নতুন মধ্যবিত্ত উদার গণতন্ত্রে আগ্রহী নয়?

>বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিকাশমান মধ্যবিত্তের ভূমিকা কী, গণতন্ত্রের সংকট এবং সমাজে ধর্মের প্রভাব বিষয়ে তারা কী ভূমিকা পালন করছে, ভবিষ্যতে তাদের ভূমিকা কী হতে পারে? সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিষয়ক ত্রৈমাসিক জার্নাল প্রতিচিন্তার জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৭ সংখ্যায় এ বিষয়ে প্রকাশিত আলী রীয়াজের গবেষণা-নিবন্ধের সারসংক্ষেপ তিন পর্বে প্রকাশিত হবে। আজ দ্বিতীয় পর্ব
.
.

বাংলাদেশে গত কয়েক দশকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা থেকে আমরা দেখতে পাই, মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকার বড় হচ্ছে, অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ক্রমে দুর্বল হয়েছে এবং এখন একধরনের ‘দোআঁশলা’ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, যার কিছু উপাদান কর্তৃত্ববাদী। সমাজে ধর্মের দৃশ্যমানতা স্পষ্ট এবং ধর্মের সেই ব্যাখ্যাগুলোই প্রসার লাভ করছে, যেগুলো ধর্মের অনুদার দিকগুলোকেই প্রাধান্য দেয়। এগুলো সাধারণভাবে মধ্যবিত্তের প্রচলিত বিশ্ববীক্ষা ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ বলেই আমরা এত দিন জেনে এসেছি। তা সত্ত্বেও এই বিরাজমান অবস্থার প্রতি বিকাশমান মধ্যবিত্তের সমর্থন লক্ষণীয়।
মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক আছে। মধ্যবিত্তবিষয়ক বিভিন্ন গবেষণায় ব্যবহৃত সংজ্ঞাগুলোকে দুই ভাবে ভাগ করা যায়-ব্যক্তিক (সাবজেক্টিভ) ও নৈর্ব্যক্তিক (অবজেক্টিভ)। ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে শ্রেণি হচ্ছে একধরনের মানসিক অবস্থান; একজন মানুষ নিজেকে মধ্যবিত্ত মনে করছে কি না, তার ওপর নির্ভর করছে তাকে আমরা সেই শ্রেণিভুক্ত করব কি না। অন্যদিকে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক শ্রেণি নির্ধারিত হয় কতকগুলো সামাজিক-অর্থনৈতিক সূচক দিয়ে। এই সূচক নির্ধারণের দুটি ধারা-একটি পরিমাণবাচক (কোয়ান্টিটেটিভ), যেমন আয়, শিক্ষা, পেশা ইত্যাদি। অন্যটি গুণবাচক (কোয়ালিটেটিভ), যেখানে বলা হচ্ছে যে মধ্যবিত্ত হচ্ছে তারাই, যারা কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, যা তাদের অন্যান্য প্রবণতা থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করে। মধ্যবিত্তবিষয়ক আলোচনায় সাধারণত পরিমাণবাচক দিকটি প্রাধান্য পায়। অর্থাৎ মধ্যবিত্ত বলতে আসলে অর্থনৈতিক বিবেচনায় মধ্যবিত্ত বোঝায়।

