ঢাকায় আবাসন: কতটা সাধ্যের মধ্যে?

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

গ্রামে নিজস্ব আবাসনের ব্যবস্থা থাকলেও আর্থসামাজিক সুবিধা (যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য) পেতে মানুষ শহরমুখী হয়। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে নগরায়ণের হার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (৪ দশমিক ১৯ শতাংশ); সবচেয়ে বেশি নেপালে (৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ)। বাংলাদেশের শহরবাসীদের সিংহভাগ ঢাকায় থাকে। যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, তাতে ঢাকা ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নগরীতে রূপান্তরিত হবে, যা ২০১০ সালে ছিল ১১তম এবং তারও কুড়ি বছর আগে ১৯৯০ সালে ছিল ২৪তম।

দ্রুত নগরায়ণ বিদ্যমান আবাসন পরিস্থিতির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। চাহিদার তুলনায় বাসস্থানের জোগান কম হওয়ায় নগরবাসীকে বেশি মূল্যে বাসা ভাড়া বা ক্রয় করতে হয়। সাধারণত পরিবারের মোট আয়ের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া ও পরিষেবা খাতে ব্যয়কে সাধ্যের মধ্যে আবাসন ব্যয় হিসেবে গণ্য করা হয়। সম্প্রতি ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভলেপমেন্ট (বিআইজিডি) কর্তৃক প্রকাশিত বার্ষিক গবেষণা ‘স্টেট অব সিটিজ ২০১৭: হাউজিং ইন ঢাকা’ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকা শহরের ৮২ শতাংশ ভাড়াটে তাদের মোট আয়ের ৩০ শতাংশের বেশি বাড়িভাড়া ও পরিষেবা খাতে ব্যয় করে। আবাসনের এ ব্যয়কে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ উত্তরদাতা ব্যয়বহুল মনে করে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের অর্ধেকের বেশি আবাসনের ব্যয় মেটাতে গিয়ে পরিবারকে খাবার, শিক্ষা, বস্ত্র, বিনোদন প্রভৃতির ব্যয় সংকোচন করতে বাধ্য হয়েছে।

ঢাকায় একটি ফ্ল্যাটের মালিক হতে পারলে মাসে মাসে বাড়িভাড়ার খরচ থেকে নিস্তার পাওয়া যায়। কিন্তু ঢাকায় বসবাসকারী দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ভাড়াটের ফ্ল্যাট কেনার কোনো পরিকল্পনা নেই। অপর্যাপ্ত সঞ্চয়, ফ্ল্যাটের অতিমূল্য, সহজ শর্তে ব্যাংকঋণ না পাওয়া প্রধান কারণ হিসেবে গবেষণায় উঠে এসেছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী বাড়ির মালিকদের প্রায় ৬১ শতাংশ নিজের বা পরিবারের সঞ্চয় দিয়ে বাড়ি কিনেছে এবং এক-তৃতীয়াংশ বংশানুক্রমিকভাবে বাড়ির মালিকানা পেয়েছে। বাড়ি ক্রয়ে ব্যাংকঋণ কাজে লেগেছে মাত্র ১১ শতাংশ মালিকদের ক্ষেত্রে। উচ্চ সুদের হার, ঋণ পরিশোধের স্বল্প মেয়াদ ও বিদ্যমান ঋণ পাওয়ার যোগ্যতার মাপকাঠি ব্যাংকঋণের প্রতি অনাগ্রহের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। সম্প্রতি ব্যাংকঋণের সুদের হারে বেশ পরিবর্তন এসেছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের হিসাব অনুযায়ী রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের আবাসন ঋণের সুদের হার ১০ থেকে ১৪ শতাংশ আর বেসরকারি ব্যাংকগুলো দিচ্ছে ৮ থেকে ১৭ শতাংশ হারে, যা ২০১৫ সালে ছিল যথাক্রমে ১৫-১৬ শতাংশ ও সাড়ে ১০ থেকে সাড়ে ১৯ শতাংশ। অন্যান্য দেশের তুলনায় এ হার এখনো বেশি।

