শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না

বাস্তুচ্যুত শিশুদেরও শিক্ষার অধিকার আছে
বাস্তুচ্যুত শিশুদেরও শিক্ষার অধিকার আছে

আশার শক্তি নিয়ে আমরা সোফিয়া বেগম নামের এক রোহিঙ্গা শিশুর ওপর সমীক্ষা করেছি। মাস তিনেক আগে সশস্ত্র ব্যক্তিরা মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সোফিয়ার গ্রামে হামলা করে। সোফিয়া ওর প্রতিবেশীদের মরতে দেখেছে, ওর চাচা বন্দুকের গুলিতে আহত হয়েছে এবং বাড়ি ভস্মীভূত হয়েছে। বিস্ময়করভাবে সোফিয়া, ওর মা-বাবা ও ছোট দুই ভাই বেঁচে গেছে। চার দিনের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পথ পাড়ি দিয়ে তারা শেষমেশ প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এই পথ পাড়ি দিতে তাদের যেমন সরকারি বাহিনীর চোখ এড়াতে হয়েছে, তেমনি ঝুঁকি নিয়ে নদী পেরোতে হয়েছে। সোফিয়া আমাকে বলল, ‘আমি এখন স্কুলে ফিরে যেতে চাই। বন্ধুদের সঙ্গে পড়া ও খেলার কথা আমার মনে পড়ে; আমি চিকিৎসক হতে চাই।’

তবে সোফিয়ার বাবা মেয়ের ভবিষ্যতের ব্যাপারে অনেক আশাবাদী। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘পড়তে না শিখলে আমার মেয়ে উন্নত জীবন তৈরি করবে কীভাবে। ওর স্কুলে যাওয়া দরকার।’ ইশ্, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি সেটা মনে করত!

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংকট কিন্তু শিক্ষার সংকটও বটে। রাখাইন প্রদেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি রোহিঙ্গা, যাদের সংখ্যা ৬ লাখ ৫৫ হাজারের বেশি, নিজ দেশের সেনাদের হাতে ধর্ষিত, লুণ্ঠিত ও পোড়ার হাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই ঘরছাড়া মানুষদের ৬০ ভাগই শিশু হলেও এদের শিক্ষার যে আয়োজন করা হয়েছে, তা খুবই অপ্রতুল। তাদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক শিশুই স্কুলে গেছে। আর তাদের সর্বজনীন শিক্ষার সমন্বিত পরিকল্পনাও নেই।

এই সংকটের ব্যাপ্তি ও যে দ্রুততার সঙ্গে এটা ঘটেছে, সেটাও সামগ্রিক সংকটের একটি অংশ। ব্যাপারটা এমন হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন শহরের পুরো জনসংখ্যা এক দরিদ্র দেশের আরও দরিদ্র এলাকায় শরণাগত হয়ে এসেছে। যেখানে তাদের শিবির বানানো হয়েছে, তা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার একটি। আর এই মানুষেরা আশ্রয়, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা, পরিষ্কার পানি ও পয়োনিষ্কাশন-সুবিধার জন্য মুখিয়ে আছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এমনিতেই অপ্রতুল, তার মধ্যে শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

রাজনৈতিক বাধাও আমাদের মনে ছাপ ফেলছে। এই সংকট সামাল দিতে বাংলাদেশ সরকার অসাধারণ উদারতা দেখিয়েছে। তারা একদিকে যেমন জমি দিয়েছে, তেমনি অন্যদিকে সীমান্ত খোলা রেখেছে। নতুন অবকাঠামো নির্মাণে সরকার সহযোগিতাও করছে। এই সংকট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সঠিকভাবেই বৈশ্বিক নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এটাও জোর দিয়ে বলছে যে রোহিঙ্গারা তাদের অতিথি এবং তাদের ফিরে যেতে হবে। নভেম্বরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে রোহিঙ্গাদের ‘নিরাপদ ও স্বেচ্ছা’ প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে একটি চুক্তি হয়েছে। তাদের এ বছরের শুরুর দিকেই ফিরিয়ে নেওয়া শুরু করার কথা। বাংলাদেশ সরকারের উদ্বেগ হচ্ছে, এই শরণাগত শিশুদের শিক্ষার সুযোগ দেওয়া হলে এটা মনে করা হতে পারে যে তাদের পাকাপাকিভাবে রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মানবতাবাদী সংস্থাগুলো ছোট ছোট প্রকল্পের মাধ্যমে যতটা সম্ভব, ততটা শিক্ষার আয়োজন করার চেষ্টা করছে।

