লেখাপড়া করেও কেন চাকরি পাই না?

আমি মো. মশিদুল হক, সর্বশেষ ৩৬তম বিসিএসে উত্তীর্ণ একজন হতাশাগ্রস্ত নন-ক্যাডার। দীর্ঘ আড়াই বছর একটা বিসিএসের পেছনে সময় ব্যয় করার পর নন-ক্যাডার লিস্টে (তালিকায়) জায়গা পাওয়া খুবই হতাশাজনক ব্যাপার। সাম্প্রতিক বিসিএসগুলোতে নন-ক্যাডার থেকে নিয়োগদানের বিষয় কিছুটা আশাব্যঞ্জক হলেও মন্ত্রণালয়গুলোর পিএসসিতে রিকুইজিশন পাঠানোর অবহেলায় শতভাগ জব (চাকরি) না পাওয়ার একটা আশঙ্কা থেকেই যায়। এর মধ্যে আছে কোটার শূন্যপদ সংরক্ষণের নিয়ম। ৩৫তম বিসিএসের নন-ক্যাডারদের সবাইকে কোটা শিথিলের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হলেও ৩৬তম বিসিএসে কোটা শিথিলসহ শতভাগ নিয়োগের ব্যাপারে আমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।’

৩৬তম বিসিএস নন-ক্যাডার তালিকাভুক্ত এই তরুণের মতো আরও অনেক চাকরিপ্রার্থী প্রথম আলোয় চিঠি লিখেছেন, যাতে দ্রুত তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়, সে বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ইতিমধ্যে ৩৭তম বিসিএসের চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ হয়েছে বা হওয়ার পথে। গতকাল ৩৮তম বিসিএসের যে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়েছে, তাতে অংশ নিয়েছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৫৩২ জন। ৩৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে পরীক্ষা দিয়েছিলেন ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৭৬ জন। এ থেকে ধারণা করা কঠিন নয় যে চাকরিপ্রার্থীদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। ৩৬তম বিসিএসের পরীক্ষার্থীদের মধ্য থেকে চূড়ান্তভাবে ৫ হাজার ২৩১ জন উত্তীর্ণ হলেও বিভিন্ন ক্যাডারে ২ হাজার ৩২৩ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। আর মশিদুলের মতো অপেক্ষমাণ রয়েছেন ৩ হাজার ৩০৮ জন।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক ২০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে জানান, বর্তমানে দেশের সরকারি অফিস, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরসমূহে শূন্যপদের সংখ্যা ৩ লাখ ৫৯ হাজার ২৬১টি। একদিকে পদ শূন্য থাকা, অন্যদিকে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও চাকরি না পাওয়া খুবই দুঃখজনক।

একটি দেশে বেকারত্বের মাত্রা কেমন, তা নিরূপণ করা যায় চাকরির পরীক্ষা কিংবা শূন্যপদের বিপরীতে আবেদনের সংখ্যা দিয়ে। এক বছরের ব্যবধানে এক লাখ পরীক্ষার্থী বেড়ে যাওয়া থেকে অনুমান করা কঠিন নয় যে আমরা বেকারত্বের এক জ্বলন্ত চুল্লিতে বসে আছি। কয়েক বছর ধরে নিয়মিত বিসিএস পরীক্ষা হচ্ছে, এটি সুলক্ষণ। কিন্তু প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ তরুণ যে শ্রমবাজারে আসছেন, তাঁদের কজন চাকরি পাচ্ছেন? এক-তৃতীয়াংশেরও কম। বাকিরা হয় বেকার, না হয় ছদ্মবেকার। অনেকে এমন কাজও করেন, যা তাঁদের লেখাপড়া কিংবা যোগ্যতা ও মেধার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপমানকরও।

