পিকনিক-মৃত্যু আর নয়

২০১৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যশোরের শার্শা উপজেলার ছোট আঁচড়া গ্রামের আকলিমা বেগমের বুকের ধন ইকরামুলকে সেদিন পিকনিকে মেহেরপুরে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর স্কুলের শিক্ষকেরা। ফেরার পথে তাদের বাস পানিতে পড়ে গেলে তার ৭ স্কুলবন্ধু নিহত হয়, আহত হয় ৩০ জন। গুরুতর আহত ৫ জনের একজন ছিল ইকরামুল। যশোর সিএমএইচে আট দিন অচেতন থাকার পর জ্ঞান ফেরে ২৩ ফেব্রুয়ারি। অস্ফুট স্বরে কিছু খেতে চায় সে। বিস্কুট ও পানি খেতে দেওয়া হয় তাকে। সে আবার জ্ঞান হারায়। যশোর থেকে তাকে পাঠানো হয় ঢাকায়। ২৮ ফেব্রুয়ারি ফজরের পর ইকরামুলের খাতা বন্ধ করে দেয় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল। মৃতের তালিকায় ওঠে ইকরামুলের নাম।

গুরুতর আহত বাকি চারজনের ভাগ্যেও কি একই ঘটনা ঘটেছিল? পরের মাসগুলোর পত্রিকা আর পড়া হয়নি। এমনটিই ঘটেছিল মিরসরাইয়ে ২০১১ সালের ১১ জুলাই। শিক্ষার্থীরা সেদিন ফিরছিল স্কুলের খেলা দেখে একটা খাঁচাবন্দী ট্রাকে। এক নিমেষে হারিয়ে যায় ৪৩টি প্রাণ। হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল মুমূর্ষু শিশুদের মাকুর মতো ছুটিয়ে নিয়ে যায় কর্তৃপক্ষ। মাস দেড়েক পর সবচেয়ে মুমূর্ষু দুজনকে সিঙ্গাপুরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। হাসপাতাল থেকে তাদের আর বিমানবন্দরে যেতে হয়নি। তাদের ছোট ছোট শরীর এসব নিয়ম রক্ষার ঢং আর সহ্য করতে পারেনি। ঘণ্টা বেজে যায় তাদের। তারা লাশ হয়ে ফেরে নিজ নিজ মায়ের কোলে।

অনেক শিশু একসঙ্গে মারা যাওয়ায় ২০১১ সালে চোখের জল ফেলেছিল সবাই। চোখের জল যতই ঝরুক, তা দিয়ে নদী হয় না, সেই নদীতে নৌকাও ভাসে না। কাজেই শোক প্রকাশ, শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত্বনা প্রদান, চাল-ডাল-টাকা প্রদান, ছবি তোলা, ছবি ছাপানোর মধ্যেই সবকিছু শেষ হয়ে যায়।

এ রকম পিকনিক-মৃত্যুর মিছিল থামেনি। এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আটটা পিকনিক-দুর্ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আলোড়ন তোলে। দুর্যোগ ফোরামের তথ্য তালিকা ও বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, এসব দুর্ঘটনায় শিক্ষকসহ প্রায় ২১ জনের মৃত্যু হয়, আহত হয়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারায় শতাধিক।

আগে একজন লিখেছিলেন, যাঁরা এতগুলো শিশুকে ট্রাকে তুলে দিয়েছিলেন, তাঁদেরও দায়িত্ব ছিল এটা দেখা যে ট্রাকটি কে চালাবেন, প্রকৃতই একজন ট্রাকচালক, নাকি হেলপার। হেলপারের হাতে এতগুলো প্রাণের নিরাপত্তা ছেড়ে দেওয়া মোটেই বুদ্ধির কাজ হয়নি। লেখক এইভাবে বোধ করি এক অর্থে খাঁচাবন্দী ট্রাকে শিশুদের পরিবহনকে অনুমোদন করেছিলেন। তিনি হয়তো বলতে চেয়েছিলেন, শুধু একজন পেশাদার চালক হলেই চলত। কিন্তু আমরা কি আমাদের সন্তানদেরও এ রকম একটা পরিবহনে উঠতে দেব? সেটা যে-ই চালাক না কেন?

