প্রতিবাদী আফসানাকে অভিনন্দন

আফসানা
আফসানা

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা টেলিফোন করে জানান, তাঁরা জনগণের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে এ বছর ৪ জানুয়ারি ঢাকায় কোনো সমাবেশ বা মিছিলের আয়োজন করেননি। তাঁরা মিছিলটি করেছেন ৬ জানুয়ারি শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে। খুবই ভালো খবর। প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন হিসেবে জনগণের প্রতি তাদের একটি দায়িত্ব আছে। কিন্তু ৫ জানুয়ারি শুক্রবার ছুটির দিন সত্ত্বেও বিএনপিকে সমাবেশ করার অনুমতি না দিয়ে কেন একটি অখ্যাত ইসলামি সংগঠনকে দেওয়া হলো, সেই প্রশ্নের জবাব ওই ছাত্রনেতা কিংবা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা দিতে পারেননি। 

ওই ছাত্রনেতা অনেকটা উপদেশের সুরে বললেন, ‘ছাত্রলীগের কোনো কর্মী মন্দ কাজ করলে আপনারা সমালোচনা করুন। কিন্তু ভালো কাজ করলে সেটিও বলুন। আমি তাঁকে বললাম, ‘ছাত্রলীগ অন্তত একটি ভালো কাজ করে দেখাক, আমরা অবশ্যই তার প্রশংসা করব।’ শুধু ছাত্রলীগ কেন, যেকোনো সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ভালো কাজ করলে আমরা তাঁদের তারিফ করতে কার্পণ্য করব না।
কিন্তু ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ছাত্রলীগ ঢাকায় কর্মসূচি না নিলেও কুমিল্লা, বরিশাল ও চট্টগ্রামে সংগঠনের দুই পক্ষের কর্মীরা মারামারিতে লিপ্ত হয়েছেন। কুমিল্লায় ১০ জন, চট্টগ্রামে ৫ জন আহত হয়েছেন। আর ৭ জানুয়ারি সিলেটের টিলাগড়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ছাত্রলীগের এক কর্মী নিহত হন। বলা যায়, নতুন বছরে ছাত্রলীগের হাতে ছাত্রলীগের প্রথম খতম। এর আগে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত এক ছাত্রলীগ কর্মীর মা সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে আমরণ অনশন করেছিলেন। পরে তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের আশ্বাসে অনশন ভাঙলেও মামলার অগ্রগতি হয়েছে কি না, আমাদের জানা নেই।
ঢাকায় ছাত্রলীগ কর্মীরা মারামারি ছাড়াই ৬ জানুয়ারি মিছিল শেষ করতে পেরেছেন, সে জন্য তাঁরা ধন্যবাদ পেতে পারেন। কিন্তু এর তিন দিন না যেতেই ছাত্রলীগ পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীকে কক্ষ থেকে বের করে দিয়ে। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, ভুক্তভোগী ছাত্রীর নাম আফসানা আহমেদ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের প্রথম বর্ষের ছাত্রী এবং বেগম রোকেয়া হলের বাসিন্দা। আফসানা ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচিতে অংশ নেননি। এরপর হলের ছাত্রলীগের কর্মী ওয়াহিদা সিনথি, সাদিয়া স্বর্ণা, শিলা, ইলাসহ কয়েকজন তাঁকে হল থেকে সোমবার রাতে বের করে দেন।’
আফসানা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রফন্টের একজন কর্মী হওয়ায় তিনি ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যোগ দেননি। কিন্তু ছাত্রলীগ নাকি নিয়ম জারি করেছে, প্রথম বর্ষের সব ছাত্রীকে ছাত্রলীগের সব কর্মসূচিতে যোগ দিতে হবে। অন্যথায় তাঁরা হলে থাকতে পারবেন না। সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে আফসানাকে কক্ষ থেকে বের করে দেওয়া হলে প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ইসমত আরা বেগম তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে (হলের সংস্কারকাজ চলায় সাময়িক ব্যবস্থা) অবস্থান করার কথা বলেন। এতে তিনি রাজি না হয়ে রাতে হলের ফটকের সামনে অবস্থান করেন এবং ঘটনার প্রতিবাদে মঙ্গলবার সকালে আফসানা রোকেয়া হলের সামনে ‘আমরণ অনশনে’ বসেন। ব্যানারে লেখা ছিল, ‘ছাত্রলীগ কর্তৃক হল থেকে বের করে দেওয়ার প্রতিবাদে আমরণ অনশন।’ কয়েক ঘণ্টা পর আফসানার কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ নিয়ে সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম জাকির হোসেন ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্য ওই ছাত্রীকে তাঁর কক্ষে দিয়ে আসেন।
