এরশাদের সুবিচার-অবিচার

নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে পতিত স্বৈরাচারী শাসক ও জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপিকে আবারও একহাত নিয়েছেন। তিনি নব্বইয়ের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের দুই প্রধান দলের বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ এনেছেন। বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টির সহযোগিতা নিয়ে আওয়ামী লীগ তিনবার ক্ষমতায় এসেছে। বিনিময়ে আমরা কিছুই পাইনি। কেউ আমাদের সঙ্গে সুবিচার করেনি।’ (যুগান্তর, ২ জানুয়ারি ২০১৮)

এরশাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত হয়েছেন, তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ ২০১৪ সালের নির্বাচনের সুবাদে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা হয়েছেন। আবার বিরোধী দলে থেকেও জাতীয় পার্টির তিন নেতা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এরশাদ ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক হয়েছেন। এরপরও যদি বলেন তিনি কিছু পাননি, সেটি ডাহা মিথ্যা কথা।

পৃথিবীর আর কোনো দেশে পতিত স্বৈরাচারী শাসকের রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার দৃষ্টান্ত নেই। কিন্তু বাংলাদেশে এরশাদ সাহেব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এবং নব্বই-পরবর্তী গণতান্ত্রিক শাসকেরাই সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী শাসকের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সাবেক স্বৈরশাসক এখন আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইছেন।

১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আরও যেসব কথাবার্তা বলেছেন, তা যেকোনো গণতান্ত্রিক দল ও নেতার জন্য অপমানকর। সাবেক স্বৈরশাসক নিজেকে কেবল নিষ্কলুষ প্রমাণের চেষ্টা করেননি, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শহীদদের আত্মদান নিয়েও কটাক্ষ করেছেন।

এরশাদের ভাষ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে বিএনপি তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব দিয়েছিল। কারাগারে বন্দী এরশাদের কাছে সেই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল রওশন এরশাদের মাধ্যমে। সেই প্রস্তাব গ্রহণ না করে এরশাদ সাহেব আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার পথ সহজ করেছেন বলে দাবি করেছেন। হক দাবি। কিন্তু তারপর তিনি যে বিএনপি-জামায়াতকে নিয়ে জোট করে আওয়ামী লীগ সরকারকে হটানোর আন্দোলনে নেমেছিলেন, সেই বিষয়টি চেপে গেছেন। সেই জোট স্থায়ী হয়নি। জাতীয় পার্টিও বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরশাদ বিএনপির আমলে তাঁর পাঁচ বছর জেলবাস নিয়ে আফসোস করেছেন। কিন্তু কীভাবে জেল থেকে মুক্তি পেলেন, সে সম্পর্কে একটি কথাও বলেননি। আরও বিস্ময়কর যে সেনাসমর্থিত দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াসহ অনেক নেতা জেল খাটলেও এরশাদ ছিলেন বহাল তবিয়তে।

এরশাদ বলেছেন, তিনি আওয়ামী লীগকে তিনবার ক্ষমতায় এনেছেন। তাহলে আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থক ও নেতা-নেত্রীরা কী করেছেন? আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে এরশাদ সাহেবই বরং বেশি লাভবান হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ। একইভাবে বিএনপির সঙ্গে জোট করে লাভবান হয়েছে জামায়াতে ইসলামী। বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুই প্রধান দল গণতন্ত্রের নিয়ম মানলে স্বৈরাচার কিংবা রাজাকারের দলের সঙ্গে জোট করতে হতো না। যে এরশাদ সংবিধান লঙ্ঘন করে একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে গায়ের জোরে ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই এরশাদ এখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে গণতন্ত্রের সবক দিচ্ছেন। সুবিচার-অবিচারের অলীক কাহিনি শোনাচ্ছেন।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ বলেছেন, ‘১৯৯৬ সালে বিএনপির পক্ষ থেকে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আমি আওয়ামী লীগকে সমর্থন করি। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। কিন্তু বিনিময়ে তারা (আওয়ামী লীগ) আমার দলের তখনকার মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে দিয়ে দল ভাঙেন, আমাদের ১৪ জন সংসদ সদস্যকে কিনে নেন। আমাকে পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা করাসহ নির্বাচনে অযোগ্য করা হয়। ২০০৮ সালে মহাজোট করি। কথা ছিল ৪৮টি আসন দেওয়া হবে, কিন্তু দেওয়া হলো ৩৩ টি। ২৯ টিতে জয়ী হলাম। বিএনপি পেল ৩০টি আসন। আমাদের কাছ থেকে ১৭টি আসন কেড়ে না নেওয়া হলে আমরা তখন প্রধান বিরোধী দল হতাম।’ (যুগান্তর, ২ জানুয়ারি ২০১৮)

এরশাদ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তাঁর দল ভাঙার অভিযোগ আনলেও তিনি যে ক্ষমতায় এসে কীভাবে শামসুল হুদা চৌধুরী ও এম এ মতিনকে দিয়ে বিএনপিকে ভেঙেছিলেন; আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন দল থেকে লোক ভাগিয়ে নিয়ে নতুন দল করেছিলেন, সেসব কথাও দেশবাসীর জানা আছে। উর্দি পরে এ দেশে রাজনীতি করেছেন জিয়া-এরশাদ দুজনই।

