সবকিছু কি ভেঙেই পড়বে?

প্রশ্ন ফাঁসের বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে মোবাইল ফোন
প্রশ্ন ফাঁসের বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে মোবাইল ফোন

কতগুলো খবরের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

এক. এখন প্রথম শ্রেণির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। প্রথম আলোর ১৮ ডিসেম্বরের খবর, নাটোরে প্রথম ও চতুর্থ শ্রেণির গণিতের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় ১০২টি প্রাথমিক স্কুলের পরীক্ষা বাতিল করেছে জেলা প্রশাসন। এর আগে আরও একাধিক জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর আমরা পেয়েছি।

দুই.২০ ডিসেম্বর প্রথম আলো অনলাইনে একটা খুবই জরুরি লেখা লিখেছেন দিলশানা পারুল। তিনি শিক্ষা গবেষক ও বাস্তবায়ন পেশাজীবী। তাঁর লেখার শিরোনাম, ‘বিদ্যালয়ে চলন্ত সিঁড়ি, কিন্তু শিক্ষার কী খবর!’ সরকার নাকি ১৬৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চলন্ত সিঁড়ি স্থাপনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

দিলশানা পারুলই জানাচ্ছেন, তিনি গত বছর গিয়েছিলেন মানিকগঞ্জের এক স্কুলে। সেখানে আছেন একজন প্রধান শিক্ষক, একজন শিক্ষক, আর একজন দপ্তরি। ৩০০ ছাত্র নিয়ে প্রধান শিক্ষকের অবস্থা নাজেহাল। দপ্তরিকে ক্লাস নিতে হচ্ছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের নিজেদের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাত্র ৮ ভাগ ইংরেজিতে কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন করতে পেরেছে।

দিলশানা পারুল উল্লেখ করেছেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মনিটরিং বিভাগের বার্ষিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুসারে পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলায় ২৯ ভাগ আর গণিতে ৩২ ভাগ মাত্র শ্রেণি অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন করতে পেরেছে। তাঁর সংগত প্রশ্ন, এই যে বাংলা ও গণিতে ৭০ শতাংশ শিশু প্রায় কোনো কিছু না শিখেই মাধ্যমিকে উঠছে, মাধ্যমিকের বিদ্যুৎ-চালিত সিঁড়ি বানিয়ে দিলে কি আমাদের এসব শিক্ষার্থী বাংলা ও গণিতে যোগ্যতা অর্জন করে ফেলবে? যদি তা না হয়, তাহলে আসলে এই ১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা ব্যয়ের বৈদ্যুতিক সিঁড়ির কী কাজ থাকতে পারে?

তিন. ডেইলি স্টার সম্প্রতি এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছিল বাংলাদেশে বড় বড় ভৌতকাঠামো প্রকল্প নিয়ে। তাতে বলা হয়েছে, বড় বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়ানো যেমন দরকার, তেমনি দরকার প্রকল্পগুলো আদৌ দরকার কি না, তার ব্যবস্থাপনার মতো দক্ষতা, যোগ্যতা, লোকবল আছে কি না, তা দেখা। কোথাও থেকে তহবিল আসছে বলেই প্রকল্প না করে প্রকল্পটা আদৌ দরকার কি না, তা যাচাই করে দেখা। তারপর যদি মনে হয় এই প্রকল্প দরকার, তাহলে সেটা করতে আসলে কত অর্থ দরকার, সেটাও যাচাই-বাছাই, দরদাম করে দেখা দরকার।

উদ্ধৃতি বড় হলেও ভীষণ প্রয়োজনীয় বলে আমি প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে তুলে ধরছি সরাসরি:
ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য জামিলুর রেজা চৌধুরী বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে নেওয়া প্রকল্পগুলো যাচাই-বাছাই করে গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগের প্রকল্প ব্যয় হিসেবে চীনা প্রতিষ্ঠান ৬৪০ কোটি ডলার চেয়েছিল। তা দর-কষাকষি করে এখন পর্যন্ত অর্ধেকে নেমেছে। তিনি প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সুদের হার, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা, অবকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি বিষয় মাথায় রাখার পরামর্শ দেন।

জামিলুর রেজা চৌধুরীর বক্তব্যের একপর্যায়ে মাহ্ফুজ আনাম জানতে চান, এত দিন পরেও ঢাকার অবকাঠামোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে কেন সমন্বয় হচ্ছে না? জবাবে জামিলুর রেজা চৌধুরী একটি কৌতুক বলেন, সেটি এ রকম-এক ব্যক্তি গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় গর্তের মধ্যে পড়েন। এ সময় পাশে বসে থাকা একজন এসে তাঁকে সহায়তা করেন। গাড়ির মালিক খুশি হয়ে তাঁকে কিছু বকশিশ দেন। এরপর জানতে চান, তিনি কী করবেন। ওই ব্যক্তি বলেন, তিনি গর্তটি ঢেকে রেখে বসে থাকবেন আরেকটি গাড়ির অপেক্ষায়।

জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, গর্তটি ওই ব্যক্তিই খুঁড়েছিলেন। সেটা ছিল তাঁর আয়ের উৎস। তিনি চারটি সংস্থার নাম বলেন, যারা ঢাকায় অবকাঠামোর কাজ করছে। সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা সংস্থাকে পাত্তা দিচ্ছে না।

কিছু বড় প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার খরচ করে যে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, তা আড়াই শ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেই সম্ভব। পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগে ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ে কি এটির ব্যবস্থাপনায় সক্ষম? এ সেতু দিয়ে কটি ট্রেন চলবে? এটি করা হচ্ছে, কারণ চীন অর্থায়ন করতে চায়। (প্রথম আলো, ১২ ডিসেম্বর ২০১৭)

চার. বিল গেটস ২০১৭ সালের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের যে তালিকা করেছেন, তাতে স্থান পেয়েছে ভারতের ছবি টয়লেট: এক প্রেমকথা। অক্ষয় কুমার অভিনীত ওই ছবিতে এক নববধূ শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। ভোরবেলার অন্ধকারে তাকে ডেকে তুলে বলা হয়, লোটা পার্টিতে যেতে হবে। মানে বাড়িতে টয়লেট নেই, দূরে বনবাদাড়ে যেতে হবে। এই নববধূ বিদ্রোহ করে। শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে আসে। পরে তারা সেই বাড়িতে টয়লেট বানাতে সমর্থ হয়।

পাঁচ. বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ব্যবহারে উন্নতি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। ভারতে স্যানিটেশন যেখানে প্রায় ৫০ ভাগ, বাংলাদেশে প্রায় ১০০ ভাগ। কিন্তু তাই বলে পুরোপুরি ১০০ ভাগ হয়ে গেছে, এই দাবি করা বাস্তব হবে না।

বাংলাদেশে বহু মেয়েকে স্কুল কামাই দিতে হয়, কারণ স্কুলে উপযুক্ত বাথরুম নেই। এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৪১ ভাগ মেয়ে মাসে কয়েক দিন স্কুলে যায় না উপযুক্ত বাথরুমের অভাবে।

ওপরের খবরগুলো একখানে করে কতগুলো কথা হয়তো বলা যায়।

বাংলাদেশে প্রকল্পের উদ্দেশ্য যত না মানুষের প্রকৃতপক্ষেই উপকার করা, তার চেয়ে বেশি লোক দেখানো, রাজনীতিতে করতালি লাভ, দাতাদের স্বার্থরক্ষা এবং দুর্নীতি করে নিজের পকেট ভরা। প্রথম আলো একবার সেতু সংখ্যা করে দেখিয়ে দিয়েছিল, আমরা সেতু বানিয়েছি, কিন্তু সেসব নদীর মধ্যখানে শূন্যে ঝুলে আছে, তাতে ওঠানামা করার কোনো ব্যবস্থা নেই। চট্টগ্রামের ফ্লাইওভার খালি পড়ে আছে, নিচ দিয়ে গাড়িঘোড়া চলছে। এলাকাবাসী বলছেন, এই ফ্লাইওভার তাঁদের কোনো কাজে লাগে না।

১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা দিয়ে ১৬৩টা স্কুলে চলন্ত সিঁড়ি বানানোর আদৌ কোনো বাস্তবতা নেই। স্পেশাল শিশুদের প্রবেশগম্যতার জন্য যদি লিফট বসানো হয়, ১৬ কোটি টাকাতেই হয়ে যাবে।

এই ১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিন, বাথরুম বানান, পানির কল বা পাম্প কিনে দিন, বদনা কিনে দিন, বাথরুম পরিষ্কার করার কর্মী দিন, চক-ডাস্টার কিনে দিন, শিক্ষকদের ট্রেনিং দিন, শিক্ষকেরা ক্লাস নিচ্ছেন কি না, তা দেখার জন্য পরিদর্শক দিন। লাইব্রেরি বানান, লাইব্রেরির শিক্ষক দিন।

আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস নৈতিকতার মহামারির প্রমাণ। এ তোমার পাপ, এ আমার পাপ। আমরা একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেছি। এখানে শিক্ষার মানে কিছু শেখা নয়, দক্ষতা অর্জন করা নয়, যোগ্যতা অর্জন করা নয়, এ হলো একটা সার্টিফিকেট অর্জন করা, যা আমাকে আরেকটা জায়গায় ভর্তি হওয়ার কিংবা নিযুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেবে।

