অসমতায় কী ঘটে

>

অ্যাঙ্গাস ডিটন
অ্যাঙ্গাস ডিটন

২০১৭ সাল শেষ হচ্ছে। আর মাত্র এক দিন পরই নতুন বছর শুরু হবে। বছরের শেষ প্রান্তে পৃথিবীর সাম্প্রতিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রখ্যাত কিছু মানুষের লেখা আমরা অনুবাদ করে ছাপছি, যেগুলো আমাদের বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রবণতা যেমন বুঝতে সহায়তা করবে, তেমনি আগামী দিনের দিকনির্দেশনাও দেবে। প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের এই লেখাগুলো বাংলাদেশে শুধু আমরাই বাংলা ভাষায় ছাপাব। এর অংশ হিসেবে আজ ছাপা হলো অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অ্যাঙ্গাস ডিটন ও ইউরোপিয়ান ক্লাইমেট ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী লরেন্স তুবিয়ানার লেখা।

আমি এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি প্রায়ই হই। কিন্তু সত্যি বলতে, এগুলোর কোনোটাই কোনো কাজের প্রশ্ন নয়; এসব প্রশ্নের উত্তর হয় না। কিংবা প্রশ্নগুলো উপস্থাপনই ঠিকভাবে করা হয় না। অসমতা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়ার কারণ যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি ফল। এসব প্রক্রিয়ার কিছু ভালো, কিছু খারাপ। কিছু কিছু প্রক্রিয়া সাংঘাতিক খারাপ। খারাপ ও অত্যন্ত খারাপ প্রক্রিয়াগুলো থেকে ভালোগুলো আলাদা করার মাধ্যমেই শুধু আমরা বুঝতে পারব অসমতা কী এবং তা নিয়ে কী করতে হবে।

অসমতা আর অন্যায্যতা কিন্তু এক নয় এবং আমার মনে হয়, ধনী দুনিয়ায় এত বেশি রাজনৈতিক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে অন্যায্যতার কারণে, অসমতার কারণে নয়। কিছু কিছু প্রক্রিয়া আছে, যেগুলোতে অসমতা সৃষ্টি হয় কিন্তু সাধারণভাবে সেগুলোকে ন্যায্য
প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখা হয়। কিন্তু অন্য অনেক প্রক্রিয়া আছে, যেগুলো স্পষ্টতই ন্যায্য ও খুবই অন্যায্য। এগুলো যথার্থই অসন্তোষ ও ক্ষোভ-বিক্ষোভের উৎস।

পুরো মানবজাতির জন্য উপকারী পণ্য ও সেবা চালু করার মধ্য দিয়ে যদি কোনো সৃজনশীল উদ্যোক্তা ভীষণ ধনী হয়ে যায়, তাহলে তাতে আপত্তি করা কঠিন। আজকের দিনে আমরা যেসব অসমতা দেখছি, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়গুলোর সৃষ্টি হয়েছে ১৭৫০ সালের দিকে শুরু হওয়া শিল্পবিপ্লব ও স্বাস্থ্যবিপ্লবের ফলে। শুরুর দিকে এই প্রক্রিয়া থেকে উপকৃত হয়েছে উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের অল্প কয়েকটি দেশ। কিন্তু তারপর থেকে পৃথিবীজুড়ে কোটি কোটি মানুষের জীবনমান ও স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। এসব অগ্রগতি থেকে একই দেশের ভেতরে এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে যেসব অসমতা তৈরি হয়েছে, সেগুলো উপকারী, ন্যায্য এবং মানবজাতির সাধারণ প্রগতির এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

অন্যদিকে রাষ্ট্রকে ঘুষ দিয়ে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা আদায়ের মাধ্যমে ধনী হওয়া স্পষ্টতই অন্যায্য এবং এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ-অসন্তোষই যথার্থ। ইউরোপ-আমেরিকায় অনেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মনে করে যে পুঁজিবাদ বা বাজার অর্থনীতির ফলগুলো ন্যায্য; ইউরোপের তুলনায় আমেরিকায় বেশি লোকে এটা মনে করে। তারা মনে করে, বাজারব্যবস্থায় সরকারি হস্তক্ষেপ জবরদস্তিমূলক ও অন্যায্য। তারা সংখ্যালঘু বা অভিবাসীদের মতো বিশেষ জনগোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতপূর্ণ সরকারি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় পরিচালিত কর্মসূচিগুলোর বিরোধিতা করে।

এ থেকে বোঝা যায় কেন শ্রমজীবী শ্রেণির অনেক শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান ডেমোক্রেটিক পার্টির বিরুদ্ধে চলে গেছে। তারা মনে করে, ডেমোক্রেটিক পার্টি হচ্ছে সংখ্যালঘু, অভিবাসী ও শিক্ষিত অভিজাতদের দল।

