যুক্তরাষ্ট্রকে পাশ কাটালেন মুন জে ইন

মুন জে ইন
মুন জে ইন

বছর দুয়েক ধরে চলা বাগ্‌যুদ্ধের শেষে দুই কোরিয়া অবশেষে আজ বুধবার সীমান্তবর্তী অস্ত্রবিরতির এলাকাভুক্ত গ্রাম পানমুনজমে আলোচনায় বসছে। আলোচনার মূল বিষয়বস্তু যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখে দক্ষিণ কোরিয়ার পিয়ংচেনে নির্ধারিত শীতকালীন অলিম্পিকে উত্তর কোরিয়ার অংশগ্রহণ, তবে এর তাৎপর্য যে কেবল অলিম্পিকে উত্তর কোরিয়ার যোগদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, তা সহজেই অনুমেয়। কতটা সুদূরপ্রসারী এর প্রভাব, তা নিয়ে সহজ ধারণা লাভের চেষ্টায় মাত্র কিছুদিন আগে উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের মধ্যকার উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের দিকে আলোকপাত করা যেতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে ‘হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা’ ধরনের খিস্তিসুলভ অভিব্যক্তি আওড়ে চলার মুখে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, পরমাণু অস্ত্র ছোড়ার বোতাম যে তাঁর হাতের কাছেই আছে, তিনি যেন সেটা ভুলে না যান। এর জবাবে বিলম্ব না করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, তাঁরও আঙুলও সে রকম বোতামের ওপর বসানো আছে এবং তাঁর সেই যন্ত্র আরও বড় এবং আরও অনেক বেশি শক্তিশালী।

বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক শেষ হতে যাওয়ার অল্প কিছুকাল আগে বিশ্বের প্রধান শক্তিধর দেশের প্রধান এবং সেই শক্তির বশ্যতা স্বীকার না করা একটি দেশের রাষ্ট্রীয় নেতাদের এমন বক্তব্য আমরা শুনছি। এই দুই মন্তব্য থেকে আভাস পাওয়া যায়, কতটা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে দেশ দুটির সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য মাসাধিককাল ধরে বলে আসছে উত্তর কোরিয়াকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। উত্তর কোরিয়ার অস্তিত্ব লোপাট করে দেওয়ার হুমকিও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে দিয়েছেন এবং উত্তর কোরিয়ার নেতাকে ‘বোমা বামন’ আখ্যায়িত করেছেন। সেই বাগাড়ম্বরের জবাব দিতেই হয়তো কিম জং উন বললেন, তাঁর হাত প্যান্টের বোতামে নয়, পারমাণবিক অস্ত্রের বোতামে রাখা আছে। তবে ওয়াশিংটনের সঙ্গে পিয়ংইয়ংয়ের এ রকম বিতণ্ডা চলতে থাকার মুখে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন শুরু থেকেই বলে আসছেন যে বলপ্রয়োগ না করে বরং আলোচনার টেবিলে সমস্যার সমাধান খুঁজবেন তিনি। গত বছরের মে মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে প্রচার অভিযান শুরু করার সময় থেকেই এটা ছিল তাঁর ঘোষিত প্রতিশ্রুতির একটি। দক্ষিণ কোরিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতোই প্রেসিডেন্ট মুনেরও এটা ভালোভাবেই জানা আছে যে ট্রাম্প সাহেব তাঁর মরণখেলার বোতাম টিপে দিলে উত্তর কোরিয়াই যে কেবল সংকটের মধ্যে পড়বে তা নয়, দক্ষিণ কোরিয়ার নিজের অস্তিত্বও ভয়ংকর সংকটাপন্ন হয়ে উঠবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রকে পাশ কাটিয়ে কীভাবে আলোচনা শুরু করা যায়, সেই সুযোগের অপেক্ষায় তিনি ছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রকে এভাবে পাশ কাটিয়ে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসা দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য সহজ কাজ নয়। এ কারণে তা নয় যে দেশটি হচ্ছে মার্কিন সামরিক কৌশলের একটি ফ্রন্টলাইন এবং হাজার চল্লিশেক মার্কিন সেনা সেই দেশে মোতায়েন আছে। ফলে ওয়াশিংটনকে পাশ কাটিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া বর্তমান বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শত্রুদেশ উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসুক, ওয়াশিংটনের সেটা কখনো কাম্য নয়। তবে বিগত দিনগুলোতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট লাগামহীন প্রলাপ বকে যাওয়ার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য সেই সুযোগ তিনি নিজেই তৈরি করে দিয়েছেন। পরমাণু যুদ্ধ আচমকা শুরু হয়ে গেলে কোন পরিণতির দিকে দেশকে যেতে হতে পারে, তা নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার নেতৃত্বের পাশাপাশি দেশটির জনগণও উদ্বিগ্ন। সে রকম এক কঠিন সময়ে নববর্ষ উপলক্ষে প্রদত্ত বিবৃতিতে উত্তরের নেতা কিম জং উনের দক্ষিণের সঙ্গে সংলাপ শুরু করতে প্রস্তুত থাকার ইঙ্গিত দক্ষিণের নেতা সাদরে গ্রহণ করেন এবং আলোচনার প্রস্তুতি শুরুর নির্দেশ দেন কর্মকর্তাদের।

