শেখ হাসিনার একটানা ক্ষমতার নয় বছর এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের চার বছরের আগমুহূর্তে মন্ত্রিসভায় সামান্য যোগ এবং অসামান্য দপ্তর বদলের পেছনে কী গূঢ় রহস্য আছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা গুঞ্জন চলছে।
মন্ত্রিসভার সাম্প্রতিক পরিবর্তনে লক্ষণীয় বিষয় হলো, আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে আসা মন্ত্রীদের দপ্তরগুলোতেই বেশি পরিবর্তন এসেছে। কারও কারও সঙ্গে একজন করে প্রতিমন্ত্রী জুড়ে দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিসভায় যে দুজন নতুন পূর্ণ মন্ত্রী যুক্ত হয়েছেন, তার একজন টেকনোক্র্যাট কোটায়-মোস্তাফা জব্বার, আরেকজন শাহজাহান কামাল লক্ষ্মীপুর থেকে নির্বাচিত সাংসদ। তাঁর ভাই মাকসুদ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি। সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ পদোন্নতি পেয়ে পূর্ণ মন্ত্রী হয়েছেন। সম্প্রতি এই দপ্তরের পূর্ণ মন্ত্রী ছায়েদুল হক মারা যাওয়ায় পদটি খালি হয়। দীর্ঘদিন ধরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অভিযোগ ছিল, ৫৩ সদস্যের মন্ত্রিসভায় তাঁদের মধ্য থেকে একজন পূর্ণ মন্ত্রী নেওয়া হয়নি। সবাই প্রতিমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও বিবেচনায় নিয়ে থাকতে পারেন।
একদা জাসদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মোস্তাফা জব্বার সরকারের তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন তথা ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে কাজ করে আসছিলেন দীর্ঘদিন থেকে। গেল শতকের আশির দশকে তিনিই প্রথম দৈনিক কাগজে কম্পিউটার কম্পোজ চালু করেছিলেন, তা-ও সবচেয়ে প্রাচীন পত্রিকা দৈনিক আজাদ-এ। আগামী সংসদ নির্বাচনে তাঁর প্রার্থী হওয়ারও গুঞ্জন আছে। যে তিনজনকে মন্ত্রিসভায় যোগ করা হয়েছে, তার মধ্যে রাজবাড়ী ও লক্ষ্মীপুরে অনেক দিন কোনো মন্ত্রী ছিল না। মন্ত্রী করায় সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটাররা নিশ্চয়ই খুশি হবেন। তবে সব এলাকা থেকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী নিলে মন্ত্রিসভার আকার শতকের ঘর ছাড়িয়ে যাবে। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া ৬০ সদস্যের বিরাট মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। পরের নির্বাচনে দলের আসন নেমে এসেছিল ৩৩-এ। তাই মন্ত্রী হলেই নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়া যাবে, এমন নিশ্চয়তা নেই।
মন্ত্রিসভার দপ্তর অদলবদলের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগার ও আওয়ামী লীগার নন-স্পষ্ট দুটো সীমারেখা টানা হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। আওয়ামী লীগ থেকে এসেছেন এমন কোনো জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীর দপ্তর বদল হয়নি। অথচ আওয়ামী লীগের বাইরের তিন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীর দপ্তর বদল হয়েছে। রাশেদ খান মেনন ছিলেন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন দপ্তরের মন্ত্রী। তাঁকে দেওয়া হয়েছে সমাজকল্যাণে। আর বিমান ও পর্যটন চলে গেছে নবাগত শাহজাহান কামালের হাতে। মন্ত্রী হয়েই তিনি বিমানকে লাভজনক করতে জীবন ও রক্ত দিতে প্রস্তুত বলে দেশবাসীকে জানিয়েছেন। কোনো মন্ত্রণালয়কে লাভজনক করতে জীবন দিতে হয় না, চুরি-অপচয় বন্ধ করে দক্ষতার সঙ্গে মন্ত্রণালয়টি চালাতে পারলেই হয়। তবে বিমানের ক্ষেত্রে সেটি একমাত্র প্রতিষেধক না-ও হতে পারে। রাশেদ খান মেনন বিমানের ভেতরে লুকিয়ে থাকা চক্র সম্পর্কে তাঁর উত্তরসূরিকে সতর্ক করে দিয়েছেন।