সম্প্রতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অনশন করেছিলেন তাঁদের পদোন্নতির জন্য। বিসিএস পরীক্ষা দিয়েই নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ পাওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকেরা ১১তম গ্রেডে বেতন পান। আমরা মনে করি, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর সব শিক্ষক নিয়োগ কর্ম কমিশনের মাধ্যমে হওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি যেমন কমবে, তেমনি মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসবেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক থেকে কলেজ পর্যায়ে একই পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। উত্তীর্ণ শিক্ষকদের বিকল্প বেছে নিতে বলা হয় তাঁরা কোন স্তরে যাবেন। বেতন-ভাতা সব স্তরেই সমান। আমাদের ‘শিক্ষাব্রতী’ সরকার এ রকম একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারলে শিক্ষায় দুর্নীতি ও অধোগতি দুটোর হাত থেকে জাতি রেহাই পেত।

বিসিএসে একটি পদের বিপরীতে যখন প্রায় ৭০ জন পরীক্ষা দিয়ে থাকেন, তখন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে চাকরিপ্রার্থীদের ভিড়টা সহজেই অনুমান করা যায়। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী) বলা হলেও প্রকৃত বেকারের সংখ্যা অনেক অনেক গুণ বেশি। বিশ্বব্যাংক মনে করে, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এ হিসাবে ২ কোটি ২ লাখ লোক বেকার। কিন্তু আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। তাদের মতে, বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের তালিকার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম।

আইএলওর দেওয়া মানদণ্ড অনুযায়ী, সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ না করলে ওই ব্যক্তিকে বেকার ধরা হয়। কিন্তু সপ্তাহে এক ঘণ্টার কাজ করে বাংলাদেশে যে মজুরি পাওয়া যায়, তা দিয়ে অন্যান্য মৌলিক চাহিদা মেটানো দূরে থাক, দুবেলা অন্নসংস্থানও হয় না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনে দেখা যায় যে বাংলাদেশে পড়াশোনা করলে কাজ পাওয়ার সুযোগ কম। পড়াশোনা না করলে কাজ পাওয়ার সুযোগ বেশি। কোনো ধরনের শিক্ষার সুযোগ পাননি, এমন মানুষের মধ্যে মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ বেকার। তুলনায় উচ্চশিক্ষিতদের বেকারত্বের হার ৯ শতাংশ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি।

২০১৪ সালে যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষিত ১০০ জন মানুষের মধ্যে ৪৭ জন কাজের সুযোগ পান না। ভারতে এই হার ৩৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ, নেপালে ২০ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। তাহলে কি আমরাই সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত বেকার তৈরি করছি না?

এটি হলো মুদ্রার এক পিঠ। অপর পিঠ হলো বাংলাদেশের শিল্পকারখানা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এমনকি হাসপাতাল পরিচালনার জন্যও বিদেশ থেকে বেশি মজুরি দিয়ে জনশক্তি আমদানি করতে হচ্ছে।

বিবিএসের হিসাবে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম শ্রমশক্তি ৬ কোটি ৭ লাখ। এ শ্রমশক্তির মধ্যে ৫ কোটি ৮০ লাখ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। পরিবারের মধ্যে কাজ করেন কিন্তু কোনো মজুরি পান না, এমন মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ১১ লাখ। এ ছাড়া আছেন আরও ১ কোটি ৬ লাখ দিনমজুর, যাঁদের কাজের নিশ্চয়তা নেই।

কয়েক বছর ধরে বেসরকারি খাতে খুব একটা বিনিয়োগ বাড়েনি। এ কারণে কর্মসংস্থানও বাড়ছে না।

সরকারি হিসাবেই বাংলাদেশে তরুণ বেকারের হার সবচেয়ে বেশি—১০ দশমিক ৪ ভাগ। তাঁদের মধ্যে নারীদের হার বেশি—১৫ শতাংশ। দেশের কর্মক্ষম নারীদের ৬ দশমিক ৮ ভাগ বেকার, পুরুষদের মধ্যে ৩ শতাংশ বেকার। এরপরই রয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করা যুবকদের বেকারত্ব। মাধ্যমিক পাস করাদের বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। উচ্চমাধ্যমিক পাস ৬ দশমিক ২ শতাংশ যুবক বেকার।