শার্শার শিক্ষকেরা অবশ্য শিশুদের ট্রাকে নেননি, নিয়েছিলেন বাসে। বাসটিতে সব শিশুর জন্য পর্যাপ্ত আসন ছিল না, ওদের বসতে হয়েছিল গাদাগাদি করে। সব সময় এ রকমই হয়। বড়রা বসেন নিজ নিজ আসনে, ছোটরা বসে গাদাগাদি করে। পয়সা বাঁচিয়ে জমকালো পিকনিক করতে যাওয়া, সস্তা পরিবহন খোঁজা খুবই মামুলি ব্যাপার হয়ে উঠেছে। লাইনের বাস যখন সারা দিন থাকবে, তখন মালিক তাঁর সেরা বাসটি দেবেন না। তারপর দামাদামি করলে সেটাই দেবেন, যেটা দেওয়া যায়। চালাতেও দেবেন তাঁকে, যাঁকে লাইনের বাসে দিলে তাঁর দিল ধকধক করে। হেল্পারের দিন হয় পিকনিকের দিন।

দূরত্বও একটা প্রশ্ন। শিক্ষকদের তো ইচ্ছা হবেই এই মওকায় হিল্লিদিল্লি ঘুরে দেখি। তাঁদের দমের সঙ্গে শিশুদের দম তো মেলে না। শার্শার ছোট আঁচড়া থেকে মেহেরপুরের মুজিবনগর মোটেই বগলের কাছে নয়। সেখান থেকে ফিরতে রাত হবেই। তাড়াতাড়ি ফিরতে হলে হ্যাঁচকা টানে বাস চালাতে হবে।

স্কুলে পড়াশোনা চালানোর যেমন একটা নিয়মনীতি আছে, শিশুদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়া বা আনন্দ-উল্লাসের সঙ্গে একটা দিন কাটানোরও কিছু অবশ্যপালনীয় নিয়মনীতি থাকা প্রয়োজন। শিশুরা খেলবে, বেড়াবে, আনন্দ করবে—সেটা তাদের অধিকার এবং সুস্থ বিকাশের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু তার মাত্রাটা কেমন হবে, সেটা ঠিক করে দেওয়াও খুব জরুরি।

স্কুলের ছেলেমেয়েদের আনন্দ ভ্রমণের জন্য বা পিকনিকের জন্য খুব দূরে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। এমন দূরত্বে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, যেখান থেকে দিনের আলো থাকতে থাকতেই ফিরে আসা যায়। সব শিশু যেন সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরে যেতে পারে, পরিষ্কার নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত। জাতীয়ভাবে না হোক, জেলার শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটা জেলাভিত্তিক নীতিমালা কি খুব বেশি চাওয়া হবে? সেখানে পরিবহন, দূরত্ব, দিনের কর্মসূচি, ফিরে আসার সময় ইত্যাদি বিষয়ে দিকনির্দেশনা থাকবে এবং সেগুলো অমান্য করলে তার জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকবে।

এরপরও যদি দুর্ঘটনা ঘটে যায়, তাহলে কী করতে হবে, সেটাও পরিষ্কার করে বলে দিতে হবে। জরুরি চিকিৎসা এবং রেফারেল চিকিৎসার একটা সর্বজন স্বীকৃত প্রটোকল থাকতে হবে।

কেউ যদি এখন প্রশ্ন করে, কেন ইকরামুল আর ইয়ানুরকে প্রথমেই ঢাকায় পাঠানো হলো না? কেন দেশে অথবা বিদেশের সবচেয়ে ভালো চিকিৎসাটা প্রথম থেকে দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হলো না? তাহলে কী তার উত্তর হবে? আর যে উত্তর মিলবে, সেটা কতটুকু সন্তোষজনক হবে, গ্রহণযোগ্য হবে সবার কাছে? সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জানা থাকা প্রয়োজন, সরকারি কোষাগার থেকে
এসব জরুরি চিকিৎসার খরচ আসবে, নাকি বারবার প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নির্দেশ আসতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ব্যবস্থা নিতে না বললে আজকাল আর কেউই নড়েচড়ে বসেন না, কিছু করেন না।

