ভুলচুক থাকলেও সফলতা অফুরন্ত

>

প্রথম আলোর মুখোমুখি হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

তোফায়েল আহমেদ
তোফায়েল আহমেদ

প্রথম আলো: সাফল্যের কথা তো আমরা সব সময় শুনি। আপনাদের সরকারের ৯ বছরের শাসনের ব্যর্থতার জায়গা নিয়ে কিছু বলবেন?

তোফায়েল আহমেদ: ব্যর্থতা দিয়ে কেন শুরু করব? সেটা পরে। আগে অন্য কথা বলি। ৬ জানুয়ারি ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছিল। যদি সাফল্য দেখি, তাহলে অফুরন্ত সফলতাই দেখব। সবক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার যখন ক্ষমতা নেয়, তখন রপ্তানি ছিল ৩৮০ কোটি ডলার, ক্ষমতা হস্তান্তরকালে তা ৬৭০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। বিএনপি এটা ১ হাজার কোটি ডলারে রেখে আসে। ২০০৯ সালে আমরা ১৪০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয় পেয়েছিলাম। আর ২০১৬-১৭ সালে সেবা খাতসহ মোট রপ্তানি বেড়ে হয় ৩ হাজার ৮৫০ কোটি ডলার। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে আমরা ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের বেশি রপ্তানি আয় পেয়েছি। ২০০৯ সালে রিজার্ভ ছিল ৪০০ কোটি ডলারের মতো। সেটা এখন ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। রেমিট্যান্স ছিল ৪০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি। সেটা এখন প্রায় দেড় হাজার কোটি ডলার। বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ৩ হাজার মেগাওয়াট। এখন তা ১৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। ৮৩ শতাংশ মানুষ এখন বিদ্যুৎ-সুবিধা পাচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ পাবে। বিশ্বব্যাংককে অগ্রাহ্য করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার যে অনন্যসাধারণ উদ্যাগ বঙ্গবন্ধু-কন্যা নিয়েছিলেন, পদ্মাবক্ষে তার অবয়ব ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। কিছু কিছু ভুলচুক বা অপারগতা তো থাকতেই পারে। গত মাসের শুরুতে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী সরফরাজ আজিজের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় দেখা হলো। তিনিই স্বীকার করলেন যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে তাঁদের চেয়ে অনেক অগ্রগামী। পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, বিদ্যুৎ উৎপাদন, রপ্তানি—সবটাই বেশি। কিছু ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে থাকার কথা অমর্ত্য সেনও বলেছেন। গড় আয়ুতে আমরা ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে।

প্রথম আলো: এসব উন্নয়ন সত্ত্বেও আপনাদের নিয়ে বড় একটা আক্ষেপ হলো, সুশাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রে আপনারা মানুষের প্রত্যাশা পূরণ থেকে অনেক পিছিয়ে আছেন। একতরফা নির্বাচন দিয়ে একলা চলো নীতির সমালোচনাকে কীভাবে দেখছেন?

তোফায়েল আহমেদ: আমি একমত নই। জননেত্রী শেখ হাসিনা দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করে বিশ্বনন্দিত হয়েছেন। সৎ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আঙ্গেলা ম্যার্কেল ও সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর নামও আলোচিত হয়েছে। পানামা ও প্যারাডাইস পেপারসে কিন্তু আমরা নেই। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র আশঙ্কা গুঁড়িয়ে বাংলাদেশ যে বিস্ময়কর উত্থানের ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে, তার দিনক্ষণ আপনাকে বিবেচনায় নিতে হবে। সেটা শুরু হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই।

প্রথম আলো: অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও মানবাধিকারের প্রশ্নকে শিথিল রেখে যে উন্নয়ন, তার বিপদ সম্পর্কে ড. আকবর আলি খান নতুন বছরে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হুঁশিয়ার করেছেন। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, এ ধরনের উন্নয়নধারা কখনো দুর্ঘটনাকবলিত হতে পারে।