দীর্ঘ বিরতি শেষে আবারও শুরু হতে যাওয়া দুই কোরিয়ার আলোচনার অর্থ যে সংকট থেকে বের হয়ে আসা, তা অবশ্যই নয়। মূল আলোচনা শুরু হলে নতুন কোন শর্ত উত্তর কোরিয়া চাপিয়ে দিতে চাইবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। দুই দেশের মধ্যে বন্ধ থাকা হটলাইন যোগাযোগ পুনরায় চালু হওয়ার আগেই উত্তর কোরিয়া অবশ্য জানিয়ে দিয়েছিল, আলোচনায় বসতে হলে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্ধারিত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক মহড়া দক্ষিণ কোরিয়ার বাতিল করতে হবে। দক্ষিণের নেতা অবশ্য বাতিলের পথে না গিয়ে মহড়া স্থগিত রাখার অনুরোধ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রকে। দক্ষিণ কোরিয়া আগে থেকেই চাইছিল, শীতকালীন অলিম্পিক চলার সময় নির্ধারিত সেই মহড়ার সময়সূচি যুক্তরাষ্ট্র যেন পুনর্নির্ধারণ করে। মার্কিন প্রশাসন অবশ্য এতে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে দিয়েছে। ফলে বলা যায়, স’ওলের সঙ্গে ওয়াশিংটনের একধরনের পরোক্ষ টানাপোড়েন ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে এবং এই চাপ দক্ষিণ কোরিয়া কত দিন পর্যন্ত ধরে রাখতে পারবে, তার আগাম পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন।

দক্ষিণ কোরিয়া জন্মলগ্ন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের এক ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশ। তবে মৈত্রীর সুযোগ নিয়ে নিজস্ব কৌশলগত লক্ষ্য বাস্তবায়নে ওয়াশিংটন কখনোই পিছপা হয়নি। অঞ্চলজুড়ে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়ে চলার মুখে দক্ষিণ কোরিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের এখন আরও বেশি দরকার। ফলে ওয়াশিংটন চাইবে নানা রকম উপায়ে দেশটিকে নিজেদের প্রভাববলয়ের মধ্যে ধরে রাখতে, যেমনটা এর আগে দেখা গিয়েছিল জাপানের বেলায়। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের লাগামহীন মুখের বুলি ও অপ্রত্যাশিত আচরণ ওয়াশিংটনের অনেক মিত্রদেশের জন্যও বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ার বেলায়ও তা লক্ষ করা যাচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় অনেকেই চাইছেন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ওয়াশিংটন আর সিউলের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে। তবে বিশ্বের ভূরাজনৈতিক বিভাজন ও আঞ্চলিক পরিস্থিতি এখনো সে রকম কোনো অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে না। ফলে আপাতত হঠাৎ সৃষ্ট সুযোগ হাতছাড়া না করাই হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার নেতৃত্বের সামনে সবচেয়ে জুতসই বিকল্প।

কোরীয় উপদ্বীপের উত্তর ও দক্ষিণ অংশের মধ্যকার আলোচনা কেবল দুই কোরিয়ার মধ্যকার বিবাদ নিরসনের প্রচেষ্টা এবং এই অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির যৌক্তিকতার দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়; একই সঙ্গে দ্রুত পরিবর্তনশীল এই সময়ে চীন ও রাশিয়াকে যুক্ত করে বৃহত্তর আঞ্চলিক পরিমণ্ডলের রাজনীতি কোন পথে অগ্রসর হতে পারে এবং এসব বিষয়ে দুই কোরিয়ার আরেক নিকট প্রতিবেশী দেশ জাপানের ভবিষ্যৎ অবস্থান কী হবে, তারও হয়তো কিছু পরোক্ষ ইঙ্গিত আলোচনা থেকে পাওয়া যাবে। তবে আগেই যেমন বলা হয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য এটা সহজ আলোচনা নয়। এর আগে দক্ষিণ কোরিয়ার অন্তত দুজন উদারপন্থী প্রেসিডেন্ট উত্তরের সঙ্গে আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি নিশ্চিত করার পরও দেশের ভেতরের ও বাইরের অশুভ শক্তি নানা পাঁয়তারা করেছে, যদিও সবটাই শেষ পর্যন্ত ভেস্তে গিয়েছিল। এবারও যে তেমন কিছু হবে না, তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। তবে আশাব্যঞ্জক দিকটি হলো এ রকম যে দক্ষিণের নেতা তাঁর দুজন পূর্বসূরির সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা ভুলে যাননি এবং সেই স্মৃতি তাঁকে আরও সতর্ক করবে।

মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।