বাম জোটের বিজয় ও ভূরাজনৈতিক নাগরদোলা

এএফপি ফাইল ছবি
এএফপি ফাইল ছবি

নেপালের জাতীয় নির্বাচনের ফল দেখে নেপালি কংগ্রেস ও তার আন্তর্জাতিক মিত্র ছাড়া আর কেউ অবাক হয়েছে বলে মনে হয় না। এমন শোচনীয় পরাজয়ের আশা ৫০ বছরের পুরোনো দলটির শত্রুরাও করেনি। জনগণ হলো রাজনৈতিক গণিতের সেই ‘এক্স’ ফ্যাক্টর; যার মান আগাম অনুমান করা যায় না। পরাশক্তির চাওয়া, বনেদি দলের নামজাদা নেতাদের শোভা, ক্ষমতাসীন থাকার সুবিধা-কিছুই কাজে আসেনি কংগ্রেসের। চূড়ান্ত ফল ঘোষিত না হলেও বাম জোটের নিরঙ্কুশ বিজয়ের সম্ভাবনাই বেশি। ১৬৫ আসনের সংসদে বাম জোটের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিএন-ইউএমএল) পেয়েছে ৮০ আসন, অপর শরিক মাওবাদী সেন্টারের দখলে ৩৬টি আসন। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ২৩টি আসন। কেপি অলির কমিউনিস্ট পার্টি আর পুষ্প কমল দহল ওরফে প্রচন্ডের নেতৃত্বে নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা নিয়ে দ্বিধা নেই। অলিই গণতান্ত্রিক নেপালের নেতৃত্ব দেবেন। বাম জোট ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, নির্বাচনের পর তারা এক দল হয়ে যাবে।

ভোটের সময় শুনতে পাই, সামনে আসছে শুভ দিন, অমুক মার্কায় ভোট দিন। বেশির ভাগ নেপালিরই বিশ্বাস, শুভ দিন আসছে। গত ২৪ থেকে ২৯ নভেম্বর, নেপালের সাধারণ মানুষ, উচ্চপদস্থ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, তরুণ, সাংবাদিকসহ যাঁদের সঙ্গেই কথা হয়েছে, তাঁদের মধ্যেই শুভ দিনের আশা দেখেছি-যদিও তাঁরা ছিলেন ভিন্ন ভিন্ন দলের সমর্থক। এই জয় শুধু বাম জোটের নয়; নেপালের প্রধান তিন দল ইউএমএল, মাওবাদী, কংগ্রেস ও আরজেপিএন (রাষ্ট্রীয় জনতা পার্টি-নেপাল)-প্রতিটি দলই এই জয়ের অংশীদার।

নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে আস্থাশীল রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাকলে কী হয়, দক্ষিণ এশিয়ায় তার উদাহরণ নেপাল। সংবিধান প্রণয়ন করে স্থানীয়, প্রাদেশিক ও জাতীয়-এই তিন নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করতে পারা কম কথা নয়। প্রথমত যে নির্বাচনে কংগ্রেস পরাজিত হলো, সেই নির্বাচনকালীন সরকারের পরিচালকের আসনে ছিল তারাই; কংগ্রেস নেতা শের বাহাদুর দিউবা এখনো সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী। আবার গত সেপ্টেম্বর মাসের স্থানীয় নির্বাচনে তৃতীয় হওয়া মাওবাদীরা বিরোধী দলে থেকেও নির্বাচনকালীন সরকারের অংশ ছিলেন, যদিও তাঁরা মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেননি। বাম জোটের একাংশ (মাওবাদী) নির্বাচনকালীন সরকারে থাকায়, তাদের জোটসঙ্গী ইউএমএলও নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে আশ্বস্তই ছিল।

নেপালের রাজনীতির উদীয়মান শক্তি হলো আরজিপি-এন। ভারতঘেঁষা বলে পরিচিত আরজেপি মাধেসি অঞ্চলের ১০টি আসন পেয়েছে আর বিজয়ী হয়েছে একটি প্রদেশে। তাদের একজন প্রার্থী গণহত্যার অভিযোগ মাথায় নিয়েও বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। যাহোক, আরজেপি প্রথম দিকে নির্বাচন বয়কটের কথা বলে এলেও শেষ পর্যন্ত কৌশল পরিবর্তন করে নির্বাচনী মহাযজ্ঞে প্রবেশ করে। অভিযোগ রয়েছে, ভারত এই নির্বাচন স্থগিত করার পক্ষপাতী ছিল এবং আরজেপিই ছিল তাদের প্রধান হাতিয়ার। আরজেপি বেঁকে বসলে নেপালি কংগ্রেসও নির্বাচন স্থগিত করার মওকা পেতে পারত। তাহলে নেপাল আরেকবার অস্থিতিশীলতায় পড়ত। সেই অবস্থায় কংগ্রেসকে সরানোরও পথ থাকত না। কিন্তু সব চাপ উপেক্ষা করে আরজেপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসে। নেপালের গণমাধ্যমে তাই বিজয়ী বাম জোটের পাশাপাশি কংগ্রেসের গণতান্ত্রিকতা, আরজেপির বিচক্ষণতারও প্রশংসা চলছে।