কিন্তু মানুষের অসন্তোষ বাড়ার আরও একটা কারণ আছে। তা হলো, আমেরিকায় ৫০ বছর ধরে মধ্যম প্রকৃত মজুরি (মূল্যস্ফীতি সমন্বয়সহ) স্থবির হয়ে আছে। মাঝারি আয় ও শীর্ষ আয়ের ব্যবধানের দুই ধরনের ব্যাখ্যা আছে। দুটো ব্যাখ্যার মধ্যে কোনটা সঠিক, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রথম ব্যাখ্যা হচ্ছে, বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মতো নৈর্ব্যক্তিক ও অপ্রতিরোধ্য প্রক্রিয়াগুলোর ফলে নিম্ন দক্ষতার শ্রমিকের শ্রমের মূল্য কমে যায় আর উচ্চশিক্ষিতদের আয় বাড়ে। দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হলো, মাঝারি আয়ের স্থবিরতা আসলে ধনীদের আয় বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ ফল। এই মতের লোকেরা মনে করেন, ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে অন্য সবার বঞ্চনার বিনিময়ে।

সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে ইঙ্গিত মেলে, দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় কিছু সত্য আছে। অন্ততপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে। যদিও বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ফলে চিরাচরিত কর্মব্যবস্থাগুলো ভেঙে পড়েছে, তবু উভয় প্রক্রিয়াতেই সব মানুষের উপকারের সম্ভাবনা আছে। কী ধরনের নীতি ও প্রক্রিয়ার ফলে মধ্যশ্রেণি ও শ্রমজীবী শ্রেণির আয় স্থবির হয়ে আছে এবং তা কী মাত্রায়, তা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করতে হলে আরও অনেক গবেষণা করতে হবে। তবে নিচে সে রকম কিছু নীতি ও প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করছি।

এক. মজুরির ওপর স্বাস্থ্যসেবায় অর্থায়নের প্রভাব বিপর্যয়কর। যুক্তরাষ্ট্রের চাকরিজীবীদের অধিকাংশের স্বাস্থ্যবিমা দেন নিয়োগকর্তারা, ফলে তঁাদের মুনাফা ঠিক রাখতে এবং মেডিকেলশিল্পের বেতন বাড়ানোর জন্য শ্রমিকের মজুরিতে টান পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর ব্যয়বহুল স্বাস্থ্য খাতে ট্রিলিয়ন ডলার নষ্ট করে থাকে—পরিবারপ্রতি আট হাজার ডলার। ধনী দেশগুলোর মধ্যে তারাই এ খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করলেও পরিণামে তাদের সবার চেয়ে কম ফল পাচ্ছে তারা। ইউরোপে অর্থায়নের যেসব বিকল্প ধারা আছে, তার যেকোনো একটি বেছে নিলে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু এটা গ্রহণ করা হলে বিদ্যমান ব্যবস্থায় যঁারা উপকারভোগী হচ্ছেন, তঁারা তীব্রভাবে সেটা প্রতিরোধের চেষ্টা করবেন।

আরেকটি প্রাসঙ্গিক সমস্যা হচ্ছে, অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে বাজার ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। হাসপাতালগুলো একীভূত হওয়ার ফলে সেখানকার চিকিৎসার খরচ দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু সেখানকার কর্মীদের মজুরি বাড়েনি, যদিও দশককাল ধরে নার্স–সংকট ছিল। এই প্রবণতার অন্তর্নিহিত কারণ হচ্ছে উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়া। সর্বোপরি উদ্ভাবন ও বিনিয়োগের মাধ্যমে মুনাফা করার চেয়ে নীতিগত সুবিধা নিয়ে ও ব্যবসায় একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠা করে মুনাফা করা সহজ।

আরেকটি সমস্যা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ন্যূনতম মজুরি ২০০৯ সালের জুলাই মাসের পর বাড়েনি, যা বর্তমানে ঘণ্টায় ৭ দশমিক ২৫ ডলার। ব্যাপক জনসমর্থন থাকলেও ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো সব সময়ই কঠিন, যার কারণ হলো, কংগ্রেসে ধনী প্রতিষ্ঠান ও দাতাদের প্রভাব এক রকম নয়।

পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার কারণ হলো, ২০ শতাংশের বেশি শ্রমিক এখন নন-কমপিট ক্লজের (কর্মী অন্য প্রতিষ্ঠানে একই রকম চাকরি নিয়ে যেতে পারবে না) শিকলে বঁাধা পড়ে আছে। এতে শ্রমিকদের দর-কষাকষির ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। একইভাবে ২৮টি মার্কিন রাজ্যে এখন ‘কাজের অধিকার’ আইন করা হয়েছে। এই আইনে যৌথ দর-কষাকষির ব্যবস্থা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ভোক্তা ও কর্মীদের বিবাদ এখন আদালতের বাইরে সালিসির মাধ্যমে সমাধান হচ্ছে, যেটা ব্যবসায়ীদের জন্য ক্রমেই অনুকূল হয়ে উঠছে।

