কেবল শিক্ষকদের বেলায়ই বরাদ্দের অভাব?

অনশনরত শিক্ষকদের জন্য চাই ন্যায্যতা ও সদিচ্ছা
অনশনরত শিক্ষকদের জন্য চাই ন্যায্যতা ও সদিচ্ছা

দেশের উন্নয়নের উপরিভাগে যা দেখা যায়, তার ঠিক উল্টো চিত্রের দেখা মিলবে প্রেসক্লাবের সামনে গেলে। সেখানে বেসরকারি শিক্ষকেরা আমরণ অনশন করছেন। কিন্তু কে আর উন্নয়নের নিচে জমে থাকা তলানি দেখতে চায়? তার চেয়ে বরং ভাবতে ভালো লাগে, নিশ্চয়ই এমপিওভুক্তির (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) আন্দোলনের পেছনে কোনো দুরভিসন্ধি আছে, অথবা বই উৎসব বানচাল করতেই ‘ষড়যন্ত্র’। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করবেন, আন্দোলনের টাকা কোথা থেকে আসে? জিজ্ঞেস করবেন না, কেন তাঁদের না খেয়ে, ঋণে জর্জরিত হয়ে বা অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে, অপমান সহ্য করে, পরিবারের অভিযোগ শুনে, বিনা চিকিৎসায় জীবন পার করে দিতে হবে।

অথচ শিক্ষকদের এই অনশনের সিদ্ধান্ত আকস্মিক নয়। এর আগেও আমরা তাঁদের পথে নামতে দেখেছি, মার খেতে দেখেছি। ২০১৫ সালেও প্রথমে শহীদ মিনারের সামনে, পরে প্রেসক্লাবের সামনে এমপিওভুক্তির দাবিতে অবস্থান করছেন আট হাজারেরও বেশি নন-এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার এক লক্ষাধিক শিক্ষকের প্রতিনিধি। তখনো বিবেচনা করা হবে—এই আশ্বাস নিয়ে চলে যেতে হয়েছিল তাঁদের। ২০১৩ সালেও তাঁরা একই দাবি নিয়ে টানা ১২ দিন শহরের রাস্তায় রাত কাটিয়েছেন। তখন আমরা দেখেছি, পুলিশ কী নিষ্ঠুরভাবে পেপার স্প্রে ব্যবহার করে শিক্ষকদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিল এবং পরে লজ্জায় পড়েই বোধ হয় শিক্ষামন্ত্রী তাঁদের এই দাবি বিবেচনা করবেন বলে আন্দোলন স্থগিত করার পরামর্শ দেন এবং নির্যাতিত শিক্ষকেরা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে ফিরে যান।

শিক্ষা বাজেট বরাদ্দ আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে—এই তথ্য বারবার একরকম সন্তুষ্টি বাক্য হিসেবে আমরা বহুল ব্যবহৃত হতে দেখেছি। আরও দেখেছি, যাঁদের শিক্ষা বাজেট বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব পেশ করার কথা, সুপরিকল্পিতভাবে সংকট নিরসন করার কথা, তাঁরাই বাজেটের ঘাটতিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে দায়মুক্তির পথ খুঁজছেন। বাজেটের শতাংশ হিসাবে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ যে প্রতিবছর কমে আসছে, তা দেখিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নিজেই এর সমালোচনা করেন এবং এই অপ্রতুল বরাদ্দকে দায়ী করে নিজে দায়মুক্ত হন। এটি খুবই বাজে সংকেত। কারণ, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোতে শিক্ষা খাত দুর্বলীকরণ প্রক্রিয়া শুরুই হয় এই অর্থাভাবের ধারণাকে জনপ্রিয় করে তোলার মধ্যে দিয়ে। বরাদ্দ কত হচ্ছে, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, শিক্ষা খাত কি আদৌ এই সময়ের সংকট নিরসন করতে পারছে?

এমপিওভুক্তির যোগ্যতা অর্জন করতে সরকারের স্বীকৃতি প্রয়োজন। এবং এই স্বীকৃতি অর্জন করার জন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ভৌগোলিক দূরত্ব ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাপ্যতার শর্তপূরণ করতে হয়, শিক্ষা বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয় বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রেজিস্টার্ড হতে হয়, সরকার অনুমোদিত জনবল কাঠামো অনুযায়ী শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োজিত থাকতে হয়, প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষার্থী থাকতে হয়, পাবলিক পরীক্ষায় কাম্য ফলাফল অর্জন করতে হয় ইত্যাদি। সরকারের আর্থিক সহযোগিতা ছাড়া এসব শর্তপূরণ মোটেই সহজ কাজ নয়। সেই কঠিন কাজটা যাঁরা করেন, তাঁরা এসব শিক্ষক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর পর থেকে সরকারের তরফ থেকে তাঁরা কোনো বেতন পাননি বরং পারস্পরিক সহায়তার মধ্যে দিয়ে স্কুল চালিয়ে নিয়েছেন। এসব পরিশ্রমী শিক্ষক কেউ কেউ সংসার চালানোর জন্য দিনমজুরের কাজ পর্যন্ত করেছেন।

