তারা পারলে আমরা পারব না কেন?

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে আমি এ কারণে যে সারা দেশে এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা হয় একই সিলেবাসে। সেই সিলেবাস থেকে সমন্বিতভাবে প্রশ্ন করা যেতে পারে। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা। মেডিকেলের বেলায়ও তাই। সিলেবাস যেহেতু একই, আমরা বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের একই দিনে পরীক্ষা নিতে পারি। একইভাবে বাণিজ্য বিভাগের ও মানবিক বিভাগের ছাত্রছাত্রীরাও ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারেন একসঙ্গে।

সমন্বিত বা গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে ভর্তি কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রতাও দূর করা যাবে। একটি মাত্র রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকায় এবং দূরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের প্রয়োজন না থাকায় ছাত্রছাত্রী ও তঁাদের অভিভাবকদের ভোগান্তি ও খরচ দুটোই অনেকাংশে কমবে। শুধু ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবক নয়, ঝক্কিঝামেলা কমবে বিশ্ববিদ্যালয়েরও। ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করতে হয়। সমন্বিত পদ্ধতি চালু হলে মহাযজ্ঞ রূপ নিতে পারে সহজ একটি পরীক্ষায়। কোচিং-বাণিজ্য দূর করতেও সহায়ক হবে এটি।

গুচ্ছ পদ্ধতির রূপরেখা হতে পারে এ রকম—মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার আদলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মাধ্যমে একটি ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বুয়েটসহ চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (এমআইএসটিসহ) ভর্তি কার্যক্রম করা যেতে পারে। সব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ও ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারে একসঙ্গে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একই দিনে হতে পারে সব সরকারি ও বেসরকারি টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ-টেকনোলজির ভর্তি পরীক্ষা।

দেশের সব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে একত্রে। একসঙ্গে অনুষদভিত্তিক পরীক্ষা নিতে পারে সাধারণ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। যেমন দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ভর্তি পরীক্ষা এক দিনে হতে পারে, একই প্রশ্নপত্রে। তেমনিভাবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানবিক অনুষদের ভর্তি পরীক্ষা এক দিনে, বাণিজ্য অনুষদের পরীক্ষা এক দিনে, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে এক দিনে। বিভাগ পরিবর্তনকারী বা ‘ঘ’ ইউনিটে আলাদা পরীক্ষা না নিয়েও বিভাগ পরিবর্তনের সুযোগ রাখা যায়। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সেটাই করেছি। এতে ছাত্রছাত্রীরা যেমন একটি অতিরিক্ত পরীক্ষার চাপ থেকে রেহাই পেয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়কেও একটি বাড়তি ইউনিটের পরীক্ষা নিতে হচ্ছে না। আমরা যেটা করেছি, ভর্তির আবেদনের সময় অপশন রেখেছি। যঁারা বিভাগ পরিবর্তনেরও সুযোগ চান, তঁারা আবেদনপত্রে তা উল্লেখ করেন। যেমন বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হলে ‘ক’ ইউনিটে আবেদনের সময়ই উল্লেখ করে দেন, আমি ইউনিট পরিবর্তনেও আগ্রহী। ‘ক’ ইউনিটে সুযোগ না হলে মেধার ভিত্তিতে মানবিক বা বাণিজ্য বিভাগের কোনো বিষয়েও তাঁর ভর্তির সুযোগ থাকে।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা সব বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। এতে ভর্তি-ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীরা কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিতে পারবেন বাড়ির কাছের বিশ্ববিদ্যালয়টিকে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু হলে একটি ফরম পূরণ করেই একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া যাবে। শিক্ষার্থী যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চান, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হবে না। ধরা যাক, কোনো শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা তিনটির দুটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে চান। নিবন্ধনের পর শিক্ষার্থী পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে ঢাকা, রাজশাহী কিংবা বরিশালের যেকোনো একটি কেন্দ্র বেছে নিতে পারবেন। বরিশাল অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা বরিশালে বসেই পরীক্ষা দিতে পারবেন। আবেদনের সময়ই ছাত্রছাত্রীরা পছন্দক্রম উল্লেখ করে দেবেন।  ফল প্রকাশের পর যখন দেখা গেল কোনো ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাচ্ছেন না, খুলনা কিংবা রাজশাহী পাচ্ছেন; তঁাকে সেখানে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হবে। পরবর্তী সময়ে আসন খালি হওয়া সাপেক্ষে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় মাইগ্রেশন সিস্টেমও চালু করা যেতে পারে।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত হয় কাছাকাছি সময়ে। এ কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পারেন না অনেকে। ভর্তি পরীক্ষার আগের দিন শহরগুলোতে অসংখ্য পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকের সমাগম ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর আত্মীয়স্বজন না থাকায় আবাসিক হোটেলই আশ্রয়। অনেকের সেখানেও জায়গা হয় না। ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে অনেকের পরীক্ষার আগের রাত যাপন করতে হয় রেলস্টেশনে, মসজিদের বারান্দায়।

মেয়েদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরও প্রকট। ছাত্ররা ইচ্ছা করলে হয়তো যেখানে-সেখানে রাত কাটিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু একজন ছাত্রীর পক্ষে তা সম্ভব নয়। নিকটস্থ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয় অনেক ছাত্রীকে।

একটি ভর্তি পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে দেশের সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কেও। এসব বিশ্ববিদ্যালয় বছরে তিন-চারবার ভর্তি করে। ভর্তি পরীক্ষারও বালাই নেই অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আওতায় আনা গেলে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একটি নিয়মের মধ্যেও চলে আসবে। এতে ভোগান্তি অনেক কমবে। সময়ের সাশ্রয় হবে। 

মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত আছে। অনেক আগে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধীনে কুয়েট, চুয়েট ও রুয়েটে একযোগে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হতো। ২০১৩ সালে সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অভিন্ন প্রশ্নপত্রে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। তখন বলা হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা তাঁদের সুবিধামতো যেকোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিতে পারবেন। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছিল। শেষ অবধি তা হয়নি। কিছু সংগঠন, বিশেষ করে সিলেটে স্থানীয় ব্যক্তিদের বিরোধিতার কারণে ভেস্তে যায় এই শুভ উদ্যোগ।

সমন্বিত বা গুচ্ছ পরীক্ষা পদ্ধতির বাস্তবায়ন যে খুব সম্ভব, তার প্রমাণ মেডিকেল ও ডেন্টালে ভর্তি পরীক্ষা। তারা পারলে আমরা কেন পারব না? পিইসি, জেএসসি, এসএসসিসহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষাও হয় সারা দেশে একই সঙ্গে, একই দিনে। যদি লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা একই দিনে নিতে পারে শিক্ষা বোর্ড, আমরাও নিশ্চয়ই পারব। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিধা-অসুবিধা আমলে নিয়ে কীভাবে গ্রহণযোগ্য একটি সমন্বিত পরীক্ষা পদ্ধতি বাতলে দেওয়া যায়, এটি নিয়ে ভাবতে হবে আমাদেরই।

এস এম ইমামুল হক: উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।