আরেকটি সমস্যার নাম হচ্ছে আউটসোর্সিং। শুধু বিদেশে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেও এমনটা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা বেতনভুক্ত ও পূর্ণকালীন কর্মীদের সরিয়ে দিয়ে স্বাধীন ঠিকা কর্মীদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। খাদ্য পরিবেশনকারী, দারোয়ান, রক্ষণাবেক্ষণকর্মীরা একসময় সফল কোম্পানির অংশীদার ছিলেন। কিন্তু এখন তঁারা অমুক বা তমুক সার্ভিস কোম্পানির হয়ে কাজ করেন। এই কোম্পানিগুলো এখন খুবই প্রতিযোগিতাপূর্ণ নিম্নমজুরির শিল্পে কাজ করছে, ফলে তারা কর্মীদের খুবই কম বা একেবারেই সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে না। আর কর্মীদের উন্নতির সম্ভাবনা তো নেই–ই।

আর্নড ইনকাম ট্যাক্স ক্রেডিটের (ইআইটিসি) কল্যাণে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নিম্নমজুরির শ্রমিকের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে। এটা যেহেতু কর্মরত শ্রমিকদের জন্য প্রযোজ্য, সেহেতু এতে মজুরি কমার আশঙ্কা থাকে। তবে সরকারের তরফ থেকে নাগরিকেরা শর্তহীন ও নিয়মিত ভাতা পেলে ব্যাপারটা এমন হতো না।

অন্যদিকে দক্ষতাহীন মানুষের অভিবাসনের কারণেও মজুরি নিয়ে সমস্যা হয়, যদিও এ নিয়ে বিতর্ক আছে। এটা প্রায়ই বলা হয় যে অভিবাসীরা সে কাজই করে, মার্কিনরা যা করতে চায় না। কিন্তু মজুরির প্রসঙ্গ না তুলে এ ধরনের বিবৃতি দেওয়া অর্থহীন। দক্ষতাহীন অভিবাসীরা না এলেও যে নিম্নদক্ষতার মার্কিন নাগরিকদের মজুরি এতটা কম থাকত, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। ২০ বছর আগে অর্থনীতিবিদ ড্যানি রডরিক বলেছিলেন, বিশ্বায়নের কারণে শ্রমিকদের খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। তাই বিশ্বায়নের কারণে মজুরি যদি সরাসরি না–ও কমে, তাহলে অন্তত মজুরি বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে।

আমাদের এই প্রাথমিক তালিকার শেষ সমস্যাটি রাজনৈতিক। আমরা এখন নিয়মকানুনের বহ্নি-উৎসবের যুগে প্রবেশ করেছি। যুক্তরাষ্ট্রের কনজ্যুমার ফিন্যান্সিয়াল প্রটেকশন ব্যুরো বেশ কিছু বড় বড় দুর্নীতি উদ্‌ঘাটন করলেও এখন হুমকির মুখে আছে। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, অর্থ ব্যবস্থাপকদের যে গ্রাহকের সর্বোচ্চ স্বার্থে কাজ করার নিয়ম আছে, সেটা তিনি বাতিল করতে চান। অর্থাৎ বর্তমানে আইন শিথিলজনিত ‘সংস্কারের’ যত প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তাতে শ্রমিক ও ভোক্তাদের ক্ষতির বিনিময়ে পুঁজি আরও ফুলেফেঁপে উঠবে।

মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের এ বছরের একটি রায়ের ক্ষেত্রেও এটা সত্য। উদাহরণ হিসেবে সিটিজেন্স ইউনাইটেড বনাম এফইসি মামলার কথা বলা যায়, যেখানে আদালত ধনী মার্কিন নাগরিক ও করপোরেশনগুলোকে নির্বাচনী প্রার্থীদের পেছনে এবং আইন ও
বিধি প্রণয়নে কারসাজি করতে সীমাহীন টাকা খরচের সুযোগ দিয়েছে, যা তাদের স্বার্থেই কাজ করবে।

ব্যাপারটা হলো, নীতি ঠিক থাকলে পুঁজিবাদী গণতন্ত্র সবার ক্ষেত্রেই এর চেয়ে ভালো কাজ করতে পারে, শুধু ধনীদের ক্ষেত্রে নয়। পুঁজিবাদকে আমাদের উচ্ছেদ করতে হবে না বা বাছবিচার করে উৎপাদনের উপকরণের ওপর সরকারি মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে না। কিন্তু যেটা করতে হবে তা হলো, শ্রমিক ও মধ্যবিত্তদের সেবায় প্রতিযোগিতাকে কাজে লাগাতে হবে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত।

অ্যাঙ্গাস ডিটন: নোবেল বিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ।