এমপিওভুক্তি করুণা নয়, অধিকার

অধিকার আদায়ে শিক্ষকদের যেন রাস্তায় নামতে না হয়
অধিকার আদায়ে শিক্ষকদের যেন রাস্তায় নামতে না হয়

আমাদের দেশের প্রায় সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একইভাবে গড়ে উঠেছে। স্থানীয় ব্যক্তিদের উদ্যোগেই তা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ২৬ হাজার প্রতিষ্ঠান যদি এমপিওভুক্ত হতে পারে, তাহলে বাকি নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হতে বাধা কোথায়? যদি এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় কোথাও কোনো ত্রুটি থাকে, তাহলে খতিয়ে দেখে সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা প্রয়োজন ছিল। আজকের দিনে যে সরকারি স্কুল-কলেজ আছে, সেগুলোও একদিন স্থানীয় ব্যক্তিদের উদ্যোগেই হয়েছিল।

নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন এ রকম অনেক শিক্ষক আমার পরিচিত। তাঁদের করুণ জীবনকাহিনি গল্প-উপন্যাস-নাটক-সিনেমার যেকোনো করুণ কাহিনিকে হার মানাবে। এ রকম অনেক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তাঁদের দোকানদার বাকি দেন না। শ্বশুরবাড়িতে অনেকেই লজ্জায় যান না, সন্তানের যেকোনো ছোট ছোট চাহিদায়ও ইতস্তত করেন। যেকোনো উৎসব আসার আগের দিনগুলো তাঁদের কাছে মনে হয়, যেন কোনো বিষাক্ত তির তাঁদের দিকে ধেয়ে আসছে। বন্ধুদের কাছে কোনো মর্যাদা পান না। বৃদ্ধ পিতামাতার ওষুধ কেনার সামর্থ্য নেই। সমাজে কোথাও তাঁদের কোনো কদর নেই। তবু ক্ষুধা আসে, সন্তানের স্কুলের ফি দিতে হয়, আত্মীয় এলে বুকের মধ্যে কষ্টের পাহাড় নিয়ে মুখে হাসির অভিনয় করতে হয়।

অনেক শিক্ষক বলেছেন, নন-এমপিও শিক্ষকেরা পারিবারিক-সামাজিক-পারিপার্শ্বিকভাবে নিগৃহীত। সমাজের মানুষ তাঁদের দিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকায়। এগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন। ধারকর্জ করে বা জমি বিক্রি করে চলছেন অনেকেই। কোনো দিন যদি এমপিওভুক্ত হয়-এই আশায় বুক বেঁধে থাকা।

সরকার শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন না দিয়ে যে শুধু তাঁদের পরিবারের ক্ষতি করছে তা নয়; বরং লাখ লাখ শিক্ষার্থী, যারা ওই সব শিক্ষকের কাছে পাঠ গ্রহণ করছে, তাদেরও ক্ষতি করছে। কারণ বিনা বেতনে মুখে হাসির অভিনয় করে ভালো পড়ানো সম্ভব নয়। এই ক্ষতিরই দায় সরকারের। শিক্ষক-কর্মচারী এবং ওই সব কলেজের শিক্ষার্থীর প্রতি সরকারের উদাসীনতা একেবারেই কাম্য নয়।

রাষ্ট্র কারও কাছ থেকে শ্রম নিয়ে যদি পারিশ্রমিক না দেয়, তাহলে দেশের সব মানুষ ওই শ্রম বিক্রি করা মানুষটির কাছে ঋণী হয়। শ্রম ক্রয়-বিক্রয় কোনো আবেগের বিষয় নয়, যুক্তির। শিক্ষকেরা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সম্মান বিক্রি করতে যাননি। গিয়েছেন শ্রম বিক্রি করতে। দেশের সব নন-এমপিও শিক্ষকের কাছে দেশের ১৬-১৭ কোটি মানুষ ঋণী। সরকারের উচিত দ্রুততম সময়ে তাঁদের বকেয়াসহ বেতন দিয়ে দেশবাসীকে ঋণমুক্ত করা। রাষ্ট্র জোরপূর্বক বিনা অর্থে শ্রম কিনলে, প্রেসক্লাবে দিনের পর দিন শিক্ষকেরা অনশন করলে দেশবাসীর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় না, তা তো নয়। রাষ্ট্রের প্রতি আনা মুদ্রায় যদি ১৬-১৭ কোটি মানুষের অধিকার থাকে, তাহলে প্রতি আনা ঋণেও ১৬-১৭ কোটি মানুষের ঋণ আছে। এই ঋণ পরিশোধে সরকারের এত কার্পণ্য কেন? সরকার যদি এই ঋণ পরিশোধ না করে, ইতিহাস লিখে রাখবে, বাংলাদেশ সরকার একদা জোরপূর্বক শিক্ষকদের কাছ থেকে বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম কিনেছে।

সরকার নন-এমপিও শিক্ষকদের বেতন না দিলেও বেসরকারি কলেজগুলোতে নিয়োগ থেমে নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেশের উপজেলা পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও স্নাতক সম্মান কোর্স চালু করছে। শিক্ষার কোনো মান বিচার নেই, শুধু সনদ বিতরণের চেষ্টা। উপজেলা পর্যায়ের কলেজগুলোতে এখনো প্রচুর শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে। তাঁদের এমপিওভুক্তিও অনিশ্চিত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা আছে, কিন্তু বেতনের ব্যবস্থা করার ক্ষমতা নেই। ফলে দিনের পর দিন বাড়ছে নন-এমপিও শিক্ষকের সংখ্যা।

নন-এমপিও শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার টাকা সরকারের নেই-এই যুক্তি মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের দেশে ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হলো। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা সরকারি হওয়ার আগেও বেতন পেতেন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের গ্রেড উন্নীত করা হয়েছে। দেশে আরও কলেজ পর্যায়ের প্রায় ১৬ হাজার বেসরকারি শিক্ষককে সরকারি করা হচ্ছে। বেসরকারি স্কুলেরও কয়েক হাজার শিক্ষককে সরকারি করা হচ্ছে। অর্থের অভাব থাকলে এসব কীভাবে সম্ভব? যাঁকে পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে, তাঁকেই আরও সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। আর যাঁকে পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে না, তাঁর জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। বিষয়টি আসলে অর্থের অভাব তা নয়, বরং নীতি আর অব্যবস্থাপনাই এর জন্য দায়ী।

বেতন না পাওয়া শিক্ষকদের কয়েকটি ধরন আছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁরা বছরের পর বছর নন-এমপিও হিসেবে আছেন। আবার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলোর একাডেমিক স্বীকৃতি আছে, কিন্তু কোনো শিক্ষকই বেতন পান না। এ ছাড়া অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলোর ভর্তির অনুমোদন আছে, কিন্তু একাডেমিক স্বীকৃতি নেই। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলো নিম্নমাধ্যমিক থেকে মাধ্যমিক হয়েছে। সেখানে মাধ্যমিকের শিক্ষকেরা বেতন পান না। এ ধরনের সব শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের পড়ানোর কাজ করে আসছেন। বৈধভাবে গড়ে না উঠলে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করতে পারত না। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা বৈধ সনদ পায়, এ রকম সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন পাওয়াটা তাঁদের অধিকার।

শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসে বিশ্বাস নেই নন-এমপিও শিক্ষকদের। এটিও অত্যন্ত দুঃখজনক। তাহলে শিক্ষকদের কাছে শিক্ষামন্ত্রী এতটা খেলো হলেন কীভাবে? আর শিক্ষামন্ত্রী যদি ইতিপূর্বে বিশ্বাস ভঙ্গ করে থাকেন, তাহলে আবার কেন আশ্বাস দিতে গেছেন? এর আগে মরিচ স্প্রে দিয়ে শিক্ষকদের আন্দোলন বন্ধ করা হয়েছে। এবার সেটি হয়নি। এবার প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে অনশনকারীরা তাঁদের অনশন কর্মসূচি তুলে নিয়েছেন। যত দ্রুত আশ্বাস বাস্তবায়িত হবে, তত দ্রুতই বন্ধ হবে হতভাগা শিক্ষকদের দীর্ঘশ্বাস।

সারা দেশের বিভিন্ন স্তরের যে লাখ লাখ শিক্ষক দাবি উত্থাপন করেছেন, তা অনেকটাই যৌক্তিক। তাঁদের এই যৌক্তিক দাবি পূরণ না হলে দেশবাসীর উচিত তাঁদের পাশে দাঁড়ানো।

তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail. com