নেপাল গত ১০ বছরে ৯টি সরকার পেয়েছে, দুই দফা সংবিধান সভার নির্বাচন হয়েছে, দুই দশক পর এবারই স্থানীয় সরকার নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হলো। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সমান্তরালে ২৬ নভেম্বর ও ৭ ডিসেম্বর দুই দফায় নবগঠিত প্রাদেশিক সরকার নির্বাচনও হয়ে গেল। সবকিছুই হতে পারল যে সংবিধানের অধীনে, সেই সংবিধানসভার প্রধান দল ছিল কিন্তু বিদায়ী কংগ্রেস। সুতরাং কংগ্রেস পরাজিত হলেও নেপালিরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে দুটি কারণে। এক. তাদের নেতৃত্বে সর্বদলীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নেপাল রাজতন্ত্র থেকে উত্তরিত হয়ে প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান রচনায় সক্ষম হয়েছে। দুই. নিজেদের পরাজয় নিশ্চিত জেনেও নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করায় তারা পিছপা হয়নি।

কংগ্রেস যদি এতই সাচ্চা, তাহলে পরাজিত হলো কেন? নেপালের জনগণের কাছে এখন দুটি ফ্যাক্টর প্রধান: দুর্নীতির বিস্তার ও ভারতের প্রভাব। সংবিধান প্রণয়নের সময় যখন তরাই অঞ্চলের মাধেসি দলগুলো বাধা দিল এবং তাদের সমর্থনে দাঁড়িয়ে গেল ভারত; চাপ হিসেবে ভারতের তরফে অঘোষিত অবরোধে স্থলাবদ্ধ নেপাল কঠিনভাবে ভুগতে থাকল; তখন কংগ্রেস দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়। ২০১৫ সাল বেশি দূরে নয়। সেই দুঃসহ অবরোধে যখন শহরবাসীদেরও কুপি জ্বালিয়ে রাত কাবার করতে হয়েছে, দ্রব্যমূল্যের দাম যখন বেড়ে গিয়েছিল ১২ শতাংশের বেশি, তখন ইউএমএল নেতা অলি শক্তভাবে দাঁড়ান। নেপালের নতুন জাতীয়তাবাদ তাঁর মধ্যে জাতীয় কণ্ঠস্বর খুঁজে পায়। রাজনীতি এমনই। ২০০৮ সালে নেপালের মাওবাদীরা যখন প্রধান রাজনৈতিক দল শুধু নয়, নেপালের গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রধান শক্তি হিসেবে হাজির হলো, তখন নেপালি কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির বাধা ও চক্রান্তেই সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়া ভেস্তে যায় এবং মাওবাদী সরকার পদত্যাগ করে।

মাধেসি দলের হঠকারী আচরণ ও অবরোধ চলেছিল যখন নেপাল ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত। সেই ভূমিকম্পে নয় হাজার মানুষের মৃত্যু হয় এবং বিধ্বস্ত হয় বেশির ভাগ অবকাঠামো। সে রকম সময়ে জাতিগত ভারতীয় মাধেসিদের আচরণ এবং ভারতের অবরোধ অধিকাংশ নেপালিকে বিষিয়ে তুলেছিল। সে সময় নেপালের জনগণ কেপি অলির রাষ্ট্রনায়কোচিত দৃঢ়তার প্রতিদান দিল তাঁকে বিজয়ী করে। ২০১৭ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে সিপিএন প্রধান দল হিসেবে বেরিয়ে আসে। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির পুনর্গঠন না হওয়া এবং অবরোধের সময়ের কষ্টের অভিজ্ঞতাই নেপালিদের পরিবর্তনের ব্যাপারে জেদি করে তুলেছে বলে ভাবা হয়। একসময়ের কংগ্রেস হয় তৃতীয় এবং ২০০৮ সালের বিজয়ী মাওবাদীরা হয় দ্বিতীয়। সংকটের সময় মাওবাদীদের দ্বিধাদ্বন্দ্বই তাদের পিছিয়ে পড়ার কারণ।

কংগ্রেস সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি এবং অভ্যন্তরীণ সমস্যা মেটানোর ব্যর্থতাই বাম জোটের বিজয়কে এমন নিরঙ্কুশ করেছে। এর মাধ্যমে নেপাল শুধু স্থিতিশীল সরকারই পেতে যাচ্ছে না, ভারতীয় অক্ষ থেকে চীনের দিকে আরও সরেও আসছে। নেপালের আমদানি-রপ্তানির প্রধান অংশই ভারতের সঙ্গে। নেপালের জনগণের সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম ও মেলামেশা তাদের সঙ্গে হলেও নেপাল সেই সম্পর্ককে অসম বলে মনে করে। এবার অধিকাংশ নেপালি এমনভাবে ভোট দিয়েছেন, যাতে সরকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দেশ চালাতে পারে এবং ভারতপন্থী নীতি থেকে সরে আসে। নেপালে এখন স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও জাতীয়তাবাদ এক কাতারে চলে এসেছে। তারা এমন উন্নয়ন চায়, যাতে দেশের স্বাধীনতা ও মর্যাদার সঙ্গে আপস করা হবে না। এমন উন্নয়ন চায়, যা দুর্নীতির মহাসড়কে গিয়ে পথ হারাবে না।

শক্তিশালী বাম সরকারের সামনে কেবল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিপদই নেই, রয়েছে ভূরাজনৈতিক নাগরদোলার চক্করও। সেই নাগরদোলায় মাথা ঘুরে যাওয়ার ভয় থাকে। চীন ও ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়ন চালাতে পারলে এবং ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয় ধরে রাখা গেলে নেপাল নিজেকে গুছিয়ে আনতে পারবে। এই দীর্ঘ ও কষ্টকর সফরে নেপালের রাজনৈতিক দলগুলো এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা যে রকম পরিপক্বতা দেখিয়েছেন, তা টিকিয়ে রাখা গেলে নেপাল শুধু মাথা তুলেই দাঁড়াবে না, উপমহাদেশের অনেককেই পথ দেখাতে পারবে।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk. wasif@prothom-alo. info