নির্বাচনের হিসাব ও সম্ভাব্য ট্র্যাজেডি

আগামী এক বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন। স্বভাবতই এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। তবে এ পর্যায়ে নির্বাচনে কোন দল বিজয়ী হবে, তার চেয়েও বেশি ভাবা হচ্ছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, সেই বিষয়টি। বিএনপির জন্য পরিস্থিতি একটু কঠিন, ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন যে তাদের ভুল ছিল, সে বিষয়ে মোটামুটি সবাই একমত। কিন্তু সেই মূল্যায়ন মেনে এবার সে ভুল শুধরে নিলেই হলো—পরিস্থিতি তাদের জন্য তেমন সরল নয়। প্রথমত, তাদের গতবার নির্বাচন বর্জনের অজুহাত এবং এবারও তত্ত্বাবধায়ক বা সহায়ক সরকারের আন্দোলন কিংবা অন্যভাবে বলা যায়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার যে যুক্তি ও জেদ, তাতে সামান্যতম ছাড় ব্যতীত নির্বাচনে যাওয়ার মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক পরাজয়ের একটা বোধ নেতা-কর্মীদের মধ্যে কাজ করবে। অর্থাৎ এ যেন হবে নির্বাচনের আগেই ওয়ার্মআপ ম্যাচে পরাজয় দিয়ে শুরু করা। অবশ্য খেলায় ওয়ার্মআপ ম্যাচে হেরেও মূল খেলায় জেতার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে, বিএনপি সেটা ভাবতে পারে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ আদৌ চায় কি না বিএনপি নির্বাচনে আসুক। চলমান মামলায় বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ভাগ্যে কী ঘটে, তার ওপরও তাদের সিদ্ধান্ত অনেকাংশে নির্ভর করবে। বিএনপি এখনই একটু মাঠ গরম করা ও রাখার চেষ্টা করছে। মাঠের আন্দোলন দিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি ও কিছু দাবি আদায় এবং বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের শাস্তি ঠেকানো তাদের লক্ষ্য। তবে সরকার বিএনপির নেতা-কর্মীদের মাঝেমধ্যে মাঠে নামার সুযোগ দিলেও নির্বাচন পর্যন্ত বরাবর এমন মনোভাব দেখাবে বলে মনে হয় না। ৫ জানুয়ারির কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সরকারের এই মনোভাব ভালোভাবেই বুঝেছেন। তাঁরা কি আওয়ামী লীগের মতো সরকারের দমন-পীড়নকে অগ্রাহ্য করে মাঠে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারবেন? এটাই বিএনপির সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা, তাদের নেতা-কর্মীরা এভাবে আন্দোলন-সংগ্রামে অভ্যস্ত নন।

তা ছাড়া গত নয় বছরে দেশের কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। প্রথমত, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন এই সরকার বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে শাস্তি কার্যকর করতে সক্ষম হয়েছে, যাদের বিএনপি কেবল ক্ষমতায়ন করেনি, সরকার গঠনে অংশীদার করেছিল। এ বিষয়ে জনমত যে আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে, তার প্রমাণ মিলেছে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময়। এখান থেকে বাংলাদেশকে আবার ১৯৭৫-৯৫ পর্বে ফিরিয়ে নেওয়া একটু কঠিনই হবে। দ্বিতীয়ত, বিগত নয় বছরের মধ্যে অন্তত আট বছর দেশে আন্দোলন-সংগ্রাম ছিল না, এমনকি বিরোধী দলবিহীন নিষ্প্রাণ সংসদেও কোনো উত্তেজনা ছিল না। কিন্তু এর মধ্যে দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজ ধারাবাহিকভাবে এগিয়েছে। অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোর উন্নয়নের ছাপ রাজধানী ও মফস্বলে দৃশ্যমান এখন। এ ছাড়া নগরে ও গ্রামে, কৃষি ও শিল্প খাতে, জিডিপি ও মাথাপিছু আয় ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই অগ্রগতি পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়।

