মমতা, সুষমা এবং সালমা-শেফালির কথা

বাঙালি বিতাড়নের বিপক্ষে বলায় মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে মামলা করেছে আসামের পুলিশ।
বাঙালি বিতাড়নের বিপক্ষে বলায় মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে মামলা করেছে আসামের পুলিশ।

মমতা ব্যানার্জির হঠকারিতার কথা তাঁর চাটুকারেরাও গোপন করেন না। তাঁরা সেটাকে তাঁর বুদ্ধির ধার বলে প্রোমোট করেন, তালি বাজান। পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী আসামে বাঙালি তাস খেলতে গিয়ে আবার সবার নজরে এসেছেন। তিনি ভেবেছিলেন, আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) প্যাঁচে বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গে নাকানিচুবানি খাওয়াবেন। হুকুম দিয়েছিলেন দিল্লির লোকসভায় শোরগোল করে মাতিয়ে রাখতে। তাঁর দলের সাংসদেরা মুরদে যতটা কুলিয়েছে করেছেন। জবাবে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাঙালিদের (হিন্দু বাঙালি বুঝিয়েছেন কি?) ভয় নেই বলে বিবৃতি দিয়েছেন।

ভুল কার?
মমতা তো বলতে পারবেন না মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের খেদানো চলবে না। বিজেপি বলছে, আসামে তথা ভারতের সর্বত্র বাংলাদেশের হিন্দু ‘শরণার্থী’ আর বাংলাদেশের মুসলিম ‘অনুপ্রবেশকারী’ আছে। তারা অনুপ্রবেশকারীদের খেদাবে, শরণার্থীদের নয়। বিজেপির ভোট কেনার ম্যাজিক এখানেই; লোকসভায় তৃণমূলের সাংসদদের চিল্লাবিল্লি করার আগে আসামের বাঙালিপ্রধান এলাকা শিলচর থেকে নির্বাচিত লোকসভার সদস্য এবং সর্বভারতীয় মহিলা কংগ্রেসের প্রধান সুস্মিতা দেব বর্তমান পদক্ষেপের সমালোচনা করে লোকসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে উত্তরণের একটা সূত্র দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর মতে, গত লোকসভার ভোটার তালিকার ভিত্তিতেই আসামের এনআরসি তৈরি করা উচিত। যেভাবেই হোক সমাধানের একটা সূত্র খুঁজে বের করা এখন জরুরি।

বলা বাহুল্য, মমতা সে পথে হাঁটছেন না। তাঁর গরম-গরম কথায় খেপে গিয়ে আসাম সরকারের পুলিশ ইতিমধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর রুজু করেছে। আসামের এনআরসি কর্তৃপক্ষ পাল্টা ঢিল ছুড়েছে মমতার দিকে। তাদের অভিযোগ, মমতার গাফিলতির জন্যই এনআরসি হালনাগাদের কাজে এত তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

এনআরসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে যাদের শিকড় ছিল, এমন লাখ লাখ বাঙালির নাম পঞ্জিতে ওঠেনি স্রেফ মমতা সরকারের গাফিলতিতেই।

পরিবারের যাঁর নাম প্রথম আসামের কোনো সরকারি নথিতে নথিভুক্ত হয়েছে, তা উল্লেখ করার পাশাপাশি গোটা পরিবারের বংশতালিকা আবেদনপত্রে উল্লেখ করতে হয়। যাঁরা বাইরের রাজ্য থেকে এসেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে ভারতীয় হওয়ার বিভিন্ন প্রমাণের পাশাপাশি সাবেক রাজ্যে থাকা জমির দলিল, ভোটার তালিকা বা সরকারি নথির প্রমাণ দিতে হয়।