তোফায়েল আহমেদ: আমি তা মনে করি না। আমরা কখনো এ কল্পনা করি না যে এখানকার উন্নয়ন কোনো দুর্ঘটনায় পড়বে। আপনি গ্রামে যান। সেখানে মোবাইল ফোনসহ হাতে ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা দেখবেন। শতভাগ মানুষ জুতা পায়ে হাঁটেন। অধিকাংশ বাড়ি পাকা। সেখানে টেলিভিশনসহ আধুনিক জীবনের উপকরণের ছড়াছড়ি। এসব নিকট-অতীতেও বিরল দৃশ্য ছিল। গ্রামগুলো পরিণত হয়েছে শহরে। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বাংলাদেশ ঘুরে গিয়ে লিখেছেন, গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে বাংলাদেশ অবশিষ্ট বিশ্বের কাছে রোল মডেল হতে পারে।

প্রথম আলো: রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে বোঝাপড়া ছাড়া একলা চলোর বিপদ সম্পর্কে বলুন। আপনারা আর কি কোনো চেষ্টাই করবেন না?

তোফায়েল আহমেদ: চেষ্টা কি আমরা কম করেছি? বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে কোকোর মৃত্যুর পরে শোক প্রকাশ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিব্রত হলেন। এরপরও তাঁকে আলোচনায় বসতে টেলিফোন করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ ৫টি মন্ত্রণালয় দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। বেগম জিয়াই তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ৫টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরও তারা নির্বাচন বয়কট করলে তার দায়ও আমাদের নিতে হবে?

প্রথম আলো: মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, ওসব ছিল রাজনৈতিক তামাশা। তাতে আন্তরিকতা ছিল না। এবারও কি তাদের জন্য তেমন প্রস্তাব আছে?

তোফায়েল আহমেদ: আরেকটু বলে নিই। যেমন ড. কামাল হোসেনের মতো লোক, যিনি কখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে জয়ী হননি, ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে শুধু হারেননি, তাঁর জামানাত বাজেয়াপ্ত হয়েছে, তিনি কীভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনকে কটাক্ষ করেন? আমরা করেছি, তাই লজ্জার। তাঁর জয়ী হওয়াটা লজ্জার ছিল না?

প্রথম আলো: এ দুই ঘটনা কীভাবে তুলনীয় হয়? জাতীয় ইতিহাসের এক গৌরবজনক প্রেক্ষাপটে জাতির জনকের ছেড়ে দেওয়া আসনে (১৯৭০ ও ৭৩-এ ঢাকার দুটি আসনে) তিনি নির্বাচিত হয়েছেন।

তোফায়েল আহমেদ: আপনি বলবেন, ঘটনা তো একটি? কিন্তু একটি, ৫০ কি ১০০টি হোক, নীতিগত জায়গাটা তো অভিন্নসংবিধানেও তো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া নির্বাচনের সুযোগআছে। তা ছাড়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে না গিয়ে যে বিএনপি ভুল করেছিল, মঙ্গলবারে বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যে সেটা ফুটে উঠেছে।

প্রথম আলো: বিএনপির রাজনীতিতে তাহলে গুণগত একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন?

তোফায়েল আহমেদ: অবশ্যই। খালেদা জিয়ার মনমানসিকতা যে পরিবর্তিত হয়েছে, সে জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দিই। তিনি বলেছেন, সামনের নির্বাচনে তাঁদের বাইরে রাখা যাবে না। আমরা তো তাঁদের নির্বাচনে বাইরে রাখতে চাই না। তিনি নির্বাচনে আসুন, সেটাই আমরা চাই।

প্রথম আলো: কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনার অধীনে অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয়।

তোফায়েল আহমেদ: আপনি আপনার ডায়েরিতে টুকে রাখুন, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনেই নির্বাচন করবেন। কারণ নির্বাচন না করার কোনো বিকল্প নেই। ৫ সিটিতে জয়ী হওয়ার ভাবমূর্তি নিয়ে তিনি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যেতে পারতেন, কিন্তু যাননি। তিনি ভেবেছিলেন, এই সরকারের পতন ঘটাবেন। পারেননি। সেটা থেকে তিনি শিক্ষা নিয়েছেন। ২০১৫ সালে ৯৩ দিন আগুন-সন্ত্রাস করে, এর আগে ৩৬ পুলিশ হত্যা ও ৫০০ ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে বুঝেছেন, তিনি সফল হননি। এখন তাই দলীয় নেতা-কর্মীদের বলেছেন, বেশি কথা বলবেন না, চুপ থাকা ভালো। এটা তাঁর অভিজ্ঞতাপ্রসূত শিক্ষা।

প্রথম আলো: মির্জা ফখরুলের আশঙ্কা, বিএনপি যাতে নির্বাচনে না আসে, সে চেষ্টা আপনারা আগেও করেছেন, এখনো করছেন।

তোফায়েল আহমেদ: কেন আমরা সেটা করব?