তৃতীয়ত, এই নয় বছরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে শেখ হাসিনার ভাবমূর্তির যে বিকাশ ঘটেছে, তা তাঁকে দলীয় নেত্রী থেকে একজন রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদা দিয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহ মোকাবিলা দিয়ে তাঁর এই উত্তরণ শুরু হয়, যা তাঁর মধ্যে নবপর্যায়ের নেতৃত্বের সূচনা করে। সর্বশেষ রোহিঙ্গা সমস্যায় মানবিক ভূমিকা আন্তর্জাতিকভাবে তাঁর ভাবমূর্তি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের সংকট বাংলাদেশের মোকাবিলায় তাঁর ধৈর্য, দূরদর্শিতা ও সাহস প্রমাণ করেছে, শেখ হাসিনার দেশপ্রেম কেবল ভাবাবেগ নয়, এর মধ্যে মর্যাদাবোধ রয়েছে, যা বিশ্বব্যাংকসহ উন্নত পশ্চিমের ঔদ্ধত্যকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দিয়েছে তাঁকে।

চতুর্থত, জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সরকারের শূন্য-সহিষ্ণুতার নীতি সত্যিই মুসলিমপ্রধান এই দেশে সংকটটিকে তীব্র হতে দেয়নি। তা ছাড়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ কখনোই পাকিস্তানের মতো কোনো ধরনের জঙ্গিকে গোপন প্রশ্রয় দেয়নি বা কোনো ছাড় দিয়ে এ ক্ষেত্রে দ্বিচারিতা করেনি। যেহেতু আজকের দিনে সারা বিশ্বে এটি প্রকট ও প্রধান সংকটরূপে বিবেচিত হচ্ছে, তাই এতে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার আন্তর্জাতিক সমর্থনও পাচ্ছে।

এই সব অর্জনের বিপরীতে বলাই যাবে আইনের শাসন, মানবাধিকার বাস্তবায়ন ও সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে এবং বেড়েছে। সাম্প্রতিক কালে গুম ও খুন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দমন-পীড়ন যে হারে বেড়েছে, তার দায় সরকার এড়াতে পারে না। সোজা ভাষায় বলা যায়, আমরা একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার ও অনুদার গণতন্ত্রের ধারায় আটকে গেছি। এখন এ থেকে উত্তরণই আমাদের গণতন্ত্র ও সরকারব্যবস্থার সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সেই সঙ্গে বলতে হবে, এ অবস্থার জন্য বিএনপি কিংবা নাগরিক সমাজ কেবল আওয়ামী লীগ ও তার শরিকদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারকে দায়ী করেই পার পাবে না। কেননা, এ পরিণতির দায় তারা একেবারে এড়াতে পারে না।

গত আট বছরে আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজা ভোগকারী ব্যক্তি ও তাদের দল সম্পর্কে বিএনপি এখনো দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করেনি। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের জামায়াত, পাকিস্তান ও সৌদিপ্রীতি মোটামুটি পরিষ্কার। আর অতিসম্প্রতি আগামী নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠনের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বিএনপির মহাসচিব যেভাবে এড়িয়ে যাওয়া উত্তর দিলেন, তাতেও স্পষ্ট যে নির্বাচনে তারা গতবারের হিসাব মাথায় রেখেই চলতে চায়। সে ক্ষেত্রে স্বভাবতই আশঙ্কা তৈরি হয় যে বিএনপি ও তাদের জোট ক্ষমতায় এলে আবারও ১৯৭৫-৯৫ ও ২০০১-০৬-এর পরিস্থিতি ফিরে আসবে, যাকে সহজ ভাষায় পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক ধারায় রাষ্ট্রের প্রত্যাবর্তন বলা যায়। এ পরিস্থিতিতে দেশ আবার ফিরে যাক, তা এ দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ চায় না।

