অবসরসীমা বৃদ্ধির প্রস্তাব সময়োচিত নয়

একটি বাংলা দৈনিক থেকে জানা যায়, সরকারি কর্মচারীদের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার বয়স তিন বছর বাড়িয়ে দিতে অর্থমন্ত্রী একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। প্রস্তাবটি দিয়েছেন গত বছরের ৬ ডিসেম্বর। এর একটি অনুলিপি পাঠানো হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। আলোচ্য প্রস্তাবটি কার্যকর করতে ১৯৭৪ সালের গণকর্মচারী (অবসর) আইনে সংশোধন আনতে হবে। এর জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার পর সংসদে বিল পেশ করতে হবে। সংসদ বিলটি পাস করলে সংশোধিত হবে মূল আইন। তবে এ ধরনের একটি প্রস্তাব প্রক্রিয়া করার আগে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিগত সম্মতি নেওয়ার একটি প্রথা প্রচলিত আছে। বিষয়টি নিয়ে এখনো কোনো অগ্রগতি লক্ষণীয় হচ্ছে না। ধারণা করা হয়, নির্বাচনের বছরে সরকার কর্মচারীদের খুশি রাখতে এ রকম একটি পদক্ষেপ নিতে পারে। তবে এমনটা করলে সবাই লাভবান হবেন তা কিন্তু নয়। অবসরজনিত শূন্যতার জন্য এর নিচের স্তরে থাকা কর্মকর্তাদের পদোন্নতি হয়। সেখানে অবসরসীমা বাড়িয়ে দিলে একটি স্থবিরতাও দেখা দিতে পারে। কমে যাবে নতুন নিয়োগ। এতে শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্বের মেয়াদ আরও বাড়তে পারে। তাই ধরে নেওয়া যায়, সব দিক বিবেচনা করেই সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।

তবে দেখা যাক অর্থমন্ত্রী কী যুক্তিতে চাকরির অবসরসীমা বাড়াতে এই প্রস্তাব করেছেন। তিনি এককালে ছিলেন পদস্থ কর্মকর্তা। মন্ত্রিত্বও করছেন দীর্ঘকাল। তাঁর মতে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৮ বছর। আর এখন তা ৭২। সেই ১৯৭২ সালের বিবেচনা থেকেই ১৯৭৪ সালের আইনে অবসরের বয়স ৫৭ বছর নির্ধারণ করা হয়। ২০১২ সালের নভেম্বরে অবশ্য তা করা হয় ৫৯ বছর। আর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৬০ বছর। বর্তমান গড় আয়ুর বিবেচনায় অবসরসীমা ৬২ বছর যৌক্তিক বলে অর্থমন্ত্রী বিবেচনা করেন। জনপ্রশাসনের ওপরের স্তরে যাঁরা থাকেন, তাঁরা স্বভাবগতভাবে তাঁদের চাকরিসীমা প্রসারিত করতে চান। এই প্রবণতা দীর্ঘদিনের। তাঁদের যুক্তি, দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের ধরে রাখার জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রথা চালু আছে। বয়সসীমা বাড়িয়ে দিলে এর প্রয়োজন হবে না। যুক্তিটি বর্তমান অভিজ্ঞতার আলোকে যথার্থ মনে হয় না। পাঁচ বছর আগেই তো চাকরির বয়স দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। এরপরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ যাঁদের হওয়ার তাঁদের হচ্ছে। বয়স ৬২ করা হলেও অবসরের পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বন্ধ হবে, এমন দাবি করা যাবে না।

কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে একই দেশে ভিন্ন ভিন্ন পেশার ক্ষেত্রে পৃথক অবসরসীমা থাকা সংগত নয়। কিন্তু ধরনভেদে প্রায় সব দেশেই বিভিন্ন পেশার জন্য ভিন্ন ভিন্ন অবসরসীমা রয়েছে। আমাদের দেশের সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারকদের অবসরের বয়স ৬৭ বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে সেটা ৬৫। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে উচ্চ পদাধিকারীদের অবসরের বয়স গণকর্মচারীদের চেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে তাঁদের একটি বঞ্চনাবোধে ভোগা অস্বাভাবিক নয়। আর গণকর্মচারীদের অবসরসীমা স্তর বা চাকরিভেদে ভিন্ন ভিন্ন করার সুযোগ তেমন একটি নেই। ভারত ও পাকিস্তানে গণকর্মচারীরা অবসর নেন যথাক্রমে ৬০ ও ৬২ বছর বয়সের পর। ভারতে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারকদের অবসরসীমা যথাক্রমে ৬৫ ও ৬২। সে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কিছু কিছু বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক ৬৫ বছর পর্যন্ত চাকরি করতে পারেন। মালয়েশিয়ায় গণকর্মচারীদের অবসরসীমা ৬০ বছর। এটাকে ৬২তে উন্নীত করার একটি প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা আমৃত্যু পদে বহাল থাকতে পারেন। অবশ্য তাঁদের সুপ্রিম কোর্ট প্রধান বিচারপতিসহ নয়জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত। সুতরাং দেখা যায়, বিভিন্ন পেশার চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখেই এ ধরনের অবসরসীমা নির্ধারণ করা হয়। আমাদের এবং সম্ভবত অন্য দেশেও সামরিক বাহিনীর চাকরির অবসরসীমা সব স্তরে অভিন্ন নয়। বরং বড় রকমের পার্থক্যই রয়েছে। আর এটাই সংগত।

প্রশ্ন থাকবে, এ দেশে গণকর্মচারীদের অবসরসীমা ৬২ বছরে উন্নীত করলে এর ফল কী দাঁড়াবে? মনে হচ্ছে সরকার আরও বেশি দিন অভিজ্ঞ কর্মচারীদের সেবা নিতে পারবে। পরবর্তী তিন বছরে কেউ অবসরে যাবেন না বিধায় তাঁদের পেনশনের বর্ধিত চাপ থেকেও তিনটি বছর সরকার পাবে। তবে এই সময়ে একটি স্থবিরতাও চলে আসবে নিয়োগ আর পদোন্নতিতে। এ পৃথিবীতে কোনো পদের জন্য কেউ অপরিহার্য নয়। প্রকৃতির নিয়মে যেমন হচ্ছে জন্ম-মৃত্যু, তেমনি আছে চাকরির ক্ষেত্রেও নিয়োগ ও অবসর। তরুণেরা নতুন চাকরি পাবেন। অধিকতর অভিজ্ঞরা যাবেন উচ্চ থেকে উচ্চতর দায়িত্বে। সমৃদ্ধ হবে অভিজ্ঞতার ঝুলি। আর একটি সময়ে তাঁদের স্থান ছেড়ে দিতে হবে সিঁড়ির পরবর্তী ধাপে অপেক্ষমাণদের জন্য। তাহলে প্রশ্ন হবে, চাকরির বয়স কি আদৌ বাড়ানো সংগত নয়? গড় আয়ু বৃদ্ধিতে আমরা ভারত ও পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। তাহলে চাকরির বয়স অন্তত তাদের স্তরে নেওয়া হবে না কেন? কথাটি যৌক্তিক। পাশাপাশি এটাও স্মরণ রাখতে হবে, মাত্র পাঁচ বছর আগে আমরা অবসরসীমা বাড়িয়েছি। এতেই একটি বড় ধরনের জট সৃষ্টি হয়েছিল। আর কয়েকটি বছর পর বর্তমান বয়সসীমাটা ভারতের পর্যায়ে নিয়ে আসা অসংগত হবে না। আর কিছু বিরতি দিয়ে দিয়ে এক বছর করে বাড়লে জটলাও তেমন হবে না। বিশেষ করে এখন সচিবালয়ে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিবের যে সংখ্যা, এতে অবসরসীমা বাড়ালে অবস্থা আরও জটিল হতে পারে। আর পেনশন যখন যাঁর প্রাপ্য, তা সরকার দেবে। এটা বিলম্বিত করার যুক্তিতে অবসরসীমা বাড়ানোর কারণ খুব জোরালো নয়।