বাড়ি কেনার ক্ষেত্রে সঞ্চয়ের ওপর নির্ভরতা না কমালে এবং আবাসন ঋণ সহজতর না করলে বেশির ভাগ নগরবাসী বাড়ি কিনতে পারবে না। ঢাকার অর্ধেকের বেশি ভাড়াটে পরিবারের কোনো সঞ্চয় নেই। বাণিজ্যিকভাবে নির্মিতব্য সর্বনিম্ন আয়তনের বাসা হতে পারে ৭৫০ বর্গফুট। রিহ্যাবের ২০১৬ সালের শীতকালীন মেলায় প্রতি বর্গফুট গড়ে ৫ হাজার ৮০০ টাকায় ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছিল; সে হিসাবে ৭৫০ বর্গফুট আয়তনের বাসার মূল্য পড়বে ৪৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। একজন সম্ভাব্য ক্রেতা ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ঋণ নিতে পারবেন (ফ্ল্যাটমূল্যের ৭০ শতাংশ); বাকি টাকা ক্রেতাকে এককালীন পরিশোধ করতে হবে। বিদ্যমান সঞ্চয়ের হারে মাত্র ৬ শতাংশ পরিবার ৬ বছরে বাড়ি কেনার এ পরিমাণ অর্থ জোগাড় করতে পারবেন। এ ছাড়া রয়েছে ফ্ল্যাটমূল্যের ১৪ শতাংশ নিবন্ধন ও অন্যান্য খরচ।

ফ্ল্যাটের দাম বহুগুণ বেড়ে গেছে। একজন আবাসন ব্যবসায়ী যেখানে ধানমন্ডিতে ২০০৩ সালে প্রতি বর্গফুট ২ হাজার টাকা দরে ফ্ল্যাট বিক্রি করতেন, সেখানে প্রতি বর্গফুট এখন বিক্রি হয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা দরে। বাড়তি দামের পরিপ্রেক্ষিতে ক্রেতারা ছোট ও মাঝারি আয়তনের ফ্ল্যাটের দিকে ঝুঁকছেন। ফলে বাড়ির ভেতরে জনপ্রতি আবাসস্থল কমে যাচ্ছে। বর্তমানে ঢাকায় একজন মানুষ গড়ে ১২ দশমিক ৫ বর্গমিটার জায়গায় বাস করে, যা মুম্বাইয়ে ৩৩ দশমিক ২ বর্গমিটার এবং দিল্লিতে ৮৭ দশমিক ৪ বর্গমিটার।

ঢাকার মানুষের গাদাগাদি করে বসবাস করাও যেন গা-সওয়া হয়ে গেছে। বাড়ি কেনা বা ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের প্রধান বিবেচ্য বিষয় থাকে বাড়িটি যেন কর্মস্থলের কাছে হয়, বাসাভাড়া বা ফ্ল্যাটের মূল্য সহনীয় হয়, বাসার কাছাকাছি আত্মীয়–বন্ধুবান্ধব এবং ভালো স্কুল থাকে। আবাসের ভেতরকার অবস্থা, আশপাশে পার্ক বা খোলা জায়গা প্রভৃতির প্রতি খুব কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। কোনোভাবে জীবন কেটে গেলেই যেন হলো; আধুনিক নগরজীবনের গুণগত বিষয় থেকে তারা বঞ্চিত। গুণগত দিকের প্রতি নজর দিলে বা ভালো জায়গায় থাকতে গেলে যে বাড়তি টাকা গুনতে হবে, তা কোথায়?

বাসযোগ্য নগর গড়ে তুলতে হলে নগরবাসীর জন্য সাধ্যের মধ্যে আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ২০৩০ সালের মধ্যে সব নগরবাসীর জন্য পর্যাপ্ত, নিরাপদ ও সাধ্যের মধ্যে আবাসন ও মৌলিক সেবা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। বাংলাদেশের বেলায় এ লক্ষ্য অর্জন করা আরও গুরুত্বপূর্ণ। জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে সমগ্র বাংলাদেশ একটি নগররাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে। দেশের মোট নগরবাসীর ৪৪ শতাংশ ঢাকায় বসবাস করে এবং প্রতিবছর গড়ে ৫-৬ লাখ লোক গ্রাম থেকে ঢাকাগামী হচ্ছে। তাই ঢাকায় আবাসনের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি।

প্রথমত, স্বল্প খরচের বাড়ি সাধ্যের মধ্যে আবাসনের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। এ লক্ষ্য অর্জনে বাড়ির নির্মাণ ব্যয়, নিবন্ধন খরচ কমানোর উপায় খুঁজে বের করা দরকার। বাড়ি কেনার ক্ষেত্রে ব্যাংকঋণের সুদের হার কমানো, ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো এবং ফ্ল্যাটের মূল্যের ৯০-৯৫ শতাংশ ঋণের জোগান দেওয়া গেলে বেশিসংখ্যক মানুষ বাড়ি কিনতে আগ্রহী হবে। দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দিতে গেলে ব্যাংকের আমানতের ওপর চাপ পড়তে পারে; সে ক্ষেত্রে ‘আবাসন বন্ড’ প্রবর্তনের চিন্তা করা যেতে পারে। কেনা বাড়ি ব্যাংকের কাছে জামানত থাকায় আবাসন খাতে ঋণখেলাপি হওয়ার সুযোগ কম।

দ্বিতীয়ত, ভাড়াটের জন্য এলাকাভিত্তিক ভাড়ার হার নির্ধারণ করা এবং তা পর্যবেক্ষণের জন্য ওয়ার্ডভিত্তিক ভাড়া নিয়ন্ত্রক থাকা উচিত। স্বল্প আয়ের মানুষের বাড়িভাড়ার চাপ লাঘবের লক্ষ্যে ‘আবাসন কল্যাণ তহবিল’ প্রবর্তন করা যেতে পারে।

সবশেষে, ঢাকার ভূমির ব্যবহার আরও দক্ষতার সঙ্গে পরিকল্পনামাফিক হওয়া উচিত। বাড়ি বানাতে গেলে ভূমির ধরন অনুযায়ী সর্বনিম্ন ফ্লোরসংখ্যা সরকার নির্দিষ্ট করে দিতে পারে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বহুতল ভবন নির্মাণে অনেক ভূমিমালিকের আর্থিক সামর্থ্য থাকে না। এ ক্ষেত্রে আবাসন ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। বর্তমান আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগ প্রকল্প রাজধানীর কতিপয় এলাকায় কেন্দ্রীভূত। ঢাকার কেন্দ্র ও প্রান্তিক এলাকাগুলোকে পরিকল্পিত আবাসনের আওতায় এনে ত্বরিত যোগাযোগব্যবস্থা প্রবর্তন করা গেলে মানুষ সবদিকে ছড়িয়ে পড়বে এবং বাড়ির মূল্য ও ভাড়ার ক্ষেত্রে ভারসাম্য ফিরে আসবে। দেশের সব মানুষ ঢাকায় বসবাস করবে, সেটাও কাম্য হতে পারে না। প্রশাসনিক ও কর্মসংস্থানসহ আর্থিক খাতের বিকেন্দ্রীকরণ করা গেলে রাজধানীর ওপর জনসংখ্যার চাপ কমে আসবে। তবে বর্তমানে যারা ঢাকায় রয়েছে এবং প্রয়োজনের তাগিদে ভবিষ্যতে আসবে, তাদের জন্য সাধ্যের মধ্যে বাসযোগ্য আবাসনের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম: নগরবিষয়ক গবেষক ও জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী, বিআইজিডি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।