'চল মিনি আসাম যাব...'

২ জানুয়ারি, ২০১৮। পুলিশের উপস্থিতিতে নাগরিক পুঞ্জির তালিকায় নাম দেখতে আসা অসমিয়া মুসলিম বাঙালি নারীরা। ছবি: রয়টার্স
২ জানুয়ারি, ২০১৮। পুলিশের উপস্থিতিতে নাগরিক পুঞ্জির তালিকায় নাম দেখতে আসা অসমিয়া মুসলিম বাঙালি নারীরা। ছবি: রয়টার্স

কালি দাশগুপ্তের ‘বুকফাটা’ কবিতার ‘চল মিনি আসাম যাব’ এখন আসামে বসতি গড়া মানুষের প্রাণের গানে পরিণত হয়েছে। আসামে চা–বাগানের ভিত্তি গড়তে, রেললাইন টানতে আর কৃষিতে নতুন দীক্ষা আনতে পূর্ব বাংলা, আজকের ঝাড়খন্ড (তখনকার বিহার) ও মধ্যপ্রদেশ থেকে ব্রিটিশরা নানা প্রলোভনে খেটে খাওয়া মানুষকে নিয়ে গিয়েছিল আসামে। রক্ত পানি করে তারা আসামকে গড়ে তুলেছিল তিলে তিলে। এর মধ্যেই বিকাশ ঘটেছে মধ্যস্বত্বভোগী একদল ফাঁকিবাজ যাদুরামের। তারা দুই তরফের মানুষকেই ঠকিয়েছে।

অহম বা আসামে মানুষের বসবাস ব্রহ্মপুত্র আর বরাক অববাহিকা ঘিরে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার বেশির ভাগ মানুষ অহমিয়া বা অসমিয়া ভাষায় কথা বলে আর বরাক অববাহিকার প্রধান ভাষা বাংলা। অবিভক্ত বাংলা থেকে দলে দলে বাঙালিরা গিয়ে প্রথমে সেখানে চাষবাস শুরু করলেও যদুরামের দল ক্রমশ দখল করে নিতে থাকে আসাম। এটাই অসমিয়াদের বিশ্বাস। যদুরামদের দেওয়া ফাঁকি অসমিয়াদের তিলে তিলে বিষিয়ে তুলেছে। গরিব বাঙালিরা খেত-খামারে দিনমজুরি আর চাষবাস করে খাজনা আর ধান-চালের ভাগ দিয়ে মুখ বুজে থাকলে কারও কোনো আপত্তি থাকত না, আপত্তি ছিলও না। গরিব চাষাভুষা বাঙালিদের তৈরি জমিনে গিয়ে মধ্যবিত্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং কিছুটা স্বার্থবাদী বাঙালি ব্যবসায়ী আর পেশাজীবীরা ছলে–বলে–কৌশলে ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টা করলে বাধে গোল।

আগের কথা

ব্রিটিশদের রাজধানী কলকাতা থেকে আসাম শাসনের শুরুতেই গলদ বাধায় বোধ করি কোনো বাঙালি বাবু কেরানি—ব্রিটিশরা আসামের জন্য বাংলা ভাষাকেই স্থানীয় মূল ভাষা আর শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বসে। আসামে অসমিয়া ভাষা চালু করতে অনেক বেগ পেতে হয় সেখানকার মানুষের। শেষ পর্যন্ত ১৮৭৩ সালের শেষের দিকে অসমিয়া ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। ১৮৪৬ সালে প্রথম প্রকাশিত আসামের একমাত্র পত্রিকা অরুণোদয় এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

ভারত ভাগের পর শরণার্থীদের একটা চাপ আসামের ওপরও পড়েছিল। তখন আসাম আর মেঘালয় একই রাজ্য ছিল। শরণার্থীর ঢল ঠেকাতেই হোক আর অন্য কোনো কারণেই হোক, ১৯৪৮ সালে বাঙালিদের (হিন্দু বাঙালি) বিরুদ্ধে একতরফা দাঙ্গা শুরু হয় আসামে। গুয়াহাটিতে বাঙালিদের দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। স্বাধীন ভারতে বোধ করি সেটাই ছিল প্রথম বাঙালি খেদাও সহিংস অভিযান। সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল তখন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। নেহরু আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্রের চেষ্টায় সেই আগুন বেশি দূর ছড়াতে পারেনি। তবে বাঙালি হিন্দুরা ক্রমশ নিজেদের বলয় তৈরি করে বসবাসে মনোযোগী হয়। তৎকালীন পাকিস্তান থেকে শরণার্থী আসতে থাকলে এ রকম দাঙ্গা বন্ধ করা যাবে না, কাজেই পাকিস্তানকে সীমান্ত বন্ধ করে দিতে হবে—এমন ধারণা জন্মে প্যাটেলের মধ্যে। তাঁর চাপাচাপিতে নেহরু-লিয়াকত (যথাক্রমে ভারত আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির মূল উদ্দেশ্যগুলো ছিল; ১. দুই দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভয়ভীতি নিরসন। ২. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি। ৩. দুই দেশের মধ্যে এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি, যাতে সব সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে নেওয়া যায়।

চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশ তাদের নিজ দেশের সর্বত্র ধর্মীয় পরিচয়নির্বিশেষে সবাইকে সমান নাগরিক অধিকার দেবে এবং তারা তাদের জীবন সংস্কৃতি, সম্পত্তি ও ব্যক্তিগত মর্যাদা সমুন্নত রেখে বসবাস করতে পারবে। এই চুক্তিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক অধিকার ধর্মচর্চা, বাক্‌স্বাধীনতা, সরকারি ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর চাকরি ইত্যাদির অধিকার খর্ব না করার অঙ্গীকার করা হয়। দুই দেশেই প্রতিষ্ঠিত হয় সংখ্যালঘু কমিশন। ব্যস, এই পর্যন্তই।

বলা বাহুল্য, দুই দেশের কেউ তাদের কথা রাখেনি। আসামের বাঙালভীতি আবার দাঙ্গার রূপ নেয় ১৯৫৬ সালে। রাজ্যের সীমানা পুনর্নির্ধারণ কমিশন তখন গোয়ালপাড়া সরেজমিনে পরিদর্শনে ব্যস্ত ছিল। খতিয়ে দেখছিল জেলাটাকে পশ্চিম বাংলার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া ঠিক হবে কি না। কমিশনের চোখে ধুলা দেওয়ার জন্য এক রাতের মধ্যে ২৫০টি বাংলা স্কুলকে অসমিয়া স্কুলে পরিণত করা হয়। এই দাঙ্গা আটচল্লিশের দাঙ্গার মতো গুয়াহাটিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ছড়িয়ে পড়ে ব্রহ্মপুত্র থেকে বরাক অববাহিকায়। অনেক মানুষ পালিয়ে যায় পশ্চিমবঙ্গের আলীপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, এমনকি অনেক পথ ঘুরে কলকাতায়। ছাপ্পান্নর দাঙ্গার আগুন কিন্তু ধিকি ধিকি জ্বলতেই থাকে বছরের পর বছর। বরাক উপত্যকা ছাড়া অন্য কোনো জায়গায় বাঙালিদের বসবাস সব সময় একটা উত্কণ্ঠার মধ্যেই থেমে থাকে।

২০১৪ সালে মুসলিম হত্যার প্রতিবাদে অল আসাম সংখ্যালঘু সংগঠনের সমাবেশ। ছবি: রয়টার্স
২০১৪ সালে মুসলিম হত্যার প্রতিবাদে অল আসাম সংখ্যালঘু সংগঠনের সমাবেশ। ছবি: রয়টার্স

১৯৬৩ সালে আবার বাধানো হয় দাঙ্গা। এই দাঙ্গা আগের সব নৃশংসতাকে ছাড়িয়ে যায়। কামরূপ জেলার গয়েশ্বর এলাকার ২৫টি গ্রাম অনেকটা এখনকার বর্মি কায়দায় পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হয়। প্রথমবারের মতো আসামের দাঙ্গায় ধর্ষণের আলামত মেলে। উন্মত্ততা সব মাত্রা ছাড়িয়ে যায়—বাঙালিমাত্রই খুন-খারাবির শিকার হতে থাকে। গুয়াহাটির জেলা প্রশাসকের (ডিএম) বাড়ির মধ্যে ঢুকে দাঙ্গাকারীরা তাঁকে ছুরিকাঘাত করে। বাঙালি সে যে পদমর্যাদারই হোক না কেন, গা–ঢাকা না দিলে কেউই রক্ষা পায়নি। খোদ ডিআইজিকে (আসাম পুলিশের দ্বিতীয় প্রধান) পুলিশবেষ্টিত অবস্থায় ছুরিকাঘাত করে দাঙ্গাকারীর দল। এই দাঙ্গায় প্রায় পাঁচ লাখ বাঙালি উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়।

সত্তরের দশক ছিল ভাষা দাঙ্গার দশক। আশির দশকে দাঙ্গাকে ছড়িয়ে দেওয়া হয় একদা আসামের অংশ মেঘালয় রাজ্যে। ইন্ডিয়া অয়েলের প্রধান দপ্তরে বাঙালি প্রকৌশলী রবি মিত্রকে যেভাবে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়, তা মনে পড়লে এখনো তাঁর সহকর্মীরা শিউরে ওঠেন। ১৯৮০ সালে দুর্গাপূজার ঠিক আগে শিলংয়ের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় ঢুকে নির্বাচিত বাঙালি বিধায়ককে খুন করা হয় বাঙালি হওয়ার অপরাধে।

বাঙালিদের ওপর কেন এত রাগ?