প্রথম আলো: এ প্রশ্নের উত্তরে মির্জা ফখরুল বলেছেন, তাঁরা মনে করেন অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচন হলে বিএনপি ২৪০ আসনে জিতবে।

তোফায়েল আহমেদ: আমার প্রতিক্রিয়া হলো, বিএনপি সব সময়ই এ ধরনের মূল্যায়ন করে। ২০০১ সালে জয়ী হওয়ার পরে বেগম জিয়া বলেছিলেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০টি আসনও পাবে না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিই ৩০টির মতো আসন পেয়েছিল। আচ্ছা বলুন তো, যে দলটি আশা করে যে তারা ৮০ শতাংশ আসন পাবে, তারা নির্বাচন করবে না কেন? আমরা ফাঁদ পাতলে তারা তাতে পা দেবে কেন? তা ছাড়া আমরাই বা তেমন চেষ্টা করব কেন? বিশ্ব কি চোখ বন্ধ করে রেখেছে? সাবের হোসেন চৌধুরী ও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী দুটি মর্যাদাসম্পন্ন সংসদীয় প্রতিষ্ঠানে বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হওয়া কী প্রমাণ করে? এটা তো আমাদের সংসদের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ম্যান্ডেট। বিএনপি যদি মনেই করে যে তারা ক্ষমতায় এসে যাবে, সেটা তো ভালো। আমরা খুশি। সেই নির্বাচনে তাদের যোগদান আমরা কী করে ঠেকাব?

প্রথম আলো: তাঁরা বলছেন, তাঁদের নেতা-কর্মীরা পাইকারি মিথ্যা মামলার শিকার। মির্জা ফখরুলের নিজের নামে ৮৬টি মামলা ঝুলছে। এ তথ্য সঠিক হলে কি তাতে আওয়ামী লীগের অসহনশীলতা প্রকাশ পায় না?

তোফায়েল আহমেদ: তাঁর বিরুদ্ধে ৮৬টি মামলা আছে কি না আমি জানি না। তবে আমার বিরুদ্ধে বিএনপি ৪৯টি মামলা দিয়েছিল। নভোথিয়েটারসহ কিছু কিছু মামলা এখনো চলমান। সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার পথে গ্রেপ্তার করে তারা ক্যান্টনমেন্ট থানায় আমাকে এক রাত দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। এরপর তারা আমাকে রাখে কাশিমপুরে ফাঁসির আসামি কুখ্যাত এরশাদ শিকদারের সঙ্গে। গোয়ালন্দ ফেরিতে মুজাহিদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা চোখে পড়ল। সে মুহূর্তে আমার হাতে ছিল হাতকড়া। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে আমি ৩৩ মাস জেলে ছিলাম। ইউনেসকো-স্বীকৃত ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বাজলে মাইক কেড়ে নেওয়া হতো। বেগম জিয়াও তা বাজাতে দেননি। জনসভা করতে দেননি, গ্রেনেড মেরেছেন। তাই তাঁদের মুখে আওয়ামী লীগের নিন্দা সাজে না। এই সেদিনও তো মির্জা ফখরুল বলেছেন, জামায়াত তাঁদের সঙ্গে থাকবে।

প্রথম আলো: জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করা নিয়ে এখনো আপনারা দ্বিধান্বিত। একসময় তাহলে বিএনপির সমালোচনা করেছিলেন কেন?

তোফায়েল আহমেদ: জামায়াত যে যুদ্ধাপরাধী সে ব্যাপারে আদালতের একটি মন্তব্য আছে। আমরা আদালতের ফয়সালার অপেক্ষায় আছি। নিবন্ধনহীন দল হিসেবে তারা তো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। এটাও একটি অগ্রগতি। এখন তারা বিএনপির পক্ষে কাজ করে।

প্রথম আলো: আগামী নির্বাচনের আগেই জিয়া অরফানেজ ও ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় বেগম জিয়া ও তারেক রহমান দণ্ডিত হতে পারেন। এটা কি নির্বাচনী রাজনীতিতে কোনো বদল আনতে পারে?