দপ্তর বণ্টনে আরেকটি লক্ষণীয় পরিবর্তন হলো পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া। আর সাবেক পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেনকে আনা হয়েছে পানিসম্পদে। তাঁরা দুজনই একসময় সামরিক শাসক এরশাদের মন্ত্রী ছিলেন। আনিসুল এখনো এরশাদের সঙ্গে থাকলেও আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ভিন্ন দল করেছেন-জাতীয় পার্টি ওরফে জেপি নামে। এ ছাড়া আরেকটি পরিবর্তন হলো শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের দপ্তরে একজন প্রতিমন্ত্রী যোগ করা। তাঁকে দেওয়া হয়েছে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষার দায়িত্ব। এর পেছনে হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটির কোনো ভূমিকা আছে কি না, আমাদের জানা নেই। তবে গত বছর তাদের সুপারিশক্রমেই পাঠ্যবই থেকে ১৩টি নিবন্ধ-গল্প-কবিতা বাদ দেওয়া হয়েছিল। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রতিবাদ-সমালোচনাকেও সরকার আমলে নেয়নি। নাহিদ নয় বছর একাই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) প্রধান হাসানুল হক ইনুর দপ্তর অটুট থাকলেও সেখানে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে এসেছেন তারানা হালিম, যিনি গত চার বছর তাঁর মন্ত্রণালয় ভালোভাবেই চালিয়ে আসছিলেন। দপ্তর পরিবর্তনের পর তিনি প্রকাশ্যে মনোবেদনার কথা জানিয়ে বলেছেন, তিনি বঙ্গবন্ধু-১ উপগ্রহ করার বিষয়ে অনেক পরিশ্রম করেছিলেন। কিন্তু এ বছর প্রধানমন্ত্রী যখন এটি উদ্বোধন করবেন, তখন তিনি উপস্থিত থাকবেন না, এটাই তাঁর আক্ষেপ।
অদলবদলে কে কোন মন্ত্রণালয় পেলেন বা হারালেন, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো কিসের ভিত্তিতে এই পরিবর্তন আনা হলো? এ ক্ষেত্রে দক্ষতা, অভিজ্ঞতা অগ্রাধিকার পেয়েছে নাকি অন্য কিছু? যাঁরা একাধারে চার বছর একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, আগামী এক বছর ভিন্ন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে সুবিধা করতে পারবেন কি না, সেই প্রশ্নও আছে। আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে জোটের শরিক মন্ত্রীদের ব্যাপারে নানা রকম আপত্তি ও সমালোচনা আছে। দলের যেসব কেন্দ্রীয় নেতার কপালে মন্ত্রিত্ব জোটেনি, তাঁরাই এ ব্যাপারে বেশি সরব। কোনো বিষয়ে মতান্তর দেখা দিলেই অতীত নিয়ে তাঁরা টানাটানি করেন এবং তা কখনো কখনো শালীনতা ও ভদ্রতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা মনে করেন, জোটের শরিকেরা তাঁদের হক কেড়ে নিচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা ভেবে দেখেন না যে শরিকেরা যতই দুর্বল হোক, প্রতিপক্ষের সঙ্গে হাত মেলালে আম-ছালা দুটোই যাওয়ার আশঙ্কা আছে। প্রধানমন্ত্রী দলের এই অতি উৎসাহীদের প্ররোচনা আমলে নেননি। গবেষক-লেখক মহিউদ্দিন আহমদ ঠিকই বলেছেন, শেখ হাসিনা পুরোনো শত্রুকে রাজনৈতিক মিত্রে রূপান্তরিত করেছেন। ১৪ দল পর্যন্ত সেটি ঠিকই আছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী দলটি যখন ক্ষমতায় থাকার জন্য পতিত স্বৈরাচারীর সঙ্গে হাত মেলায়, তখনই খটকা লাগে। তাহলে রাজনীতিতে নীতি ও আদর্শ বলে কিছু থাকবে না?