একটা প্রাথমিক হিসাবে দেখা গেছে, এমপিওভুক্তির শর্তপূরণ করেছে—এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে মাসিক বেতনের আওতায় আনতে সরকারকে প্রতিবছর প্রায় ১০০০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। অবশ্য সরকারের কাছ থেকে আমরা এখনো যথাযথ কোনো হিসাব পাইনি। সরকার এই বিষয় নিয়ে এতটাই নীরব যে ঠিক কত টাকা হলে এই শিক্ষকদের মাসিক বেতনের আওতায় আনা যায়, তা প্রকাশ করছেন না। হয়তো দেখা যাবে, এই অর্থ হলমার্ক কেলেঙ্কারির অর্থের চার ভাগের এক ভাগ। অথবা বহুজাতিক কোম্পানির ফাঁকি দেওয়া করের তিন ভাগের এক ভাগ। অথবা ধনীদের বিদেশে পাচারকৃত অর্থের দশ ভাগের এক ভাগ। আর তখন অর্থমন্ত্রী চাইলেও অস্বীকার করতে পারবেন না যে অর্থের অভাবে নয় বরং সদিচ্ছার অভাবে এই শিক্ষকদের বেতন দেওয়া যাচ্ছে না। এসব তথ্য সামনে রেখে শিক্ষামন্ত্রীও দাবি করতে পারবেন না, বাজেটের অপ্রতুলতাই এমপিওভুক্ত না করার কারণ।

শিক্ষামন্ত্রী ২০১৫ সালে বলেছিলেন, আমরা এমপিও দেওয়ার লক্ষ্যে বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। নতুন বরাদ্দ না পেলে প্রয়োজনে বিকল্প ব্যবস্থা করা হবে। এমপিও নিচ্ছে কিন্তু নীতিমালা পূরণ করছে না, এমন অনেক প্রতিষ্ঠানের এমপিও কেটে দেওয়ার বিকল্প অর্থসংস্থানের কথাও তিনি বলেছিলেন। বাড়তি খরচ যাতে বহন করতে না হয়, সে জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার যে কথা শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, তাতে বিতর্ক আরও বাড়বে। অর্থায়ন সমস্যা হলে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ কী? আর একবার স্বীকৃতি দিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণই বা কেন? এর মাধ্যমে পারস্পরিক কোন্দল তৈরি করে এমপিওভুক্তির দাবিকে দুর্লভ করার রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের পথটি আরও সুগম করা হবে।

একদিকে বাজেটের সময় শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রচার করা হয়, অন্যদিকে প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকার কারণ দেখিয়ে সারা বছর ধরে চলে শিক্ষা সংকোচন, বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের নানান তৎপরতা। অর্থের অপ্রতুলতার কথা বলে সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন ফি/ভর্তি ফি বাড়ানো হয়, পাবলিক সেক্টরে প্রয়োজনীয়সংখ্যক প্রাথমিক মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের বদলে বেসরকারিকরণকে উৎসাহিত করা হয়, এমনকি বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থটুকু পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয় না। সংকটের সময় অপ্রতুল বরাদ্দের ‘অজুহাত’ দিলেও বাজেটের সময় বরাদ্দ বাড়িয়ে নেওয়ার তৎপরতা চালাতে দেখা যায় না। ফলে বছরের পর বছর ধরে অপ্রতুল বরাদ্দের কারণ দেখিয়ে শিক্ষা খাতের বহু সংকটকে জিইয়ে রাখা চলছেই। শিক্ষামন্ত্রীর উচিত শিক্ষা খাতের অপ্রতুল বরাদ্দ জনগণকে না মনে করিয়ে দিয়ে বাজেটের সময় সরকারকে মনে করিয়ে দেওয়া। এবং কোন খাতে সংকট নিরসনে কত প্রয়োজন, তা জনগণের কাছে উন্মুক্ত করা।

২০১০ সালে ব্যানবেইসের জরিপে এমপিওভুক্তির জন্য অপেক্ষমাণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৫৫। বিরূপ পরিস্থিতিতে গত সাত বছরে এই সংখ্যা নেমে হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার। অর্থাৎ অনেক প্রতিষ্ঠান এমপিও অর্জনের স্বীকৃতি পেয়েও তা ধরে রাখতে পারেনি, অনেক স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। এর অর্থ হলো এই দেশে একদিকে উন্নয়ন হচ্ছে বলে দাবি করা হচ্ছে, আর অন্যদিকে কোথায় কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তা আর খবর হয়ে আসছে না। অনেক শিক্ষক বলেছেন, তাঁদের স্কুলে নতুন দালানকোঠা হয়েছে, পুরোনো ভবন মেরামত হয়েছে, কিন্তু শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার ব্যাপারেই কেবল সরকার উদাসীন। ১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে মাধ্যমিকের ১৬৩টি স্কুলে চলন্ত সিঁড়ি বানানোর মতো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে তাদের উৎসাহ দেখার মতো। এসব কাজে লুটপাটের ভাগও বেশি। চলন্ত সিঁড়ির জন্য নির্ধারিত বরাদ্দের উদাহরণই বলে দেয় বাজেট সমস্যা নয়, সমস্যা সদিচ্ছার।

এ রকম পরিস্থিতির মাঝেও বিশ্বাস করতে চাই, দ্রুত শিক্ষকদের এমপিওর আওতায় এনে সরকার প্রেসক্লাবের সামনে অনশনরত শিক্ষকদের দাবি পূরণ করবে।

মোশাহিদা সুলতানা: শিক্ষক, ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়