এনআরসি-সংক্রান্ত বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট, রাজ্য ও কেন্দ্রের মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করেন প্রতীক হাজেলা। এই আইএএস কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে দিয়েছেন, এ রকমের ২ লাখ ৬৮ হাজার নথি যাচাই করার জন্য পশ্চিমবঙ্গসহ ২৮টি রাজ্যে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দিক থেকে বিশেষ সহযোগিতা মেলেনি। গত দুই বছরে ১ লাখ ১১ হাজারের মধ্যে মাত্র মাত্র পাঁচ হাজার নথি যাচাই করে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের পরেই রয়েছে বিহার। সেখানে পাঠানো ৬৬ হাজার নথির মধ্যে যাচাই হয়েছে মাত্র তিন হাজার। অথচ ত্রিপুরায় পাঠানো ৫১ হাজারের মধ্যে ৩৩ হাজার নথি ইতিমধ্যেই যাচাই হয়ে ফেরত এসেছে। রাজস্থানে পাঠানো ১৫ হাজারের মধ্যে ৮ হাজার নথি যাচাই হয়েছে। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ থেকে সরকারি উদাসীনতা ও অনাগ্রহের ফলেই অনেক বাঙালি পরিবার বিপাকে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব অত্রি ভট্টাচার্যের মতামত জানতে চাইলে তিনি নথি না দেখে কিছু বলতে রাজি হননি।

দুই মায়ের পথ
দল, রাজনীতি, নির্বাচন, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, অনুপ্রবেশ, শরণার্থী, হিন্দু, মুসলিম—এসব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে উঠে আসামের দুই মা যেন জগজ্জননী হয়ে উঠেছেন। এক বোরো মায়ের কলে বড় হচ্ছে মুসলিম মা-বাবার ঔরসজাত শিশু, আর বোরো মা-বাবার ঔরসজাত শিশু মুসলিম মায়ের যত্নে বেড়ে উঠছে। সাহাবুদ্দিন-সালমা আর অনিল-শেফালি হয়ে উঠেছেন মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা আর মমত্বের প্রতীক। ২০১৫ সালে একই হাসপাতালে প্রায় একই সময় সালমা আর শেফালি সন্তান প্রসব করেন। নার্সদের ভুলে বদল হয়ে যায় নবজাতক। সালমার মন শুরু থেকেই খচ খচ করত। সাহাবুদ্দিনকে বলেছিলেন সে কথা। কেউ বিশ্বাস করেনি। দুই বছর বয়স হতেই সালমার কোলের শিশুর চেহারায় বোরো শিশুদের আদল ফুটে উঠতে থাকে। সালমাকে আর কেউ প্রবোধ দিতে পারে না। তাঁরা পুলিশের কাছে যান। পুলিশ খুঁজে বের করে অনিল-শেফালির ঠিকানা। দুই পরিবার মেনে নেয় ডিএনএ পরীক্ষার পথ। বলে, আদালত যা বলবেন, তা-ই হবে। হায়দরাবাদের ডিএনএ পরীক্ষা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে, শেফালির কাছে যে আছে, সে সালমার সন্তান আর সালমার কাছে থাকা শিশুটির জন্মদাত্রী মা হলেন শেফালি!

পরে কী ঘটল? তাঁরা সন্তান বদলাবদলি করে রক্তের–ঔরসের–জাতির শিশুকে ফিরে নিলেন? যা ঘটলো তা বিষ্ময়কর এবং বিষ্ময়করভাবেই মানবিক।

দুই মা ঠিক করেছেন, তাঁরা সন্তান বদল করবেন না, ছাড়বেন না বুকের দুধ খাইয়ে তিলে তিলে বড় করা উঠান দাপিয়ে বেড়ানো কচি শিশু দুটিকে। যেমন আছে তেমন থাকুক তারা। সালমা-শেফালির কাছে রক্ত নয়, মনের টানই প্রধান হয়ে উঠেছে। প্রাধান্য পেয়েছে শিকড় না–ছেঁড়ার যুক্তি। শিশুকে উদ্বাস্তু না করার যুক্তি। আহা, আমরা যদি শেফালি-সালমাকে বুঝতে পারতাম! বুঝতে পারতাম শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ কাকে বলে?

গওহর নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণকর্মী এবং শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।