ইকরামুলেরা চলে গেছে, আর যেন কেউ ইকরামুলদের সঙ্গী না হয়ে যায়, সরকারকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে। শিক্ষকদেরও জবাব দিতে হবে এসব অব্যবস্থাপনার। গাদাগাদি করে অনেক দূরে শিশুদের নিয়ে গিয়ে নিজেদের দেশ দেখার ইচ্ছা পূরণের চেষ্টাকে অপরাধ হিসেবেই দেখতে হবে। এসব ক্ষেত্রে এক চুলও ছাড় দেওয়া যাবে না, তা সে যে রঙেরই হোক না কেন।

কী করতে হবে
* স্কুলের ছেলেমেয়েদের এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া উচিত, যেখান থেকে দিনের আলো থাকতে থাকতে সবাই ফিরে আসতে পারে। এটা স্কুলের ১০ থেকে ১৫ মাইলের বাইরে হওয়া উচিত নয়।

* বাস ভাড়া করার সময় যে রাস্তায় বা রুটে যাবে, সেই রুটেরই বাস ভাড়া করা প্রয়োজন। অন্য রুটের বাস বিভ্রাট ঘটায় বেশি।

* পিকনিকে গিয়ে শিশুরা শিক্ষকদের অনুসরণ করে পদে পদে। শিক্ষকেরা যখন বর্জ্য লঞ্চ থেকে নদীতে ফেলেন, রাস্তায় ফেলেন, গাছের নিচে ফেলেন, শিশুরাও তা-ই করে। পিকনিকের অছিলায় শিশুদের এগুলো শেখানো দিকে নজর রাখা উচিত।

* আসলে দূরে নিয়ে গেলেই যে শিশুরা উপভোগ করবে, সেটা কিন্তু ঠিক না। শিশুরা উপভোগ করে কর্মসূচি। কী কী আনন্দময় কর্মসূচি শিক্ষকেরা রাখছেন, সেটাই আসল। স্কুলের আশপাশের এলাকার মধ্যেও শিশুদের একটা আনন্দময় দিন উপহার দেওয়া যায়।

* শিশুদের ভ্রমণের সময় প্রাথমিক চিকিৎসার বাক্স এবং প্রাথমিক চিকিৎসাজ্ঞানসম্পন্ন একজন শিক্ষক অথবা প্রশিক্ষিত ব্যক্তি সঙ্গে থাকতে হবে।

* শিক্ষকদের জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকতে হবে। গাদাগাদি করে অনেক দূরে শিশুদের নিয়ে গিয়ে নিজেদের দেশ দেখার ইচ্ছা পূরণের চেষ্টাকে অপরাধ হিসেবেই দেখতে হবে।

* পরিবহনের ক্ষেত্রেও একটা নির্দিষ্ট মান রক্ষা করা উচিত।

* পিকনিকে যাওয়ার গাড়ি ঠিক করার সময় দেখে নিতে হবে, যিনি গাড়িটি চালাবেন, তিনি পেশাদার চালক কি না।

* সর্বোপরি স্কুলের বাইরে শিশুদের নেওয়ার একটা পরিষ্কার নীতিমালা সবাইকে নিয়ে প্রণয়ন করতে হবে। সেখানে পরিবহন, দূরত্ব, দিনের কর্মসূচি, ফিরে আসার সময় ইত্যাদি বিষয়ে দিকনির্দেশনা থাকবে এবং সেগুলো অমান্য করলে তার জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকবে। এরপরও যদি দুর্ঘটনা ঘটে যায়, তাহলে কী করতে হবে, সেটাও পরিষ্কার করে বলে দিতে হবে। জরুরি চিকিৎসা এবং রেফারেল চিকিৎসার একটা সর্বজনস্বীকৃত প্রটোকল থাকতে হবে।

গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী। শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।