বাংলাদেশি ছাত্রদের রুশ বড় ভাই কোৎসার

ভ্লাদিমির কোৎসার
ভ্লাদিমির কোৎসার

রুশ শিক্ষা ব্যবস্থাপক ভ্লাদিমির কোৎসারের জন্ম রাশিয়ার সাইবেরীয় শহর ইরকুৎস্কে, ১৯৪১ সালে। তিনি পারিবারিকভাবে যুদ্ধ ও সহিংসতার অভিঘাতের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন, স্পর্শ করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর উত্তাপ। সম্প্রতি মস্কোতে তাঁর বাসায় প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেন। তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলোচনায় দোভাষীর কাজটি করেন স্নেহভাজন জামিল খান, যিনি কার্যত ডিজিটাল সাংবাদিকতায় গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে দেশে ফিরেই যোগ দিয়েছেন প্রথম আলোয়। ঢাকায় বাংলাদেশ-সোভিয়েত অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ৩৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিতে সম্প্রতি তিনি ঢাকায়ও এসেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পরপরই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে যাঁরা পড়তে গিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকের স্মৃতিতে ভ্লাদিমির একজন প্রিয়ভাজন বড় ভাই হিসেবেই জাগরূক আছেন। অক্টোবর বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে অকপটে বলা তাঁর জীবনের গল্প থেকে আমরা বুঝতে চেয়েছি, বাংলাদেশের প্রতি তাঁর অনুরাগ এবং রুশ সমাজের পরিবর্তনগুলো তাঁর জীবন ও চিন্তার জগৎকে কীভাবে ছুঁয়ে গেছে।

তিনি ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের সেন্ট্রাল যুব কমিউনিস্ট ইউনিয়নের একজন প্রশিক্ষক। ১৯৭২ সালের মার্চে সেখান থেকেই যোগ দেন মস্কোর তখনকার প্যাট্রিস লুমুম্বা (বর্তমানে গণমৈত্রী) বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের দেখভাল করার দায়িত্বে। ভ্লাদিমির স্তানিস ছিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর। সেখানে বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৯৭২ সালের আগস্টে। ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ে যখন রেক্টর স্তানিস সোভিয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির সভাপতি হন। সেখানে বৃত্তি নিয়ে পড়তে যাওয়া বাঙালির সংখ্যা এখনো কম নয়।

১৯৭২ সালের আগস্টে প্রায় ৪০ জন ছাত্রছাত্রীর একটি দল প্রথম গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিল। তিনি ওই শিক্ষার্থীদের বিমানবন্দরে গিয়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তাঁদের কয়েকজন এখনো তাঁর অত্যন্ত কাছের বন্ধু। কেউ কেউ প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় পদে আছেন। মস্কোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবস, ছাত্রছাত্রীদের জন্মদিন, বিয়ে ইত্যাদি অনুষ্ঠানে সেই আগের মতো এখনো তিনি অংশ নেন। বলা যায়, বাংলাদেশের প্রতি তিনি একটা বিশেষ বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেছেন। ইতিমধ্যে পাঁচবার বাংলাদেশে এসেছেন। সবচেয়ে তাঁর বেশি ভালো লেগেছে বাংলাদেশের গ্রাম।

মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি নিয়মিত সব খবরই রাখতেন। বাহাত্তরে বঙ্গবন্ধুর মস্কো সফর তাঁর স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল, ওই সফরে সোভিয়েত নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে অনেক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু যে চুক্তি তাঁকে বেশি টেনেছে, সেটি হলো সোভিয়েত ইউনিয়নে যেন অধিকসংখ্যক বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী পড়তে আসতে পারে। ১৯৭২ সালে যে ব্যাচটা প্রথম গিয়েছিল, তাদের অনেকেই সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়। শিরিন নামটি তাঁর বেজায় পছন্দ। কারণ, শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি একজন শিরিন বানুকে (গত বছর মারা গেছেন) পেয়েছিলেন। ভ্লাদিমির জানালেন, মহিলা হয়েও পুরুষের পোশাক পরে তিনি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁরা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত থেকেই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার জন্য রাশিয়ায় গিয়েছিলেন।

রুশ রাজনীতির উত্থান-পতন তাঁর পারিবারিক জীবনে গভীর ছাপ ফেলেছে। তাঁর বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়ে জার্মান ভূখণ্ডে আহত হন। এক চাচা জেনারেল ছিলেন। তাঁর দাদা ছিলেন জারের আর্মিতে। আর তাঁর কমিউনিস্ট মামা ভিন্নমত পোষণের অভিযোগে স্তালিনের নিষ্ঠুর শাসনকালে নিহত হন। পরে অবশ্য সেই ভিন্নমতাবলম্বী মামা অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পেয়েছেন। স্তালিনের আমলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাংলাদেশি বিপ্লবী গোলাম আম্বিয়া লুহানীও ভ্লাদিমিরের মামার মতোই পরে দায়মুক্তি পেয়েছেন। অবশ্য মস্কোতে এ রকম পরিবার ভূরি ভূরি, যারা স্তালিন আমলের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। অবশ্য ভ্লাদিমির কখনো তাঁর মামার বিষয়ে নথিপত্র খুঁজতে তেমন
আগ্রহী হননি। তাঁর কথায়, অবশিষ্ট জীবন তিনি উপভোগে ব্যয় করতে চান। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ পুষে রাখতে চান না।

ভ্লাদিমির পুতিনভক্ত। ক্রিমিয়া করতলগত করার ঘটনায় তিনি দোষণীয় কিছু দেখেন না, বরং গর্বিত। তিনি অকপটে স্বীকার করেন যেসোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কারণেই ওটা ভেঙে গেছে। পার্টির নেতারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা জনগণের আস্থা হারিয়েছিলেন। তাঁর বর্ণনায়, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল কমিটির এক সেক্রেটারির মেয়ে। একটা কালো রঙের বিলাসবহুল সেডান গাড়িতে তার যাতায়াত ছিল। কিছু দোকানে সাধারণ মানুষের ঢোকা নিষিদ্ধ ছিল, ওই মেয়ে সেসব দোকানে গিয়ে অনেক দামি জিনিস খরিদ করত। তাহলে কোথায় ছিল সেই সমতার নীতি? এগুলো সবাই জানত। তাই পার্টির নেতাদের ওপর আস্থা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।’

পুরোনো সত্য ভ্লাদিমিরের মুখে নতুন করে শুনলাম। তাঁর কথায়, ‘সোভিয়েত পার্টিতে বাক্‌-স্বাধীনতা একদম ছিল না। আমাদের শুধু বলতে হতো পার্টির পক্ষে এবং পার্টির ভালোর কথা। অন্য কোনো কথা বলার সুযোগ আমাদের ছিল না। আমরা আসলে তখনই কথাগুলো খোলামেলা বসে বলতে পারতাম, যখন আমরা তিন-চারজন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু একত্র হতাম, তখন রান্নাঘরে বা খাবার টেবিলে একান্ত আলাপচারিতায় আমাদের মনের কথাগুলো বলার সুযোগ হতো। আমাদের কয়েক লাখ বুদ্ধিজীবী ছিলেন, যাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এবং পার্টির পক্ষে কথা বলতেন। তাঁরা মুখে বলতেন এক রকম কিন্তু ভাবতেন অন্য রকম এবং কাজ করতেন অন্য রকম।

ভ্লাদিমিরের সঙ্গে একমত হতে পারি না, যখন তিনি বিশ্বাস করেন, রাশিয়া এখন একটি গণতান্ত্রিক দেশ। প্রতিটি মানুষ এখন তার মনের ভাব প্রকাশের সেই স্বাধীনতা ভোগ করে। মে দিবসের শোভাযাত্রায় অংশ নিতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এটা তো আন্তর্জাতিক, তাই বিদেশি হলেও ভিড়ে যেতে পারব। কিন্তু তার সুযোগ ছিল না। কয়েক শ মানুষকে পুলিশি বৃত্তে বন্দী থেকেই এক পরিপাটি কর্মসূচি পালন করতে দেখলাম। অবশ্য ভ্লাদিমির মনে করিয়ে দিলেন যে এখন রাশিয়ায় অনেক বিরোধী দলের বা বিরোধী মতের গণমাধ্যম কাজ করছে। জনগণ যাকে ভোট দেবে, সে-ই জয়ী হবে। ইকাতিরেনবুর্গ শহরের বর্তমান মেয়র কিন্তু ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড রাশিয়ার নন। তিনি বিরোধী দলের মেয়র। নভোসিবির্স্কশহরের মেয়রও বিরোধী দলের। ইরকুৎস্ক শহরের গভর্নর কমিউনিস্ট পার্টির। তাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন জনগণের সরাসরি ভোটে।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