সিআইএর তৎপরতা নিয়ে আমরা নীরব কেন

রবার্ট ফিস্ক
রবার্ট ফিস্ক

ইরানে সম্প্রতি যে ছোটখাটো বিপ্লব ঘটে গেল, তা যে একরকম অদ্ভুত প্রকৃতির, সেটা বুঝতে আমার কিছুটা সময় লেগে গেল। ব্যাপারটা নতুন না হলেও ভীতিজাগানিয়া বটে।

ওখানকার ঘটনাপরম্পরার দিকে নজর দেওয়া যাক। বিপুলসংখ্যক দরিদ্র ও ভাগ্যাহত তরুণ মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের রাস্তায় নেমে এসে দারিদ্র্য, সরকারের দুর্নীতি ও স্বাধীনতাহীনতার ব্যাপারে অভিযোগ জানালেন। বেশ দ্রুত তাঁরা নিজেদের নেতাদের বিরুদ্ধে লেগে গেলেন। ব্যাপারটা খুবই ঠিক। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল, সরকারবিরোধীদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হলো। অন্তত ২১ জন প্রাণ হারান, যাঁদের মধ্যে দুজন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যও আছেন। অন্যদিকে মানুষও ইটের বদলে পাটকেলটি মেরেছে।

রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট দেশটির সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন, এই উত্তেজনার পেছনে বিদেশি, বিশ্বাসঘাতক ও গোয়েন্দাদের ভূমিকা আছে। রাষ্ট্রের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ নেতা পুরো বিষয়টিকে ‘টাকা, অস্ত্র, রাজনীতি, গোয়েন্দা’ তৎপরতার ফল হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। প্রধান সন্দেহভাজনদের তালিকায় আছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও সৌদি আরব। এরপর বিপুলসংখ্যক সরকার সমর্থক মাথায় প্রিয় নেতার ছবি ধারণ করে এই প্রতিবাদ আন্দোলনের বিরোধিতা করতে রাস্তায় নেমে আসে। এরপর সরকার ঘোষণা দিল, আন্দোলন ‘শেষ’ হয়ে গেছে।

২০১১ সালে সিরিয়ার বিক্ষোভের সঙ্গে এর তুলনা টানা ঠিক হবে না। কিন্তু এটা কি সেই একই দৃশ্যপট, একই মঞ্চনাটক বা পাণ্ডুলিপি নয়? সিরিয়ায় তো একদল দরিদ্র কৃষক সরকারের খ্যাপাটে কৃষিনীতির বিরোধিতা করতে রাস্তায় নেমেছিলেন। এরপর তাঁরা সরকারের দুর্নীতির প্রতিবাদ জানালেন এবং তারপর সরকার উৎখাতের দাবি করলেন, ঠিক যেমন এবার ইরানের প্রতিবাদকারীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি ও প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির বিরোধিতা করল। সিরিয়ার সরকারি বাহিনী জনতার ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করলে সরকারের সশস্ত্র বিরোধিতাকারীরা আচমকা সিরিয়ার সেনাবাহিনীর ওপর হামলা করতে শুরু করে। ওই সময় আসাদ সরকারও বলেছিল, এই ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে বিদেশি হাত আছে, যদিও ইরান এখনো ‘সন্ত্রাসী’ শব্দটা ব্যবহার করছে না। এরপর হাজার হাজার আসাদ সমর্থক তাঁর পোস্টার হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে এবং সরকার ঘোষণা দেয়, সংকটের ‘সমাধান’ হয়েছে।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সমাধান হয়নি, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের নানা চেষ্টা সত্ত্বেও আসাদ নাছোড়বান্দার মতো ক্ষমতা আঁকড়ে থাকলেন। ইরানে ২০০৯ সালে সন্দেহজনক নির্বাচনে আহমাদিনেজাদ (যাঁর সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিল আছে) নির্বাচিত হলে যে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হয়, তা খুব শক্ত হাতে দমন করা হয়েছিল, আসাদও ঠিক সেই কায়দায় ক্ষমতা ধরে রাখেন।

ইরানে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র নেই। কারণ, দেশটির কর্মকর্তারা ঠিক করেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কে দাঁড়াতে পারবেন আর কে পারবেন না। কিন্তু দেশটির সংসদ প্রকৃত অর্থেই ক্রিয়াশীল। আর ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর ইরানের স্বাধীনতাকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার সঙ্গে এখনই তুলনা করা ঠিক হবে না। তবে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির চেয়ে দেশটির সরকারের নৃশংসতা নিয়েই আমি বেশি চিন্তিত।