তোফায়েল আহমেদ: সাজা না মুক্তি—কোনটি হবে, তা বলতে পরব না। আর গ্রেনেড হামলা তো আত্মস্বীকৃত। সুতরাং এ দুটির রায় তো নাগরিক হিসেবে মানতে হবে।

প্রথম আলো: বিএনপিকে কি কিছু মন্ত্রণালয় নির্বাচনকালীন সরকারে দেওয়ার চিন্তা আছে?

তোফায়েল আহমেদ: ওই স্থানে আমরা আর নেই। বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছিল। আমরাও মনোভাব পরিবর্তন করেছি। এখন আমরা আর তা করতে যাব কেন?

প্রথম আলো: স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম একটি নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের কথা বলেছিলেন। তাঁর কথা ছিল, প্রধানমন্ত্রী যাকে ইচ্ছে নেবেন বা বাদ দেবেন। সেটা তাহলে কী? এখন যে রদবদল, তার সঙ্গে নির্বাচনের কোনো যোগসূত্র আছে?

তোফায়েল আহমেদ: এটা ভিন্ন। ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে যে মন্ত্রিসভা হলো, তাতে আমি যোগ দিলাম। কিছু রদবদল হলো। তেমনিভাবে প্রধানমন্ত্রী তাঁর নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করে এবারও তা করতে পারেন। তবে এটা বলতে পারি, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকার শুধু দৈনন্দিন রুটিন কাজ করবে। বর্তমান মন্ত্রিসভা তখন অন্তর্বর্তী সরকারে রূপ নেবে।

প্রথম আলো: বিএনপি সেনাবাহিনীকে কেন ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিতে চাইছে?

তোফায়েল আহমেদ: এই প্রসঙ্গ নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। তারপরও বলছি, সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের গর্বের সন্তান। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তারা যথেষ্ট সুনামের অধিকারী। এই ক্ষমতা দিয়েই তারা (বিএনপি) ২০০১ সালে জিতেছিল। আমাদের মতো লোককে তাঁরা বাগানে ঘুম পাড়িয়েছেন। বাড়িতে থাকতে পারিনি। আমাদের নেতা-কর্মীরা জঙ্গলে পালিয়েছিল। তিনি আসলে সেটাই চাইছেন। আমার এলাকায় চারজন হত্যার শিকার হয়েছে। আপনিই বলুন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা কী? কেন ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিয়ে তাদের বিতর্কিত করব? ১৯৭২ থেকে ২০০১ সালের আগ পর্যন্ত তাঁরা এইড অব সিভিল প্রশাসন হিসেবে কাজ করেছেন। যেমন আমার এলাকা ভোলা জেলার সদরে তাঁরা অবস্থান নিয়েছেন।

প্রথম আলো: তাহলে কি আগামী নির্বাচনে ওভাবেই সেনা মোতায়েন হবে?

তোফায়েল আহমেদ: হ্যাঁ, ওভাবেই হবে। ২০০১ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা বদলে সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তাতে জড়িত ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেন ও সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ (তৎকালীন আইন উপদেষ্টা)। এই তিনজন মিলে কী করে আওয়ামী লীগকে হারানো যায়, তার পরিকল্পনা করেছিলেন।

প্রথম আলো: বিচারপতি সাহাবুদ্দীন রাষ্ট্রপতি হয়ে জড়িত ছিলেন?

তোফায়েল আহমেদ: অবশ্যই। দলীয় রাষ্ট্রপতি না করে আমরা ভুল করেছিলাম।

প্রথম আলো: বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে আরেক মেয়াদে পাব, নাকি দলের বাইরের কারও সম্ভাবনা আছে?

তোফায়েল আহমেদ: বর্তমান রাষ্ট্রপতি অত্যন্ত সৎ, যোগ্য ও নিবেদিত। তাঁকে নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে হবেন কি না, সেটা দলীয় হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে এটা বলতে পারি, দলীয় নেতাই রাষ্ট্রপতি হবেন।

প্রথম আলো: বর্তমান রাষ্ট্রপতির দ্বিতীয় মেয়াদের সম্ভাবনা তাহলে আপনি নাকচ করছেন না?