আমরা এই বিকাশমান শ্রেণির বিত্তের সম্ভাব্য উৎসের দিকে মনোযোগ দিতে পারি। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে কৃষি খাতের অবদান নাটকীয়ভাবে কমেছে এবং সেবা খাত প্রধান খাত হিসেবে বিকশিত হয়েছে। স্বাধীনতার প্রথম দশকে (১৯৭১-৮০) গড়ে মোট অভ্যন্তরীণ আয়ের ৪৫ শতাংশ আসত কৃষি থেকে, সেবা খাতের অবদান ছিল ৪৪ শতাংশ, শিল্প খাতের অবদান ছিল ১১ শতাংশ। ২০০০ সালে যেখানে কৃষি খাতের অবদান ছিল ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ, তা ২০১৫ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশে; সেবা খাত ৫২ দশমিক ৯১ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। শিল্প খাতের অবদান ২৩ দশমিক ৩১ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। মাঝারি আয়ের দেশগুলোতে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে অকৃষি খাতের অবদান বৃদ্ধি মোটেই অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। বাংলাদেশে গত দুই দশকে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে, তার বিত্তের সূত্রের প্রধান উৎস বিকাশমান সেবা খাত। সেবা খাতের যে দুটি বৈশিষ্ট্যের দিকে আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই তা হচ্ছে, উৎপাদনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্কের অভাব এবং বিশ্বায়নের ফলে তার বৈশ্বিক যোগাযোগ। এই দুই-ই এই শ্রেণির সদস্যদের বিশ্ববীক্ষা, মানস গঠন ও সামাজিক-রাজনৈতিক ভূমিকায় প্রভাব ফেলবে বলে আমরা অনুমান করতে পারি।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকট নতুন নয় এই অর্থে যে স্বাধীনতার পর থেকেই দেশটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে স্থায়ী রূপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৯০ সালের পর এই অবস্থার পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও গত আড়াই দশকে সাফল্য আশাব্যঞ্জক নয়। তদুপরি ২০১৪ সালে প্রায় সব বিরোধী দলের বর্জন সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন দল এককভাবেই নির্বাচন সম্পন্ন করে, যার ফলে সংসদে বিরোধী দলের কোনো অস্তিত্বই নেই। ওই নির্বাচনের আগে ও পরে ক্ষমতাসীন দল এমন সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যা মর্মবস্তুর দিক থেকে গণতান্ত্রিক বলে বিবেচিত হতে পারে কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এখন যে ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, তাকে আমরা ‘দোআঁশলা ব্যবস্থা’ (হাইব্রিড রেজিম) বলতে পারি। এর লক্ষণগুলোর মধ্যে আছে এমন ব্যবস্থার উপস্থিতি, যেখানে দৃশ্যত গণতন্ত্রের কিছু দিক, যেমন নিয়মিত নির্বাচন, বিরোধী দলের উপস্থিতি, নিয়ন্ত্রিতভাবে মতপ্রকাশের উপায় এবং বিচার বিভাগের কাগুজে স্বাধীনতা থাকলেও শাসনব্যবস্থার মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়, নতুবা সেগুলো কার্যকর থাকে না, জবাবদিহির প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ও আইনের শাসন অনুপস্থিত থাকে এবং সাংবিধানিকভাবেই ব্যক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হয়।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়া, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সততা (ইনটিগ্রিটি) প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া, ভিন্নমতের প্রকাশ সংকুচিত হওয়া, বিদ্যমান একাধিক আইনের অপব্যবহার (যেমন আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা, যার আওতায় মামলার সংখ্যা ২০১৬ সালে ছিল ৩৫ টি), ভিন্নমত নিয়ন্ত্রণমূলক নতুন আইনের প্রস্তাব (যেমন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন ২০১৬), ক্রমবর্ধমান বিচারবহির্ভূত হত্যা (২০১৬ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৭৮) এবং গুমের (২০১৬ সালে ছিল ৯০ জন) ঘটনা বৃদ্ধি সত্ত্বেও এসব বিষয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির যথেষ্ট উদ্বেগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

এ থেকে প্রশ্ন তোলা যায়, গত এক দশকে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্য থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনে কি অনুৎসাহ লক্ষ করা যাচ্ছে? গণতন্ত্র সম্পর্কে কি ভিন্ন কোনো ধারণা তাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে ‘উন্নয়ন’কে গণতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে উপস্থাপনের যে চেষ্টা হচ্ছে, তা কি এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে? একজন বিশ্লেষক বলছেন, ‘রাষ্ট্রের চরিত্র কী হবে, সেখানে গণতন্ত্র ও জবাবদিহি কীভাবে নিশ্চিত হবে, রাষ্ট্রপরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণ কীভাবে বাড়ানো যাবে ইত্যাদি বিষয়েও সাধারণ জনগণের মধ্যে ক্রমেই একধরনের নির্লিপ্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে’ (আবু তাহের খান, কালের কণ্ঠ, ৩ নভেম্বর ২০১৫)। একই সময়ে সরকার-সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের একাংশের কাছ থেকে ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের’ ধারণা প্রচার ও তা প্রতিষ্ঠার দাবি তোলা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির আগ্রহ ও অবদান ছিল বেশি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পটভূমিবিষয়ক গবেষণালব্ধ ফলাফলগুলোয় সুস্পষ্টভাবে এটাই চিহ্নিত যে বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে মধ্যবিত্ত শ্রেণি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তদুপরি ১৯৮০-এর দশকে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও এই শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