ব্যাপারটা হলো পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করা যায়, কিন্তু মৃত মানুষকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। উদাহরণ হিসেবে ২০০৯ সালে ২৩ বছর বয়সী দেলারা দারাবির মৃত্যুদণ্ডের কথা উল্লেখ করা যায়। তাঁকে যখন ফাঁসিকাষ্ঠের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন মোবাইল ফোনে তিনি মাকে বলছিলেন, ‘মা, ফাঁসুড়ে আমার সামনে দড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা আমাকে ঝুলিয়ে দেবে। আমাকে বাঁচাও।’

ছেলেবন্ধুকে বাঁচাতে দেলারা মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে নিজেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বাবার দূরসম্পর্কের ভাইকে তিনি হত্যা করেছেন। ফাঁসিতে ঝোলানোর সময় পুরুষ ফাঁসুড়ে তাঁর মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলেছিলেন, আপনার মেয়েকে এখন আর কেউ বাঁচাতে পারবে না। ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ সে বছর আমাকে বলেছিলেন, তিনি মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে। কিন্তু ইরানের বিচার বিভাগ স্বাধীন, তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এমনকি একটি পিঁপড়াও মারতে চাই না’।

অবশ্যই এ ব্যাপারে তিনি কিছু করেননি। ২০১৫ সালে প্রায় ৭০০ ও ২০১৬ সালে আরও ৫৬৭ জনকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয়েছিল। তবে এটা ঠিক, তাঁদের অনেকেই ছিলেন মাদক ব্যবসায়ী। এই বিচারগুলো খুবই বিশৃঙ্খল ছিল। এই মৃত্যুদণ্ডে যেমন ইসলামি রিপাবলিকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছিল, তেমনি হাসান রুহানির কর্তৃত্ব কলঙ্কিত হয়েছিল। অথচ তেহরান পারমাণবিক চুক্তির পর তাঁর ওপরই আমরা আশা রেখেছিলাম।

এবার সিরিয়া ও ইরানের মধ্যকার সেই তুলনার প্রসঙ্গে যাই, যেটা ঘুরেফিরে আমাদের মনে আসছে। লেবাননে ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ ছিল দেশটিতে সিরিয়ার ঘনিষ্ঠতম মিত্রকে শেষ করে দেওয়া, যারা আবার ইরানের অনুগ্রহপ্রাপ্ত। সেটা ব্যর্থ হয়েছিল। হিজবুল্লাহ্ দাবি করে, তারা এই যুদ্ধে জিতেছিল। তারা যুদ্ধে জেতেনি, কিন্তু ইসরায়েল হেরেছিল। এরপরের লক্ষ্যবস্তু ছিল সিরিয়া, সময়টা ছিল ২০১১ সাল। তখন থেকে যে শোক ও নির্মমতার কাহিনি আমরা শুনছি, তা কেবল বরফখণ্ডের চূড়ামাত্র। কিন্তু পশ্চিম ও ইসরায়েল আরও একবার পরাজিত হলো। আসাদ বেঁচে যান, যাঁর সহায়তায় ছিল সেই বিরক্তিকর রুশ, ইরান ও হিজবুল্লাহরা।

এবার ইরানের পালা, সেই একই কৌশল ও পাণ্ডুলিপি। সেই একই শত্রু সৌদি আরব আনন্দের সঙ্গে তা দেখছে। ব্রিটেন মানবাধিকার নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানা কিছু বলছে এবং আহা-উহু করছে। মার্কিনরা আবার নিরপরাধ প্রতিবাদকারীদের ব্যাপারে অতি উৎসাহী। কিন্তু একটি ব্যাপার আমাকে ধন্দ্বে ফেলে দিচ্ছে আর সেটা হলো মার্কিন গণমাধ্যম এ ব্যাপারে সেই মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের নাম একবারও বলেনি, যারা কেবল ছয় মাস আগে ট্রাম্প কর্তৃক নিযুক্ত হয়ে ইরানে সিআইয়ের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পদোন্নতি পেয়েছিলেন।

মোদ্দা কথা হলো যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে ইরানের বন্ধুদের দুর্বল করার চেষ্টা করেছে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর তথ্যমতে, সিআইএ ২০০৮ সালে হিজবুল্লাহর অন্যতম শীর্ষ নেতা ইমাদ মুগনিয়েহকে হত্যা করে। এই পত্রিকাটি মনে করে, যা কিছু ছাপার যোগ্য, তাই ছাপাতে হবে। তারা এ কথাও ছেপেছে যে ‘ইরান সিআইএর সবচেয়ে কঠিন লক্ষ্য’। আমরা কি ইরানের এই সাম্প্রতিক ঘটনাবলির মধ্যে কোনো সূত্র খুঁজে পাচ্ছি না? ট্রাম্পের নিযুক্ত সিআইয়ের কর্মকর্তারা কি বসে আছেন? নিশ্চয়ই নয়? কিন্তু গণমাধ্যম এ ব্যাপারে নীরব কেন?

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া।

রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্ট-এর মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।