এরশাদ সাহেব নির্বাচন, গণতন্ত্র ও বিচারকে যেভাবে দেখছেন, তাতে নীতি-নৈতিকতার কোনো বিষয় নেই। কে জেলে যাবেন, সেটি নাকি আগেই ঠিক করে রাখা হয়। তাঁকে জেল-জরিমানা করেছেন আদালত। আর তিনি দোষ চাপাচ্ছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিরুদ্ধে। তাঁর মতো কেউ সামরিক আদালতে বিরোধী দলের নেতাকে জেল দিয়ে আবার মন্ত্রী বানাননি। এরশাদ বলেন, ‘সীমাহীন অত্যাচারের মাধ্যমে বিএনপি আমাদের নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিল। আমাকে ও আমার পরিবারকে বিনা দোষে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। আজ কারাগার আপনার (খালেদা জিয়া) অতি সন্নিকটে। আমার প্রতি অনেক অন্যায় করেছেন, তার প্রতিফলন পেতে যাচ্ছেন।’

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আনীত মামলার বিচার চলছে। কিন্তু এরশাদ কীভাবে আগেই বলে দিলেন তাঁর কারাগার সন্নিকটে। তিনি কি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা? কীভাবে জানলেন খালেদা জিয়ার কারাগার সন্নিকটে? ক্ষমতায় থাকতে এরশাদ সাহেব স্বপ্ন দেখে দেখে মসজিদে যেতেন।

সবচেয়ে হাস্যকর বক্তব্য হলো, এরশাদ নাকি রাষ্ট্রপ্রধান হতে চাননি। তৎকালীন বিএনপির সরকারের মন্ত্রিসভা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে আবদুস সাত্তার তাঁকে ক্ষমতা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তাঁর এই কুযুক্তি মেনে নিলে আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান কেউ ক্ষমতা দখল করেননি। পূর্বসূরি শাসকেরা তাঁদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে স্বেচ্ছা অবসরে গিয়েছেন। তাঁর কথা সত্য হলে মেনে নিতে হয় ১ / ১১-তেও ইয়াজউদ্দীন আহম্মেদ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জেনারেলদের কাছে দেশের শাসনভার তুলে দিয়ে নিজে নামকাওয়াস্তে রাষ্ট্রপতি থেকেছেন।

এরশাদ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতি যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে মেরেছেন, তার জবাব তারা কীভাবে দেবে কিংবা আদৌ দেবে কি না, সেটি তারাই জানে। তাঁর দাবি, ‘আমার হাতে রক্তের দাগ নেই। ডা. মিলনকে কে বা কারা হত্যা করেছে, আমি জানি না। হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারও করা হয়নি। নূর হোসেনকে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যার বিচার কোনো সরকারই করল না। আমি ক্ষমতায় আসতে পারলে এই হত্যার বিচার করে প্রমাণ করব, এই হত্যার পেছনে কারা ছিল।’ (যুগান্তর, ২ জানুয়ারি ২০১৮)

যে স্বৈরশাসক এরশাদকে এ দেশের ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করেছে, যে স্বৈরশাসককে হটাতে নূর হোসেন-তাজুলেরা জীবন দিয়েছেন, শিল্পী কামরুল হাসান যাঁকে নিয়ে ‘বিশ্ব বেহায়া’ কার্টুন এঁকেছিলেন, নব্বইয়ের পর যাঁর বিচারের দাবিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সোচ্চার ছিল, সেই স্বৈরশাসক কীভাবে এই আস্ফালন দেখান? তিনি কি বলতে চান, আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলগুলোই সেই সময় নূর হোসেন, ডা. মিলনদের হত্যা করেছে? তাহলে তিনি ক্ষমতায় থাকতে হত্যার বিচার চেয়ে মামলা করলেন না কেন?

এরশাদ একাধিকবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন; কিন্তু তাই বলে তাঁর গায়ে লেগে থাকা স্বৈরশাসকের কালিমা মুছে ফেলতে পারেননি। এখনো তাঁর ওপর মঞ্জুর হত্যাসহ অনেক মামলার খড়্গ ঝুলছে। এরশাদের এই আস্ফালনের পর নূর হোসেন-তাজুলদের আত্মা আমাদের ক্ষমা করবে কি?

এরশাদের ক্ষমতারোহণই কেবল ষড়যন্ত্রমূলক ছিল না। নব্বইয়ে গণ-আন্দোলনের মুখে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ষড়যন্ত্র করছিলেন ক্ষমতায় থাকার জন্য। এরশাদ নতুন করে সামরিক শাসন জারি করতে চেয়েছিলেন। তৎকালীন সেনাপ্রধান নূর উদ্দিন খান রাজি হননি বলে তাঁর সেই ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। তিনি নিজেকে যতই সাচ্চা বলে দাবি করুন না কেন, সেই সময়ের দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকাগুলো তাঁর অপরিমেয় দুর্নীতি-অপশাসনের সাক্ষ্য হয়ে আছে।

এরশাদ সম্পর্কে তাঁরই একসময়ের প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান লিখেছিলেন: ‘আমার সরল বিশ্বাসের সুযোগে সামরিক প্রশাসক কীভাবে তাহার প্রদত্ত অঙ্গীকার ভঙ্গ করিয়া স্বৈরতন্ত্র চিরস্থায়ী করিবার সমস্ত কৌশল নিয়োগ করিয়াছে এবং অন্যান্য স্বার্থবাদী মহল ও জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে তাহার অনুকূলে সমর্থন জোগাইয়াছে, তাহারই একটি চিত্র এই বইয়ে আঁকিবার চেষ্টা করিয়াছি।’ (পৃষ্ঠা ৮, প্রধানমন্ত্রিত্বের নয় মাস, নওরোজ কিতাবিস্তান।)

একদা স্বৈরশাসক এখন গণতন্ত্র সম্পর্কে গণতান্ত্রিক দল ও নেতা-নেত্রীদের ‘সুপরামর্শ’ দিচ্ছেন। এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কী হতে পারে?

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan 55 @gmail. com