মিয়ানমারের নাগরিকত্ব না পাওয়ায় রোহিঙ্গাদের পুরো একটি প্রজন্ম শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘের বৈশ্বিক বিশেষ শিক্ষাদূত এ ধরনের মানবিক সংকটে সাধারণভাবে শিক্ষাকে অবহেলা করার রীতির প্রতি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। আর রোহিঙ্গা সংকটের ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত তহবিলের সঙ্গে মানবিক সংস্থাগুলোর বৃহত্তর ব্যর্থতা যুক্ত হয়েছে। তার সঙ্গে আছে দুর্বল সমন্বয়, কারিকুলাম জটিলতা—যদিও কারিকুলামের ব্যাপারটা একরকম দুর্বোধ্য, যার সঙ্গে রোহিঙ্গা শিশুদের ভবিষ্যতের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে।

ফলে এই শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা নেই। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিশুদের শুধু বাস্তুচ্যুতির সঙ্গে লড়তে হচ্ছে না, তাদের নানা রকম মানসিক ধকলও সইতে হচ্ছে। শিশুদের নিরাপদ শিক্ষণমূলক পরিবেশে রাখা গেলে পরিস্থিতি একরকম স্বাভাবিক হয়েছে—এমন বোধ তৈরি হয়। ওই পরিবেশে শিশুরা অভিজ্ঞতা প্রক্রিয়াজাত করতে পারে। এই পরিবেশে সহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধা ও শান্তিপূর্ণভাবে দ্বন্দ্ব নিরসনের মূল্যবোধ সঞ্চার করা যায়।

ব্যাপারটা হলো, শরণার্থী শিশুদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলে তারা উল্লিখিত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। এই পরিস্থিতিতে তারা যেমন ভবিষ্যৎ গড়ে নেওয়ার জন্য দক্ষতা অর্জন করতে পারবে না, তেমনি তাদের ভবিষ্যতের আশা নির্বাপিত হবে। তখন তাদের জঙ্গিদের দলভুক্ত হওয়ার হার বেড়ে যাবে। শরণার্থীশিবিরের আশপাশে যেসব মাদ্রাসা গড়ে উঠছে, তাতে ঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে। এসব নজরদারিহীন মাদ্রাসাগুলো ইসলামি চরমপন্থী মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে পারে। এখন শিক্ষাসংক্রান্ত কৌশল প্রণয়নের ক্ষেত্রে শুরুতেই এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে যে সংকটের শিগগির সমাধান হচ্ছে না। হামলার ব্যাপকতা ও নিরাপত্তার বিশ্বাসযোগ্য নিশ্চয়তা না থাকলে খুব কম রোহিঙ্গাই শিগগির দেশে ফিরে যাবে। বিশ্ব শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে, রোহিঙ্গা শিশুরা একদিকে সরকারের এবং অন্যদিকে শিক্ষার অভাবে শাস্তি পাচ্ছে।

শিক্ষা অধিকার, এমনকি বাস্তুচ্যুত শিশুদেরও শিক্ষার অধিকার আছে। তাদের ভবিষ্যৎ নাগরিকত্ব নিয়ে তর্ক করা মানুষের চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেওয়ার শামিল। বাঁশ দিয়ে কম টাকায় স্কুল বানানো যায়, যেখানে মিয়ানমারের শিক্ষকেরা বর্মি ভাষায় তাদের শিক্ষা দিতে পারেন। এতে যা হবে তা হলো, শিক্ষা তাদের মধ্যে আশার আলো জ্বালবে। অর্থের অভাব নেই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখনই কাজে নামতে হবে। যেসব দেশে শরণার্থী আছে, সেসব দেশের জন্য বিশ্বব্যাংক ২০০ কোটি ডলারের তহবিল গঠন করেছে। এখন সেটা ব্যবহারের সময় এসেছে। বহুজাতিক সংস্থা, যেমন গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর এডুকেশন ও এডুকেশন ক্যাননট ওয়েট প্রভৃতিকে কাজে লাগাতে হবে। দ্বিপক্ষীয় দাতারা এর চেয়ে বেশি করতে পারেন।

সোফিয়ার মতো শিশুরা অনেক যন্ত্রণা সহ্য করেছে। তাদের যে শিক্ষার অধিকার আছে, তা রক্ষায় আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। তাদের আশাহত করা যাবে না।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।

কেভিন ওয়াটকিন্স: সেভ দ্য চিলড্রেন ইউকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।