দপ্তর অদলবদলের আরেকটি কারণ হতে পারে বাম ঘরানার কোনো কোনো নেতা সরকারে থেকেও সরকারের অতি ডানপন্থী নীতির ‘মৃদু’ সমালোচনা করেছেন। উদাহরণ হিসেবে হেফাজতের সঙ্গে সরকারের আপসরফা, সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা, হেফাজতের পরামর্শে পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা ইত্যাদি। তাঁদের বক্তব্য হলো মৌলবাদীদের সঙ্গে পদে পদে আপস করলে তো বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো ফারাক থাকে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলাও অর্থহীন হয়ে পড়ে।
মন্ত্রীদের কাজকর্ম মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রথমেই দেখতে হয় তাঁরা স্বাধীনভাবে কাজকর্ম করতে পারেন কি না? দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ফিরে গেলেও রাষ্ট্রপতি শাসনের কেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। রাষ্ট্রপতি-শাসিত পদ্ধতি হলো তিনিই (রাষ্ট্রপতি) সরকার চালান এবং তাঁর কাজের সহায়তার জন্য মন্ত্রীরা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। অন্তত এটাই আমাদের দেশে চলে আসছিল। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ-শাসিতব্যবস্থায় সরকার পরিচালিত হয় যৌথভাবে। প্রধানমন্ত্রী অন্যদের থেকে আলাদা নন, তিনি শুধুই ‘ফার্স্ট অ্যামোং দ্য ইকুয়ালস’। মন্ত্রিসভায় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সহকর্মীদের মতো তিনিও একটি ভোটের মালিক। কিন্তু আমাদের ‘সংসদীয় ব্যবস্থায়’ প্রধানমন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা থেকে আলাদা করা হয়েছে। শুধু প্রধানমন্ত্রীর হাতে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত করা হলেও সংসদের কাছে যৌথ জবাবদিহি মন্ত্রিসভাকেই করতে বলা হয়েছে। বাহাত্তর থেকেই এই বিধান ছিল, দ্বাদশ সংশোধনীতে সমঝোতা করে বিএনপি পুনরায় তা পুনরুজ্জীবিত করে, যা এখনো টিকে আছে। ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনী বিলের ওপর আলোচনায় আওয়ামী লীগ এর কঠোর সমালোচনা করেছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত বিলটি সর্বসম্মতিক্রমেই পাস হয়। দ্বাদশ সংশোধনী নব্বই-পরবর্তী রাজনৈতিক সমঝোতার একমাত্র উদাহরণ। তবে খালেদা জিয়া তাঁর ভিশন ২০৩০-এ প্রধানমন্ত্রীর হাতে সর্বময় নির্বাহী ক্ষমতা থাকাটা ভারসাম্যহীন আখ্যা দিয়ে তাতে পরিবর্তন আনার অঙ্গীকার করেছেন। তাই মন্ত্রীদের সাফল্য-ব্যর্থতা মূল্যায়ন করতে হলে তাঁদের ক্ষমতার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। প্রথম কথা হলো, মন্ত্রণালয়ের সব বিষয়ে মন্ত্রী হিসেবে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কি না? যদি না পারেন, তাহলে ব্যর্থতার দায়ভার কেন তিনি নেবেন?
রাশেদ খান মেনন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু কিংবা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ দীর্ঘদিন নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন। মেনন তাঁর মন্ত্রণালয়ে একটি পরিবর্তন আনার চেষ্টাও করেছিলেন। তবে তিনি পর্যটনে সফল হলেও বিমানের ক্ষেত্রে হতাশ ছিলেন। বিমান যে চক্রের হাতে জিম্মি, সেই চক্র বহাল রেখে বিমানকে রক্ষা করা কঠিন। অন্যদিকে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জু যে মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, সেই মন্ত্রণালয় থেকে নতুন অভিজ্ঞতা লাভের জন্য অদলবদল কতটা মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়ের জন্য সুবিধাজনক হবে, বলা কঠিন। মেননের দপ্তর বদলে ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে ‘আপত্তি’ও উঠেছে। যদিও মন্ত্রী বিষয়টি হালকা করার জন্য বলেছেন, এত দিন আকাশে ছিলেন, এখন মাটিতে নেমে এসেছেন। তৃণমূলের মানুষকে নিয়ে কাজ করতে পারবেন।
এর আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও ব্যাংকিং খাত সম্পর্কে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন। ব্যাংকিং খাতের নানা কেলেঙ্কারি বছরের পর বছর আলোচনায় এলেও সমাধান মিলছে না। অথচ অর্থ মন্ত্রণালয় পরিচালনায় ঝানু অর্থমন্ত্রী ছাড়াও প্রতিমন্ত্রী আছেন, উপদেষ্টা আছেন। তাঁদের মধ্যে কাজের সমন্বয় কতটা, সেই প্রশ্ন না উঠে পারে না। আর যেসব মন্ত্রী সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করেন, উচ্চবাচ্য করেন না, হয় তাঁদের খুঁটি খুব শক্ত, না হয় মন্ত্রণালয় নিয়ে খুব ভাবিত নন। তাঁদের ভাবনা মন্ত্রিত্ব নিয়ে।
মন্ত্রিসভায় দপ্তর অদলবদলের সঙ্গে আগামী নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়। কে কোন আসন থেকে নির্বাচন করবেন, সেটিও বিচার্য বিষয় হতে পারে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan 55 @gmail. com