তবে ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল বজায় রাখতে গিয়ে আওয়ামী লীগ কেবল যে অনুদার গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদী সরকার চালাচ্ছে তা নয়, রাজনীতিতে আরও কিছু পরিবর্তন আমরা লক্ষ করছি, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গঠনে বাধাস্বরূপ। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী রাজনীতিতে এসে ১৯৯১-এর প্রচারণাতেই ধর্মকে রাজনীতি ও প্রচারণার অবিচ্ছেদ্য অংশ করে নিয়েছিল, যা উত্তরোত্তর বেড়ে স্থায়িত্ব পেয়েছে। এ ছাড়া এবার প্রতিপক্ষ জামায়াত ও বিএনপির লোকজনকে ব্যাপকভাবে দলে গ্রহণ করে যেন নিজের দলেরই এক দেহে সর্বদলীয় তকমা এঁটে দিতে চাইছে। এই প্রক্রিয়া চালাতে গিয়ে আওয়ামী লীগকে রাজনীতিচর্চা বা আদর্শের ভাবনা ত্যাগ করতে হয়েছে, এখন সরকারের চাপে ও প্রাধান্যে দল আওয়ামী লীগ আদতে নিষ্ক্রিয়। স্থানীয় পর্যায়ে নেতা-কর্মীরা অবাধে ক্ষমতার প্রসাদ লুফে ও লুটে নিতে ব্যস্ত। টেন্ডারবাজি ও দখলদারিকে ঘিরে বেপরোয়া সংঘাত, খুন-জখম এরই প্রতিফলন। আর রাজনীতিকে চাপা দিয়ে এবং বিশৃঙ্খল-উচ্ছৃঙ্খল কর্মীদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার দিনে দিনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা এবং আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এসবই একটি গণতান্ত্রিক সরকার, বিশেষত আওয়ামী লীগের মতো সংগ্রামের ঐতিহ্যধন্য দলের কাছ থেকে কাম্য ছিল না।

মনে হচ্ছে, সরকার প্রতিপক্ষ সামলানো ও ক্ষমতা ধরে রাখার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে সমাজের গণতান্ত্রিক বিকাশের মতো ভবিষ্যৎমুখী গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে একদমই আমলে নিচ্ছে না। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি দলের নামে প্রচুর অনাচার হচ্ছে, ভুক্তভোগী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, আবার অপরাধীরা সহজেই সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে পারও পেয়ে যাচ্ছে। মনে রাখা দরকার, ভোটের সময় পদ্মা সেতু বা বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাফল্য ততটা ভোট টানবে না, ভোটে বিচার্য হবে স্থানীয় পর্যায়ে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি। সেখানে সরকার বেতন বাড়িয়ে বা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রেখে যে স্বস্তি দিচ্ছে, তা মাস্তান ও ঠ্যাঙারে বাহিনী নষ্ট করে দিচ্ছে।

আওয়ামী লীগের শাসনে গত নয় বছরে দেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে এগিয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই চমকপ্রদ অর্জন রয়েছে। কিন্তু সমাজমানস, শিক্ষার মান, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা, সৃজনশীল ও মননশীল চিন্তা–চেতনা ইত্যাদিতে অনেক পিছিয়েছে। মুশকিল হলো, এর প্রতিকার চেয়ে বিএনপির দিকে চোখ ফেরানোরও উপায় নেই। ফলে আওয়ামী লীগকেই তার ভুলভ্রান্তিগুলো দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। নির্বাচনের যেহেতু আর মাত্র বছরখানেক সময় রয়েছে, তাই এই সময়ের মধ্যেই পরিবর্তনের সূচনাগুলো দৃশ্যমান করতে হবে। কারণ, সামনের নির্বাচনকে অবশ্যই গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করতে হবে। তবে দলগুলোর আশায় বসে না থেকে এ দেশে নাগরিক সমাজকেই গণতন্ত্রের সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়ার কাজে সক্রিয় হতে হবে। নয়তো রাজনীতির পশ্চাদ্‌যাত্রা অব্যাহত থাকবে। যুদ্ধাপরাধী বা একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমাজ সমৃদ্ধ এবং রাষ্ট্র পরিচালিত হবে না। এই ট্র্যাজেডি বাংলাদেশে ঘটুক, তা আমরা চাইতে পারি না।

আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।