বাংলাদেশের সমাজে ধর্মের ভূমিকা ও অবস্থান বিষয়ে কথা উঠলে সাধারণত গত কয়েক দশকে সাংবিধানিক পরিবর্তন, রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দলের বিকাশ, প্রধান দলগুলোর সঙ্গে তাদের সখ্য এবং তাদের ভূমিকার কথাই আলোচিত হয়। এসব বিষয়ের গুরুত্ব অস্বীকার না করেও বলা দরকার, এর বাইরে দৈনন্দিন জীবনাচরণেও আমরা ধর্মের উপস্থিতি দেখতে পাই। এখানে ইসলাম ধর্মের উপস্থিতি নতুন বিষয় নয়, কিন্তু সাম্প্রতিক দুটি দিকের প্রতি আমি মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই। প্রথমত, ব্যক্তিগত জীবনাচরণের অংশ হিসেবে ধর্ম পালন করার চেয়ে তাকে সবার কাছে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে হাজির করার প্রবণতা; দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে ইসলাম ধর্মের যে সমন্বয়বাদী, উদার ধারা ও ব্যাখ্যা প্রাধান্য পেয়ে এসেছে, এখন তার বিপরীতে একধরনের আক্ষরিক এবং অনুদার ব্যাখ্যা, যার অধিকাংশ ইসলামপন্থী তাত্ত্বিকদের করা, তা প্রধান হয়ে উঠেছে। এই প্রবণতাগুলো সমাজের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যেই বেশি লক্ষণীয়। তাদের মধ্যে কেবল ধর্মের ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহই দেখা যাচ্ছে তা নয়, ধর্মাচরণকে জনসমক্ষে উপস্থাপনের মাধ্যমে তার একধরনের সামাজিক স্বীকৃতি লাভের চেষ্টাও স্পষ্ট। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের বাক্য, বাগ্ধারা, সম্ভাষণ থেকেও এর পক্ষে প্রমাণ মেলে। এর সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রমাণ হচ্ছে কিছু কিছু আরবি শব্দের ব্যাপক প্রচলন। তদুপরি বাংলাদেশে প্রচলিত পোশাক-পরিচ্ছদেও এর প্রভাব দৃশ্যমান। একে কেউ কেউ চিহ্নিত করেছেন ‘আরবিকরণ’ বলে।

গণতন্ত্র ও ধর্মের প্রশ্নে মধ্যবিত্তদের আচরণ বিষয়ে এসব পর্যবেক্ষণের অর্থ এই নয় যে গোটা মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্যই তা প্রযোজ্য। অবশ্যই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে একটি অংশ দৃশ্যত ভিন্ন আচরণ করে এবং তারা ঐতিহ্যগত ভূমিকা পালনে সচেষ্ট। কিন্তু গত এক দশকের বেশি সময়ের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আমি মনে করি যে এসব প্রশ্নে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভেতরে একটা বড় ধরনের বিভক্তি তৈরি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে গত এক বা দেড় দশকে মধ্যবিত্তদের যে অংশের বিকাশ ঘটেছে, যাদের আমি ‘নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি’ বলে বর্ণনা করতে চাই, তাদের ভেতরেই গণতন্ত্রের উদারনৈতিক দিকগুলোর আবেদন কম এবং একই সঙ্গে তাদের মধ্য থেকেই সমাজে ও রাষ্ট্রে ধর্মের প্রত্যক্ষ ও প্রকাশ্য ভূমিকার তাগিদ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশের এই নতুন বিকাশমান মধ্যবিত্তকে রেহমান সোবহান বর্ণনা করেছেন ‘এক্সক্লুসিভ’ এবং বিশ্বায়িত বা গ্লোবালাইজড বলে। এই দুই ধরনের মধ্যবিত্তের মধ্যকার পার্থক্যগুলো কী?

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।