরকার, ততটা কি বিশ্রাম নিতে পারছেন? চা-শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতি করতে হলে তাঁদের দিকে সবার আরও বেশি নজর দিতে হবে।

মো. আব্দুস শহীদ: চা–বাগানে অনেক ধরনের নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী কাজ করে। দেশের সংবিধানে সব শ্রেণি–পেশার মানুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে কুসংস্কার আছে। অনেকে সমাজের কিছু মানুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করেন। এটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। আমরা এটা কখনো প্রত্যাশা করি না।

সিলেট অঞ্চলের চা-বাগানে কর্মরত নারী শ্রমিকসহ সব নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের সহায়তায় চা-বাগানের নারী শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়ন হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা চালু করেন। প্রসূতি মায়ের স্বাস্থ্য ঠিক রাখা অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে তিনি বিভিন্ন জটিল সমস্যায় পড়বেন। তাঁর নবজাতক সন্তানের জীবনেও বিভিন্ন ঝুঁকি তৈরি হবে। আজকের আলোচনা আমাদের এসব বিষয়ে আরও ভূমিকা রাখতে সহায়তা করবে।

আব্দুল কাইয়ুম: চা–বাগানে কর্মরত মায়েরা শ্রমের মাধ্যমে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। তাঁদের স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখা বাগানমালিকসহ আমাদের সবার দায়িত্ব।

এই দায়িত্ব আমরা সবাই পালনের মাধ্যমে চা–শ্রমিক মায়েদের জন্য নিরাপদ মাতৃত্ব িনশ্চিত করব, এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।

যাঁরা অংশ নিলেন

মো. আব্দুস শহীদ           : মাননীয় সাংসদ, মৌলভীবাজার-৪

মো. আশরাফুল আলম খান : অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), মৌলভীবাজার

এম এ মান্নান                : সহকারী উপপরিচালক, জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ

সত্যকাম চক্রবর্তী            : সিভিল সার্জন, মৌলভীবাজার

পার্থ সারথী দত্ত কানুনগো : তত্ত্বাবধায়ক, মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল

রামভজন কৈরী             : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন

মো. জয়নাল আবেদীন টিটো        : স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, শ্রীমঙ্গল

বিজয় বুনার্জী                :     চেয়ারম্যান, রাজঘাট ইউনিয়ন পরিষদ, শ্রীমঙ্গল

অর্ধেন্দু কুমার দেব           : সাধারণ সম্পাদক, শ্রীমঙ্গল পৌর আওয়ামী লীগ

এস এম উমেদ আলী        : সাধারণ সম্পাদক, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব

ফিলিপ গাইন               : নির্বাহী পরিচালক, শেড

অনিমেষ বিশ্বাস             : সহযোগী পরিচালক, সিআইপিআরবি

সৈয়দ আবু জাফর মোহাম্মদ মুসা  :           উপদেষ্টা, ইউএনএফপিএ

সাথীয়া দোরাসস্বামী       : স্বাস্থ্য বিভাগ প্রধান, ইউএনএফপিএ

কাজী দিল আফরোজা ইসলাম      : সিলেট বিভাগীয় প্রধান, ইউনিসেফ

শামসুজ্জামান                : প্রজেক্ট টেকনিক্যাল কর্মকর্তা, ইউএনএফপিএ

এম এ হালিম               : পরিচালক, সিআইপিআরবি

রিতা তাঁতী                   : নারী চা-শ্রমিক

হাসনা আক্তার              : মিডওয়াইফ

লাজ্জাত এনাব মহছি        : উপসম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালক

আব্দুল কাইয়ুম          : সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো