ওদের তাহলে দেখবে কে?

শিশুদের হাতেখড়ির পরের সময়টাও যেন সুসময় হয়েই থাকে
শিশুদের হাতেখড়ির পরের সময়টাও যেন সুসময় হয়েই থাকে

বছরের প্রথম দিনই হয়ে গেল বই উৎসব। ছোট ছোট হাতে ঝকঝকে সব নতুন বই। আহ্, কী যে তার সুবাস! সরকারের উদ্যোগে কাল সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বই বিতরণ করা হয়। নতুন বই হাতে শিশুরা যখন হল্লা করে বাড়ি ফিরছিল, সবার চেহারায় খুশির ঝিলিক। এটাই তো জীবনের গান, প্রাণের স্পন্দন! এর মধ্য দিয়ে নতুন বছরে নতুন শ্রেণিতে নতুন পাঠ শুরু।

আসলে শুরুর এই পর্বটি শুরু হয় আরও আগে, নভেম্বর-ডিসেম্বরে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তখন একদিকে চলে বার্ষিক পরীক্ষার ধুম, অন্যদিকে শুরু হয় ছোট ছোট কচিপ্রাণের ভর্তির তোড়জোড়। রাজধানীতে এই ঝাপটা একটু বেশি গায়ে লাগে। কারণ, মানসম্পন্ন ভালো স্কুল বলে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচিত, সে তো সংখ্যায় সীমিত। মোটামুটি আর্থিক সংগতি আছে—এমন মা-বাবার লক্ষ্য থাকে তাঁর এইটুকুন পুত্র বা কন্যা একটা ভালো স্কুলে ভর্তি হবে।

সে এক সাজ সাজ রব। টুনটুনি শিশুরা এত দিন যারা ইচ্ছেমতন হেসেখেলে বেড়িয়েছে, কল্পনার খেয়ালে ভেসেছে, তারা এখন বই নিয়ে টুকটুক করে স্কুলে যাবে। মা-বাবা ওদের আহ্লাদী ঢঙে বোঝান, স্কুলে একসঙ্গে অনেক সঙ্গী, অনেক খেলা, অনেক মজা! আর ওই বাবুরাও ভাবে, আহা, স্কুল তো আনন্দের নন্দনকানন। ওখানে না গেলেই নয়। তাদের কল্পনার জগতে শিক্ষক অনেকটা সান্তা ক্লজের মতো হৃদয়বান হিসেবে বিচরণ করেন। কেউ কেউ কল্পনা করে, স্কুলশিক্ষক অনেকটা মোড়ের ওই দোকানি দাদুর মতো, যিনি মুঠো মুঠো চকলেট আর আইসক্রিম দেবেন। দোকানি দাদু তবু পয়সা নেন, তিনি কিন্তু দেবেন বিনে পয়সায়। আর শিক্ষিকা হবেন ফুলের ঘুম ভাঙানো পরির মতো কেউ। কিংবা অতি প্রিয় খালামণি বা ফুপ্পির মতো, যিনি তার খাপছাড়া খেয়ালে বাদ সাধবেন না।

এদিকে মা-বাবার ঘুম কিন্তু হারাম। কোনো কোনো স্কুল থেকে ভর্তি ফরম জোগাড় করা অনেকটা এভারেস্ট জয়ের মতো। সেই রাতদুপুরে গিয়ে অভিভাবকেরা লাইনে দাঁড়ান স্কুলের গেটে। লাইন বড় হতে হতে চলে যায় অনেক দূর। যাঁরা পেছনে পড়েন, তাঁদের আবার শুরু হয় ঢিবঢিব। ফরম আদৌ বাগানো যাবে তো!

আচ্ছা, ফরম না হয় বাগানো গেল, এবার নতুন টেনশন—ভর্তির জন্য টিকবে তো! বেশির ভাগ স্কুলে থাকে প্রাথমিক সাক্ষাৎকার ও লটারির আয়োজন। কাজেই ভর্তি হওয়ার বিষয়টা বলতে গেলে শিকে ছেঁড়ার মতো। যার ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে, সেই শিশুর ঘরে যে কী আনন্দ! আর যে বিমুখ হয়, সেই শিশুর ঘরে নেমে আসে সোনার হরিণ হাতছাড়া হওয়ার বেদনা। অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবার অক্ষম ক্ষোভ গিয়ে সওয়ার হয় অবোধ শিশুটির ওপরই। কারণ, সে দুর্ভাগা! অথচ সেই শিশু বুঝতেই পারে না, কী তার অপরাধ!

যে শিশুটির ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে, তার ঘরে কয়েকটা দিন আনন্দের ঝুমঝুমি বাজে। খাওয়াদাওয়া, ফুর্তি চলে। যখন ক্লাস শুরু হয়, তখন কিন্তু কঠিন এক বাস্তবতা এসে দাঁড়ায়। শিশুটি স্কুলে গিয়ে দেখে, তার কল্পনার আকাশে বিচরণ করা চরিত্রগুলো কিছুই নেই স্কুলে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা আদর করেন বটে, কিন্তু কল্পনার মানুষের মতো নন। দু-একজন আবার কড়া। দুষ্টুমি করলে বকা দেন। চোখ রাঙান। এই যে ধাক্কা, এটা সামলাতে শিশুদের সময় লাগে। চালাক-চতুর দু-চারজন অবশ্য চট করে নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। কিন্তু বেশির ভাগ শিশুর স্কুলের ভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে মিশে যেতে একটু সময় লাগে। কিন্তু বড়রা অনেকেই তা বোঝেন না কিংবা বোঝার চেষ্টা করেন না বা বোঝেন না। শিশুপুত্র বা কন্যা স্কুলের হোমওয়ার্ক ঠিকমতো না করলে বা ক্লাস ঠিকমতো ফলো করতে না পারলেই তাকে বকাঝকা করেন। চাপ সৃষ্টি করেন।

এর কারণও অবশ্য আছে। রাজধানীর কিছু সেরা স্কুল আছে, যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো শিক্ষার্থী ভালো ফল করতে না পারলে তাকে বহিষ্কার করা হয়। বিদ্যালয়ের মান ঠিক রাখতে এবং অন্যদের ওপর বিরূপ প্রভাব ঠেকাতে এই ব্যবস্থা। এতে অভিভাবকেরা ভাবেন, এত কাঠখড় পুড়িয়ে যখন ভর্তি করা গেছে, কাজেই কিছুতেই খারাপ করা চলবে না। এ জন্য সন্তানের ওপর খড়্গহস্ত কাপালিকের মতো পাষাণ হতেও দ্বিধা করেন না। এতে যেসব শিশু একটু কম মেধাবী, বুঝতে সময় লাগে, পড়াশোনায়ও গড়িমসি ভাব, তাদের জীবন শিগগিরই বিষিয়ে ওঠে। পড়ার চাপে তারার আলো-ঝলমল কল্পনার বিশাল ভুবন সংকুচিত হয়ে আসে। তারা প্রাণখুলে খেলতে পারে না, মনখুলে গল্প করতে পারে না, অবাধে কারও সঙ্গে মিশতে পারে না। দ্বন্দ্বমুখর এক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বড় হতে থাকে অনেকেই।

একটি শিশু স্কুলে যেতে শুরু করলে তার বাড়ির পরিবেশ আর পরিস্থিতিও পাল্টে যায়। প্রথম যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ওঠে, তা হলো শিশুটিকে স্কুলে রোজ নিয়ে যাওয়া এবং ছুটির পর নিয়ে আসা। এ ক্ষেত্র মা-বাবা দুজনই কর্মজীবী হলে অনেক সময় দুজনের মধ্যে ঠেলাঠেলি শুরু হয়। আবার সমঝোতার ভিত্তিতে দুজনই আনা-নেওয়া করে থাকেন। বাসায় মুরব্বিশ্রেণির কেউ থাকলে অনেক সময় এ দায়িত্ব তাঁর ওপর দিয়ে রেহাই পাওয়া যায়। বাড়ি থেকে স্কুলের অবস্থান দূরে হলে সৃষ্টি হয় আরেক সমস্যা। এত দূরে রোজ কে নিয়ে যাবে? সে ক্ষেত্রে অনেক সময় বাসা বদল করে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হয়। স্কুলে কাছে নতুন বাসায় উঠে যায় গোটা পরিবার। সে ক্ষেত্রে বাবা বা মায়ের কর্মস্থলে যাওয়া নিয়ে সমস্যা হলেও সন্তানের দিকে তাকিয়ে তা কোনোভাবে পুষিয়ে নেওয়া হয়।

সন্তানকে মা বা বাবা নিয়মিত স্কুলে নিয়ে গেলে সেখানে তাঁদের আলাদা একটা গণ্ডি তৈরি হয়। মায়ে-মায়ে সখ্য, বাবায়-বাবায় বেশ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এসব বন্ধুত্ব অনেক সময় বেশ গভীর হয়। পারিবারিক ওঠা-বসা চলে। বিশেষ করে মায়ের সঙ্গে মায়ের বন্ধুত্ব। স্কুল গেটের আশপাশ বা ভেতরের চত্বরে মায়েরা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে বসে গল্প করেন। কে কোন সিরিয়ালের ভক্ত, কার বাড়িতে কী হলো, কে কোন রান্নাটা ভালো করেন—এসব নিয়ে বেশ গল্পগুজব চলে। মায়েরা মিলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে থাকেন। ভালো কোনো হোটেল খাওয়াদাওয়া চলে। বনভোজনও হয়। সন্তানসূত্রে এই সামাজিক বন্ধন অবশ্যই শুভ দিক।

কিন্তু অশুভ দিকও আছে, যখন সন্তানকে নিয়ে মায়ে-মায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে। এক মায়ের সন্তান পরীক্ষায় ভালো করেছে বলে যখন আরেক মা তাঁর তুলনামূলকভাবে কম মেধাবী শিশুর ওপর চাপ প্রয়োগ করেন, তখন তা অবশ্যই ভালো কিছু নয়। এখানে মনে রাখতে হবে, সব শিশুর মেধা এক রকম নয়। আর সব শিশুর ধাঁচও এক নয়। একটি শিশু খুব পড়াশোনা করে, কিন্তু পরীক্ষায় আশানুরূপ করতে পারে না—এটা হতে পারে। আবার একটি শিশু একটু পড়েই অনেক ভালো ফল করে, এটা তো অহরহ হচ্ছে। ফল একটু খারাপ হলেই যে শিশুটির পড়াশোনা শেষ হয়ে গেল, তা তো নয়। কাজেই বছরের শুরুতে কচিপ্রাণ শিশুরা যখন নতুন করে ক্লাস শুরু করতে যাচ্ছে, এখানে এসব শিশুর মা-বাবার প্রতি অনুরোধ থাকবে, দোহাই, ওদের ওপর চাপ প্রয়োগ করবেন না। পড়া-পড়া করে ওদের খেলাধুলা আর বিনোদন কেড়ে নিয়ে শৈশবকে অথর্ব করে দেবেন না।

আর যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খারাপ ফলের জন্য শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করে, তাদের প্রতি অনুরোধ রইল, বহিষ্কারের বদলে অন্য কোনো ব্যবস্থা উদ্ভাবনের, যাতে স্কুল থেকে ছিটকে পড়ে ওদের শিক্ষার ধারাটা মুখ থুবড়ে না পড়ে। শুধু ভালোকেই আমরা বুকে তুলে নেব, মন্দের দায়িত্ব নেব না, এটা কেমন কথা? ওদের তাহলে দেখবে কে?

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
[email protected]