এর আগে দুপুরে হলের ছাত্রলীগের চার কর্মীর নেতৃত্বে অর্ধশত ছাত্রী আফসানার বিরুদ্ধে হল ফটকের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। তাঁদের দাবি, ‘ওই ছাত্রী হলে ওঠার পর থেকেই সিনিয়র শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বেয়াদবি করছিলেন। এমনকি প্রভোস্টের সঙ্গেও বেয়াদবি করেন। তাই সাধারণ ছাত্রীরা তাঁকে হল থেকে বের করে দিয়েছেন।’ ‘সাধারণ ছাত্রীরা’ এ রকম একটি অসাধারণ কাজ করতে কেন গেলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর নেই।
এ ঘটনায় হল কর্তৃপক্ষও তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। একজন ছাত্রীকে যাঁরা হল থেকে জোর করে বের করে দিলেন, কর্তৃপক্ষ তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে ওই ছাত্রীকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা আফসানার সাহসকে অভিনন্দন জানাই। তিনি ছাত্রলীগ কিংবা কথিত সাধারণ ছাত্রীদের জবরদস্তির প্রতিবাদ করেছেন। কেউ সঙ্গে না থাকলেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে একা দাঁড়াতে হবে।
আর ছাত্রলীগের অভিযোগ অনুযায়ী আফসানা যদি হল কর্তৃপক্ষ কিংবা কোনো ছাত্রীর সঙ্গে বেয়াদবি করে থাকেন, সেটি দেখার দায়িত্ব হল কর্তৃপক্ষের, ছাত্রলীগের কর্মী কিংবা কথিত সাধারণ ছাত্রীদের নয়। তথাকথিত সাধারণ ছাত্রীরা হল কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ না করে নিজেরা আইন হাতে তুলে নিয়েছেন। হল কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি করেছে। আমরা দেখতে চাই, কমিটি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করবে। এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের কিংবা তাদের অভিভাবক সংগঠনের নেতারা কী বলেন, তা-ও শোনার অপেক্ষায় আছি। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য ঢাকার দেয়ালে উৎকীর্ণ করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘ছাত্রলীগ কর্মীদের শুধু ভালো ছাত্র নয়, ভালো মানুষ হতে হবে।’ কিন্তু তাঁর কোনো উপদেশই যে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কানে পৌঁছায়নি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাই তার প্রমাণ।
এ প্রসঙ্গে অতীতের একটি ঘটনা মনে পড়ল। খবরটি ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোয় ১৮ জানুয়ারি ২০১১। অভিযোগ ও অ্যাকশন প্রায় একই। স্থানকাল ভিন্ন। খবরটির কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি, ‘কনকনে শীতের রাতে গত রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হলের অতিথি কক্ষের চিত্র ছিল কিছুটা আলাদা। ছাত্রলীগের হল শাখার সভাপতি ও তাঁর অনুসারীদের সামনে ‘কাঠগড়ায়’ দাঁড়িয়েছিলেন বিভিন্ন বিভাগের তৃতীয় সেমিস্টারের ১০-১২ জন ছাত্র। তাঁরা সবাই হলের ২২৬ (ক) কক্ষে থাকেন। তাঁদের অপরাধ, অতিথি কক্ষে ছাত্রলীগের সভায় উপস্থিত হননি, বড় ভাইদের দেখেও সালাম দেননি। প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্ররা জানান, জেরার একপর্যায়ে হল শাখার সভাপতি সাইদ মজুমদার ও তাঁর অনুসারী কয়েকজন নেতা-কর্মী ওই শিক্ষার্থীদের ভাঙা টেবিল ও চেয়ারের পায়া দিয়ে মারধর শুরু করেন। ছাত্রলীগের ওই নেতাদের মধ্যে একজন এ সময় কয়েকজন ছাত্রের মাথা দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা দেন। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র শফিক। এ ছাড়া বিশ্ব ধর্মতত্ত্ব বিভাগের প্রভাষ, উর্দু বিভাগের বাশার এখনো হলের বাইরে অবস্থান করছেন।
এ বিষয়ে হল সভাপতি সাইদ মজুমদার রাতে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বড় ভাইদের সালাম দেয় না, সম্মান করে না, প্রোগ্রামে আসে না—তাদের মারব না তো কী করব?’ তবে বিকেলে সাইদ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু ছাত্র হলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছিল। তাই তাদের হল থেকে বের করে দিয়েছি।’
২০১১ সালে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, এখন আর তাঁরা নেই। নতুন নেতৃত্ব এসেছেন। প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুযায়ী মার্চে ছাত্রলীগের সম্মেলন হলে বর্তমান নেতৃত্বও থাকবে না। আরেক দল নেতা ছাত্রলীগের হাল ধরবেন।
কিন্তু ‘বেয়াদবির কারণে’ মধ্যরাতে হল থেকে বের করে দেওয়ার এই সংস্কৃতি বদলাবে কি?

সোহরাব হাসান: লেখক ও সাংবাদিক।