আসাম পরিস্থিতি বুঝতে হলে আসামের মানুষের বাঙালি সম্পর্কিত মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে। বাঙালি সংস্কৃতি আর ভাষার আধিপত্য বিস্তারে বাঙালির মনোবাসনা অসমিয়াদের কাছে গোপন থাকেনি। ব্রিটিশদের দিয়ে আসামের শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করার প্রচেষ্টা অসমিয়ারা কোনো দিন ভুলবে না। এ ছাড়া ব্যবসা আর চাকরিতে অগ্রসর বাঙালিদের প্রতি মধ্যবিত্ত আর শিক্ষিত অসমিয়াদের ক্ষোভ সব সময়ই ছিল।

বাঙালি খেদাও এবং ভোটের রাজনীতি

বাঙালিদের দখলে বিধানসভা তথা রাজশাসনের দণ্ড যাতে চলে না যায়, সেই চেষ্টা অসমিয়ারা অন্তর থেকেই করে যাচ্ছে। খেদাতে না পেরে তারা তৈরি করেছে ডি-ভোটের লিস্ট, মানে সন্দেহযুক্ত ভোটার লিস্টে যাঁরা আছেন তাঁরা ভোট দিতে পারবেন না। তাঁদের আসামের সীমানার বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এ রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে একসময় সামনের দিকে এগোতে থাকে আসাম।

প্রথম সন্দেহভাজন ৩ লাখ ৭০ হাজার লোকের মধ্য থেকে শেষ পর্যন্ত ১ লাখ ৯৯ হাজার ৬৩১ জনের নাম ফরেনারস ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হলে মাত্র ৩ হাজার ৬৮৬ জনকে বিদেশি বলে শনাক্ত করা হয়। রাজ্যের আইন অনুযায়ী তাঁদের নিজ নিজ রাজ্যে ফেরত পাঠানোর কথা। এই চক্রে শেষমেশ আটকে যান গরিব দুই ভাই সন্তোষ আর মনতোষ। শিলচরে জন্ম নেওয়া এ দুই ভাই হাইলাকান্দি জেলায় রিকশা চালাতেন। আইনের হাত কতটা লম্বা, তা দেখানোর জন্য আসাম সরকার দুই ভাইকে বিএসএফের হাতে তুলে দেয় বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য। তারপর তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছে কেউ আর বলতে পারে না। পরে এ ধরনের লোক যাতে সমাজে মিশে না যায়, সে জন্য ভারতে আসামই একমাত্র রাজ্য, যেখানে আসাম আদালতের নির্দেশে গোয়ালপাড়া আর কোঁকড়াঝাড়ে খোলা হয়েছে আটক কেন্দ্র। এই আটক কেন্দ্রের জুজুর ভয়ে শঙ্কিত হয়ে কাছাড় জেলার দরিদ্র মজুর অর্জুন নমঃশূদ্র আত্মহত্যা করেন ২০১২ সালের ৮ জুন।

তবে এবার ভোটের রাজনীতিতে অন্য মেরুকরণ, অন্য সমীকরণ কাজ করছে, বিজেপি খেলছে হিন্দু কার্ড। বাঙালি হও আর অন্য কিছু, হিন্দু হলে সব মাফ। তবে মুসলিমদের ঝেঁটিয়ে বের করতে হবে।

এবারের নাগরিক পঞ্জি বা তালিকার আড়ালে মুসলিম খেদাওয়ের ইঙ্গিতটা বেশ স্পষ্ট। অভিযোগ উঠেছে, সাবেক কংগ্রেস নেতা আর সারদা কেলেঙ্কারির অন্যতম অভিযুক্ত সিবিআইয়ের নজরদারিতে থাকা বসন্ত বিসওয়াল নিজেকে রক্ষার জন্য বিজেপির রথে উঠে বসেছেন। আসাম মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি বিসওয়াল মুসলিমবিদ্বেষী বিষ ছড়িয়ে পুরো উত্তর ভারত বিজেপির মুঠোয় নিয়ে আসার এক তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন। নাগরিক পঞ্জির প্রকাশকে দ্রুততর করে কয়েক মাসের মধ্যে একটা চূড়ান্ত রেখা তিনি টানতে চাইছেন।

এর আগে এ ধরনের সব চেষ্টা নস্যাৎ করার কাজে পশ্চিম বাংলা তথা জ্যোতি বসুর সিপিআইএম আর বিধানচন্দ্রের কংগ্রেস একসঙ্গে কাজ করেছে। আসামের বাঙালিদের ভরসাস্থল ছিলেন জ্যোতি বসু। মমতা কি রুখে দাঁড়াতে পারবেন, পশ্চিম বাংলার মুসলিম ভোটারের প্রাণের ডাক কি তাঁর কানে পৌঁছাবে?

গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী। শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।