তোফায়েল আহমেদ: (হেসে) নাকচ করছি না, আবার বলছিও না। আমরা ভুল থেকে শিক্ষা নিই। আমরা বিশ্বাস করে অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি করেছিলাম। তার খেসারত ২০০১ সালে আমাদের দিতে হয়েছিল। তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা নিবেদিতপ্রাণ ১৩ জন সচিবকে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী পরিবর্তন করেছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে বিএনপি ওই দিন আবার ফিরে পেতে চায়।

প্রথম আলো: আপনি বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমাহিত হয়েছে। সেটা আর কখনো ফিরবে না। আপনারা কখনো বিরোধী দলে গেলে, তখন?

তোফায়েল আহমেদ: আমরা আর সেটা চাইব না।

প্রথম আলো: সৌদি আরবে সম্পদ থাকা প্রসঙ্গে বেগম জিয়ার দেওয়া লিগ্যাল নোটিশ সম্পর্কে মন্তব্য করবেন?

তোফায়েল আহমেদ: যে সংবাদ সংস্থা খবর দিল, বিএনপি তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না?

প্রথম আলো: বেসিক ও হল-মার্কসহ নানা আর্থিক কেলেঙ্কারিতে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা নয়ছয়ের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারে গতি নেই। কিন্তু খালেদা জিয়ার ৩ কোটি টাকা দুর্নীতির বিচারটি দ্রুত গতিলাভের বিষয়ে কী বলবেন?

তোফায়েল আহমেদ: কেন হল-মার্ক বা ডেসটিনির কর্মকর্তারা কি পলাতক বা জেলে নেই? সরকার কাকে ছাড় দিয়েছে?

প্রথম আলো: আসামের ১ কোটি ৯০ লাখ ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ ও তিস্তা চুক্তির বিষয়ে মন্তব্য?

তোফায়েল আহমেদ: আমি বিশ্বাস করি, ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে একটা বিশৃঙ্খলা বা অরাজকতার সৃষ্টি হয়। বরং তারা সতর্ক ভূমিকাই রাখবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর মেয়াদে তিস্তা চুক্তি করতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাঁর আরও দেড় বছরের মেয়াদ আছে, সুতরাং আমরা সেটার সব বাস্তবায়ন দেখার অপেক্ষায় আছি।

প্রথম আলো: আজ (৩ জানুয়ারি) এক ঐতিহাসিক দিনে আপনার সাক্ষাৎকার নিচ্ছি। কী মনে পড়ে?

তোফায়েল আহমেদ: বঙ্গবন্ধু ৩ জানুয়ারি ১৯৭১ সত্তরের নির্বাচিত সাংসদদের শপথ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ছয় দফা আর আওয়ামী লীগের নয়। এর সঙ্গে কেউ বেইমানি করলে জনগণ তাকে জ্যান্ত কবর দেবে। এমনকি আমি করলে আমাকেও।

প্রথম আলো: ছয় দফার মূলে ছিল সংসদীয় গণতন্ত্র। আমরা কি তাতে সফল?

তোফায়েল আহমেদ: তখন রাজনীতি ছিল রাজনীতিকদের হাতে। জিয়া রাজনীতিকে কঠিন করে গেছেন।

প্রথম আলো: গত ৯ বছরে সেটা স্বাভাবিক করতে কোনো সাফল্য?

তোফায়েল আহমেদ: দীর্ঘ সামরিক শাসনে স্বাধীনতাবিরোধীরা মাঠ দখল করেছে। রাজনীতিকেরা দূরে সরে গেছেন। ২৭ বছর ধরে ছাত্র সংসদ না থাকায় নতুন নেতৃত্বও গড়ে উঠছে না। ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার দায় এ সময়ের সব সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। আজ আমি এ কৃতিত্ব নেব না যে ওই অবস্থা থেকে সবকিছু স্বাভাবিক করতে পেরেছি। দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র আছে। তবে অন্যান্য রাজনৈতিক দল এগিয়ে না এলে আওয়ামী লীগের একার পক্ষে সংসদীয় গণতন্ত্রকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

তোফায়েল আহমেদ: ধন্যবাদ।