অদক্ষ সরকারের কবলে যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে রাষ্ট্রটির প্রধান নির্বাহী পদে এর আগে অক্ষম মানুষ বসেননি, তা নয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট জেমস গারফিল্ড যে অল্প সময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তার অর্ধেক সময় তাঁকে গুলির আঘাত ধুঁকে ধুঁকে সয়ে মৃত্যুবরণ করতে হেয়েছিল। রিচার্ড নিক্সনের শেষের দিনগুলোতে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী কার্যত তাঁর হাত থেকে পরমাণু অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন। উড্রো উইলসনের স্ট্রোক হওয়ার পর সরকার চালাতেন তাঁর স্ত্রী। পরিস্থিতি এত সমস্যাজনক হয়ে উঠেছিল যে উইলসনের এক সমালোচক বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে পেটিকোট সরকার চলছে...মিসেস উইলসনই দেশের প্রেসিডেন্ট’।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রে ভিন্নতা হলো সরকারের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে তাঁর যে অদক্ষতা, সেটা কিন্তু ধীরে ধীরে তৈরি হয়নি। আবার ঘাতকের বুলেট, স্ট্রোক ও প্রেসিডেন্সির শেষ মুহূর্তের সংকটের কারণে এটা ঘটেনি। বস্তুত, সরকারের প্রথম দিন থেকে এই অদক্ষতাই তাঁর প্রশাসনের মূল বৈশিষ্ট্য। আর নির্বাচনী প্রচারণার সময়ও তা দৃশ্যমান ছিল।

এর অর্থ হলো প্রেসিডেন্টের অযোগ্যতা প্রকৃত অর্থে হারভে ওয়েনস্টেইনের যৌন কেলেঙ্কারির মতো উন্মুক্ত রহস্য নয়। অর্থাৎ, যে জঘন্য পরিস্থিতি সম্পর্কে ভেতরের মানুষ অবগত হলেও সাধারণ মানুষ তা জানত না। নতুন বছরের শুরুতে মাইকেল উলফের ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি বইটি উন্মাদনা তৈরি করা সত্ত্বেও ট্রাম্পের এই বৈশিষ্ট্যগুলো অজানা ছিল না। বিশিষ্ট রিপাবলিকান নেতারা রাজনৈতিক কারণে উক্ত বইটিসহ এই লেখা পাঠ অবিবেচকের কাজ মনে করতে পারেন। কিন্তু যাঁরা এই লেখা পাঠ করবেন তাঁরা জানেন, ট্রাম্পের ব্যক্তিত্ব, মানসিক ধাত ও বয়সের কারণে তিনি প্রতিনিয়তই প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

তাঁর প্রেসিডেন্সির ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ প্রথম বছরে আমি আরেকটি কলামে বলেছিলাম, এসব কারণে ২৫ তম সংশোধনী কাজে লাগানো যৌক্তিক। এই সংশোধনীর বলে প্রেসিডেন্টের মন্ত্রিসভা আইন বিভাগের সঙ্গে পরামর্শক্রমে প্রেসিডেন্টকে হোয়াইট হাউস থেকে সরিয়ে দিতে পারে।

আর উলফের বইয়ে যেসব তথ্য-উপাত্ত দেওয়া হয়েছে, তাতে এই যুক্তির সপক্ষে আরও অনেক কিছু পাওয়া গেছে। বইটির কিছু অংশ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। কিন্তু জিম ভ্যানডেহেই ও মাইক অ্যালেনের মতো হোয়াইট হাউসের ভেতরের মানুষেরা বলেছেন, বইটিতে ট্রাম্পের সক্ষমতা ও মানসিক অবস্থা নিয়ে যা বলা হয়েছে তা ‘সন্দেহাতীতভাবে সত্য’। আবার এ কথাও বলা দরকার, এটা বুঝতে হোয়াইট হাউসের একদম ভেতরের মানুষ হওয়ার দরকার নেই, তাঁর টুইটার ফিডগুলো দেখলেই চলবে।

কিন্তু এই উপসম্পাদকীয়তে যা-ই প্ররোচনা থাকুক না কেন, ২৫ তম সংশোধনী কাজে লাগবে না। আজকের এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য রিপাবলিকানদের হাজারটা দোষ দেব, কিন্তু যে সুযোগটি কখনো কাজে লাগানো হয়নি, সেটা ব্যবহার না করার জন্য তাঁদের দোষারোপ করাটা বেশি হয়ে যায়। হাজার হোক, ট্রাম্প তো কেবল এক বছর আগে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। আবার এই সংশোধনী কাজে লাগাতে গেলে আইন ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে দুর্দান্ত সমন্বয় থাকতে হবে। আবার সেই সমন্বয় হলেও তা ভেঙে যেতে পারে। শুধু ঈশ্বরই জানেন, তাঁর পরিণতি কী হবে।

নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্পের সঙ্গে রাশিয়ার যোগসাজশের তদন্ত হচ্ছে। ওই তদন্ত থেকে যদি আরও তথ্য বেরিয়ে না আসে, তাহলে আগামী পাঁচ বছর আমাদের নিক্সন ও উইলসনের শেষ দিনগুলোর মতো কাটবে। তবে হোয়াইট হাউসের অন্দরমহলের মানুষ এ ব্যাপারে আমাদের চেয়ে ভালো বোঝেন। ট্রাম্প সরকার তো সেই পেটিকোট সরকারের মতোই। যদিও পোশাক এখন অনেক বেশি আছে, যেমন সামরিক পোশাক, ড্রেস স্যুটসহ ইভাঙ্কা আর যা যা পরে থাকেন।

এর অর্থ দাঁড়ায় এ রকম-এই সময়ের মূল প্রশ্ন কিন্তু সাধারণ নীতিগত প্রশ্ন নয়। প্রশ্নটা আবার অস্বাভাবিক কিছুও নয়, প্রতিরোধ বা ফ্যাসিজমের ব্যাপারে ভীত মানুষেরা যেমনটা মুখোমুখি হওয়ার কথা ভাবেন। ব্রেইবার্ট নিউজের নির্বাহী চেয়ারম্যান ও হোয়াইট হাউসের সাবেক প্রধান কৌশলবিদ স্টিভ ব্যাননের হোয়াইট হাউস থেকে প্রস্থানের মধ্য দিয়ে ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদী অ্যাজেন্ডার মৃত্যু হয়েছে এমনটি ভাবার অবকাশ নেই। ট্রাম্প প্রকৃতপক্ষেই কর্তৃত্ববাদী, কিন্তু নিক্সন ও ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের মতো প্রেসিডেন্টরা যা করেছেন, সেই মাপের ক্ষতি করার মতো সামর্থ্য তাঁর নেই।

বরং বড় প্রশ্নটি হচ্ছে সাংগঠনিক, ব্যবস্থাপনাগত ও মনস্তাত্ত্বিক; সেটা হলো ট্রাম্পের আশপাশে যেসব মানুষ আছেন, তাঁরা কি ট্রাম্পের অযোগ্যতা কাজে লাগিয়ে ঐতিহাসিক দুর্যোগ রোধ করতে পারবেন?

গত এক বছর তাঁরা সেই কাজ করেছেন, কিছু ব্যর্থতা (পুয়ের্তে রিকো) থাকলেও তাঁদের কিছু প্রকৃত সফলতা (ইসলামিক স্টেটের পরাজয়) আছে। মানুষ হয়তো উইলসনের কথায় হাসবেন। তিনি বলেছিলেন, ‘পশ্চিমের নর-নারীদের গণমাধ্যম যতই উপহাস করুক না কেন, তারা প্রকৃত অর্থেই অনুভব করে, দেশের প্রতি তাদের দায়িত্ব আছে।’ কিন্তু অন্যদের জন্য কাজটি জরুরি বা গুরুত্বপূর্ণ। আপেক্ষিকভাবে যে স্থিতিশীলতা অর্জিত হয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃত অর্থেই সেবাপ্রাপ্ত হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে ট্রাম্প এখনো যে সংকটের সম্মুখীন হননি, সে রকম সংকট হলে কি টিকবে? ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতার অংশীদার হলে বা প্রেসিডেন্টের পরিবার আইনি ঝামেলায় পড়লে কি এটা টিকে থাকবে? নাকি ব্যাপারটা এ রকম হবে যে আমরা যতটা ভেবেছি মার্কিন ব্যবস্থা প্রেসিডেন্টের অক্ষমতা কাটিয়ে উঠতে তার চেয়ে বেশি কার্যকর?

গত বছর আমরা দেখেছি, তাতে এই প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ-বোধক হতে পারে এমনটা ভাবার অনেক অবকাশ আমরা পেয়েছি। নতুন বছর আমাদের সে রকম আরও অনেক উপলক্ষের জোগান দিক। কারণ, মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশৃঙ্খল মন কোথাও ঘুরে বেড়াতে যাচ্ছে না।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া।

রস ডৌথাট: মার্কিন সাংবাদিক।