যে মানসিকতা একজন অভিভাবককে ক্লাস ওয়ানের প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে নিজের সন্তানের হাতে তুলে দিতে দ্বিধান্বিত করে না, সেই একই মানসিকতা হাজার কোটি টাকার অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প প্রণয়ন করতে একটুও বিবেকের দংশন সৃষ্টি করতে দেয় না।

এই সামগ্রিক বিনাশের কালে একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ জেলার দরবস্ত ইউনিয়নে আমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম কদিন আগে। সেখানে কেয়ারের নেতৃত্বে গ্রামবাসী একটা উঠান বৈঠক করছিলেন। তাঁদের জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কেন নিজেদের সময় নষ্ট করে এসেছেন। আপনাদের তো ঋণ দেওয়া হয় না, টাকাপয়সাও দেওয়া হয় না। একজন তরুণী দাঁড়ালেন। স্পষ্ট নির্ভুল উচ্চারণে বললেন, ‘আমরা এখানে কোন ফসল কীভাবে আবাদ করলে ফলন বেশি, লাভ বেশি, তা নিয়ে আলোচনা করি, বাজারজাত করার উপায় বের করি, শিক্ষার্থীদের স্কুলের পড়া তৈরি করার জন্য আফটার স্কুলিংয়ের ব্যবস্থা করি।’ তারপর তিনি আমাদের দেখাতে নিয়ে গেলেন গরিবের কল। একটা দুই লিটারের পানির বোতল, তার নিচে একটা ছোট ছিদ্র। পানি ভরা বোতলটির মুখ খুললেই কলের মতো পানি তীব্র বেগে বেরিয়ে আসে। টয়লেটের বাইরে গাছে তা ঝোলানো। সেখানে সাবানও আছে। তিনি আমাদের একেবারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত পদ্ধতিতে হাত ধুয়ে দেখালেন।

বাংলাদেশের মানুষের শেখার ক্ষমতা, গ্রহণ করার ক্ষমতা অসাধারণ। দেশে শিক্ষা নিয়ে একটা এলাহি কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। দিনাজপুর শহরে গিয়ে আমি আমার সঙ্গীদের বললাম, তাকিয়ে দেখো, কী বুঝছ? সারা শহর ঢাকা পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুনে! না, নির্বাচনের নয়। স্কুল, কলেজ, কোচিংয়ে ভর্তির। একজন স্কুলশিক্ষিকা প্রথম আলোর সুধী সমাবেশে বললেন, আজকালকার ছেলেমেয়েরা ব্যাপকভাবে পড়ে, নানা কিছু জানতে চায়।

মানুষ প্রত্যেকে তার ভাগ্য বদলানোর ব্যক্তিগত বিপ্লবে শামিল হয়েছে। আমাদের গ্রামের ওই তরুণী, কিংবা দিনাজপুরের শিশু-কিশোর তরুণেরা। এটাকে আমরা প্রকৃত শিক্ষা, প্রকৃত উন্নয়নের জাদুকরি স্পর্শে কাজে লাগাতে পারি, আবার প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ, ঘুষবাণিজ্য আর মেগা প্রকল্পের মেগা চুরি দিয়ে ধসিয়ে দিতে পারি।

প্রথম পথ নেব, নাকি দ্বিতীয় পথ? আইনের শাসন না থাকলে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও দক্ষতা না থাকলে এবং জবাবদিহি না থাকলে শুধু সদিচ্ছা দিয়ে প্রথম পথটা আমরা অবলম্বন করতে পারব কি?

দুটো কথাই সত্য-এক. গাছ স্বভাবতই আলোর দিকে যায়। দুই. রোগ সংক্রামক, স্বাস্থ্য সংক্রামক নয়। লালন বলেন, ‘মন সহজে কি আর সই হবা, চিরকাল ইচ্ছা এমন আল ডিঙিয়ে ঘাস খাবা।’

আল ডিঙিয়ে মন যাতে ঘাস না খেতে পারে, সে জন্য দরকার সুশাসন, আইনের শাসন, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, প্রতিবিধানের ব্যবস্থা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির।

দেশের যেকোনো দিনের সংবাদ থেকে যেকোনো পাঁচটা খবর তুলে নিলে লক্ষণ খুব ভালো মনে হয় না। ইয়েটসের ভাষায়-‘থিংস ফল অ্যাপার্ট অ্যান্ড দ্য সেন্টার ক্যাননট হোল্ড’।

সবকিছু কি ভেঙেই পড়বে? এই সমূহ পতন রোধে আমাদের কি কিছুই করণীয় নেই?

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।