আমরা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছি বটে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও প্রশংসনীয়। তবে সবচেয়ে বড় কথা, আয়বৈষম্য বেড়ে চলেছে। এর লাগাম টেনে ধরার জন্য যে আর্থিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা দরকার তা দুর্বল। মূলত আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা ধনিকশ্রেণির হাতে চলে গেছে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের রাজনীতিতে রাজনীতিকদের স্থান এখন দ্বিতীয় কাতারে। সে বিষয়টি ভিন্নতর হলেও আলোচ্য নিবন্ধে প্রাসঙ্গিক। এই আয়বৈষম্য কমানোর অনেকগুলো হাতিয়ারের মধ্যে একটি হলো অধিকতর চাকরির সংস্থান করা। আর বাস্তব সত্যি হলো এ দেশে সবচেয়ে বড় একক চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান সরকার। সে ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন স্তরে নিয়মিত লোক নিয়োগ না দিলে অধিক বেকারত্ব বর্ণিত আয়বৈষম্যকে আরও বাড়াবে। আর নিয়মিত নিয়োগ দিতে হলে যাঁরা অবসর নেওয়ার কথা, তাঁদের তা করতে হবে। তাঁরা সরকারকে সেবা দিয়েছেন জীবনভর। সরকারও দিয়েছে তাঁদের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা। অবসর সুবিধাদিও সাম্প্রতিক কালে প্রসারিত হয়েছে অনেক। স্ফীত বেতন-ভাতার সঙ্গে বর্ধিত পরপর দুটি বড় অনুপাতের বেতন স্কেল মাত্র এক দশক আগে অবসরে যাওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে বড় রকমের বৈষম্য এর মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে। তাহলে এখন অবসরে ভয় বা শঙ্কা কিসের? রাষ্ট্র পরিচালনার ভার পরবর্তী প্রজন্মের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে অবসরে আসুন। দেশ তারা ঠিকই চালাবে।

কথা থাকবে, সরকারের এই সময়ে হঠাৎ করে প্রস্তাবটি একজন অতি দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছ থেকে এল কেন? তাঁর যুক্তি হচ্ছে সক্ষম অভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে আমরা বাড়ি পাঠিয়ে দেব কেন? এ ক্ষেত্রে বলা যায়, বিভিন্ন দেশে যাঁরা সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন, তখনো তাঁরা থাকেন সক্ষম। এ দেশেও অতীতে হয়েছে এখনো হচ্ছে। মূলত যেকোনো একটি জায়গায় পুরোনোকে বিদায় দিয়ে নতুনকে স্থান করে দেওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা। একে নৈতিকভাবে বিরোধিতা করার সুযোগ নেই। শুধু বিতর্ক থাকে, সীমারেখা কোথায় থাকবে? ৫৯ থেকে ৬০ বা ৬২। তারপরও তো অবসরেই যেতে হবে। ৫৭ বছরে অবসর নেওয়া ব্যক্তিদের অনেকে এখনো সামাজিক জীবনে তৎপর। আর তাঁদের কারও বিদায়ে আটকে নেই রাষ্ট্রযন্ত্র। বরং এই বিদায়ে নবীনেরা ক্রমান্বয়ে এগিয়ে আসার সুযোগ পেয়েছে। পাঁচ বছর আগে হঠাৎ স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এই অভিযাত্রা দুই বছরের জন্য। এর রেশ এখনো ভালোভাবে কাটেনি। আরও কয়েকটি বছর যাক, তখন নতুনভাবে ভাবা যাবে। হঠাৎ করে এই নির্বাচনের বছরে এসে রাজনৈতিক সুফলের ধারণাও যুক্তিনির্ভর নয়। অবসরসীমা বৃদ্ধিতে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তাঁদের বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া আবশ্যক। তাই এ বিষয়ে ধীরে চলাই সংগত। আশা করব সরকার তাই করবে। নচেৎ এত দিনে পালে বাতাস লাগত।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumderali 1950 @gmail. com