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা যে কী ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, তা বুঝতে পরিসংখ্যানবিদ বা অর্থনীতিবিশেষজ্ঞ হতে হয় না। এই বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির প্রতারক চক্র সারা দেশে জাল ফেলেছে। তারা চাকরি দেওয়ার নামে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বেকার তরুণদের কাছ থেকে। অনেক আগে থেকে আদম ব্যাপারীরা বিদেশে লোক পাঠানোর নামে বেকার যুবকদের সর্বস্বান্ত করে আসছেন। এর সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে দেশের ভেতরে প্রতারণা। কোনো এলাকায় হোটেল বা কোনো বাড়িতে অফিস নিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের আকৃষ্ট করা হয়। তারপর একদিন রাতে দেখা যায় সেখান থেকে অফিস গুটিয়ে অন্য কোথাও প্রতারণার ফাঁদ পাতার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

একজন ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা পত্রিকান্তরে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, ‘বর্তমানে যেসব ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে, সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিধারীরা আসছেন না। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাসের মতো অনেক বিষয় থেকে অনেকে পাস করে আসছেন। বাজারে তাঁদের চাহিদা নেই। আমরা ভালো লোক পাচ্ছি না। ভালো কেমিস্ট বা আইটি জানা লোক বাজারে অনেক কম। আর যাঁরা আছেন, তাঁদের চাকরি দিলে লেখাপড়ার মতো গোড়া থেকে শিখিয়ে নিতে হবে।’

অর্থনীতিবিদদের মতে, সার্বিকভাবে দেশে যেভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, সেভাবে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। বাংলাদেশে যে মানের শিক্ষিত লোকবল তৈরি করা হচ্ছে, তার উৎকৃষ্ট অংশ চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। আর যাঁরা দেশে থাকছেন তাঁদের বেশির ভাগ গড়পড়তা মানের এবং কারিগরি বা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের জ্ঞান তঁাদের কম। ফলে বেসরকারি খাতে মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিবছর ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর জনশক্তি আমদানি করতে হচ্ছে। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরা যে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেন, তার একটি বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে এঁদের পেছনে। এক পরিসংখ্যানে জানা যায, বছরে তিন থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার বিদেশি চাকরিজীবীদের জন্য ব্যয় হচ্ছে।

 প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা বেকারদের ৫৬ শতাংশ ছয় মাস থেকে দুই বছরের বেশি সময় পর্যন্ত কাজ পাননি। কমপক্ষে ছয় মাস বেকার ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ লোক। আর মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষিতদের ৪৭ শতাংশ ছয় মাস থেকে দুই বছরের বেশি বেকার থাকে। কমপক্ষে ছয় মাস বেকার থাকে ৪৫ শতাংশ লোক। আর মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষিতদের অর্ধেকই ছয় মাস বেকার থাকে। ৩৫ শতাংশ লোক ছয় মাস থেকে দুই বছরের বেশি সময় পর্যন্ত বেকার থাকে।

আমাদের শিক্ষা ও চাকরির বাজার চলছে বিপরীত ধারায়। অনেকটা যেখানে রোগী নেই সেখানে ডাক্তার আছেন, আবার যেখানে ডাক্তার আছেন সেখানে রোগী নেইয়ের মতো অবস্থা।

প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় এসে একেকটি শিক্ষানীতি করে, কিন্তু দেশের ভেতরে বা বাইরে কী ধরনের শিক্ষার কী পরিমাণ চাহিদা আছে, তা নিরূপণ করে শিক্ষাব্যবস্থাটা ঢেলে সাজানোর কাজটি কেউ করলেন না। তঁারা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নতুন  বিভাগ খুলছেন, কিন্তু এসব বিভাগের আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, তা পরখ করে দেখছেন না।

আমাদের জনপ্রশাসন ধীরে ধীরে উল্টো পিরামিড হয়ে উঠেছে। নিচের ভিত যত দুর্বল,  ওপরের মাথাটি ততই ওজনদার হচ্ছে। নিচের দিকে সাড়ে তিন লাখের বেশি পদ শূন্য রয়েছে। লোক নিয়োগ করা হচ্ছে না। অথচ ওপরের দিকে পদ না থাকতেও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে নিচ থেকে পদোন্নতির পথও আটকে দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রশাসনে চলছে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি।

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।