বিএনপির জটিল হিসাব-নিকাশ

এ বছরকে সবাই বলছেন নির্বাচনের বছর। গত নির্বাচন ও বর্তমান সরকারের মেয়াদের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে নির্বাচনের তারিখটি আগামী বছরের শুরুতেও হতে পারে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে যা কিছু হওয়ার, তা এ বছরই ঠিক হয়ে যাবে। ফলে এটা নির্বাচনের বছরই। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল অবশ্য একে ‘বিএনপির বছর’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিএনপির নেতা যে বিবেচনা থেকে তা বলেছেন, সেটা কতটুকু সত্য হবে, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে এই নির্বাচনের বছরের সবচেয়ে বড় কৌতূহল ও দামি প্রশ্নটির সঙ্গে যে বিএনপি জড়িয়ে আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিএনপি কি আগামী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে?

বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সেদিন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে বলেছেন, ‘নির্বাচন করব, বাইরে রাখা যাবে না।’ এত স্পষ্ট ঘোষণার পর বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে কোনো সংশয় থাকার কথা নয়। তবে খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যের শেষে একটি ‘কিন্তু’ আছে। তিনি বা তাঁর দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে ঠিকই, তবে তা হতে হবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে, শেখ হাসিনার অধীনে নয়।

এর পরপরই আওয়ামী লীগের নেতা ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের মুখে শুনলাম খুবই আত্মবিশ্বাসী এক বক্তব্য। প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘ডায়েরিতে টুকে রাখুন, বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনেই নির্বাচন করবেন।’ পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমে যাঁরা দেশের রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করেন বা বক্তব্য দেন, এমন সবারই ধারণা যে বিএনপি এবারের নির্বাচনে অংশ নেবে। এই ধারণার পেছনে কিছু যৌক্তিক কারণ আছে। রাজনীতির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সাধারণত বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা, অতীতের অভিজ্ঞতা এবং সম্ভাব্য পরিণতিগুলো বিবেচনায় নেওয়া। কিন্তু এরপরও এগুলো সবই অনুমান।

বিএনপি কেন নির্বাচনে যাবে বা যেতে পারে, তা অনুমান করা খুব সহজ। গত নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি কোনো ফল পায়নি। নির্বাচন তারা ঠেকাতে পারেনি বা সেই শক্তি-সামর্থ্য যে দলটির নেই, তা পরিষ্কার হয়েছে। যে ধরনের একতরফা নির্বাচন হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি, তাতে অনেকেই ধরে নিয়েছিল যে এমন নির্বাচন করে সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারবে না। এমনকি শুরুতে আওয়ামী লীগও ওই নির্বাচনকে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন হিসেবে উল্লেখ করেছিল। কিন্তু বিশ্লেষকদের সব অনুমান ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিজয়ী দল সরকার পরিচালনার পরবর্তী চার বছর পূর্ণ করে ফেলেছে।

গত চার বছরের হিসাব-নিকাশে বিএনপির লোকসানের পাল্লাটা দিনে দিনে ভারী হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেওয়াটা যদি বিএনপির ভুল রাজনৈতিক কৌশল হয়ে থাকে, তবে সেই নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে আন্দোলনের নামে যানবাহনে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার কৌশল ছিল সর্বনাশা ভুল। তবে অনেক বিশ্লেষক এমনও মনে করেন যে আওয়ামী লীগও চায়নি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিক এবং সেই ফাঁদে দলটি পা দিয়েছিল। বিএনপি এবার আর সেই ভুল করবে না।

ক্ষমতার বাইরে এমনকি সংসদে ‘বিরোধী দলের’ ভূমিকায়ও না থাকার করণে রাজনৈতিকভাবে দলটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। গত চার বছরে দলটি এবং এর প্রধানের প্রতি সরকার যে আচরণ করেছে, বিএনপি সংসদে থাকলে বা খালেদা জিয়া বিরোধীদলীয় নেতা হলে এতটা হয়তো সম্ভব হতো না। এসব বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া ছাড়া বিএনপির সামনে আর পথ কী? ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে তাদের হারিয়ে দেওয়া হতে পারে—বিএনপির মধ্যে এমন বিশ্বাস জোরালো হলেও দলটি নির্বাচনে যেতে বাধ্য হবে বলেই অনেকে বিশ্বাস করেন। আগামী নির্বাচন বর্জন দল ভাঙার ঝুঁকির মধ্যেও ফেলতে পারে বিএনপিকে—এমন আশঙ্কা করেন অনেকে।

আওয়ামী লীগের এখন পর্যন্ত যা অবস্থান, তাতে এটা পরিষ্কার যে বিএনপির দাবি অনুযায়ী ‘নিরপেক্ষ’ ধরনের কোনো সরকার তো দূরের কথা, গতবার আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলেছিল, এবার সে ধরনের কিছু প্রস্তাব করবে কি না, সে ব্যাপারেও সন্দেহ রয়েছে। ফলে বিএনপিকে যদি নির্বাচনে যেতে হয়, তবে অনেকটা নিঃশর্তভাবেই যেতে হবে। আওয়ামী লীগ যাকে ‘নাকে খত দেওয়া’ হিসেবে বিবেচনা করতে চায়।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিয়ে দলটি আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় টিকে থাকাকে ঠেকাতে পারেনি। কিন্তু যা পেরেছে তা হচ্ছে নির্বাচনকে বিতর্কিত করা। বিএনপি সামনের নির্বাচনে অংশ নিলে নির্বাচনটি দেশি-বিদেশি নানা মহলের চাওয়া অনুয়ায়ী ‘অংশগ্রহণমূলক’ হবে এবং আরেকটি ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন থেকে মুক্তি মিলবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি যদি মনে করে যে আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচনে তাদের জিততে দেওয়া হবে না, তাহলে তারা সেই নির্বাচনে যাবে কেন? আগামী নির্বাচনকে ‘গ্রহণযোগ্যতা’ দিতে? বিনিময়ে কী পাবে দলটি? সংসদে প্রধান বিরোধী দলের সম্মান এবং খালেদা জিয়ার প্রধান বিরোধীদলীয় নেতার মর্যাদা?

বর্তমান বাস্তবতায় এই প্রাপ্তিকে যদি বিএনপি যথেষ্ট মনে করে, তবে দলটির নির্বাচনে যাওয়ারই কথা। কিন্তু দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার মুখে আমরা ক্রমাগতই শুনে আসছি যে বর্তমান সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা যাবে না। এই পরিস্থিতিতে জরুরি প্রশ্নটি হচ্ছে; এমন দাবি আদায় করার কোনো শক্তি-সামর্থ্য কি বিএনপির আছে? এ ধরনের কিছু আদায় না করে নির্বাচনে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে আওয়ামী লীগের চাওয়া অনুযায়ী ‘নাকে খত দিয়ে’ নির্বাচনে যাওয়া।

আবার বিএনপি যদি এবারও নির্বাচনে না যায়, তবে সেটা আওয়ামী লীগের জন্য স্বস্তিদায়কও হতে পারে। নির্বাচনে জেতা বা ক্ষমতায় থেকে যাওয়া নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা কেটে যাবে। তবে সেই নির্বাচনে যাতে ৫ জানুয়ারির মতো ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে না হয়, সেই উদ্যোগ নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের থাকবে। কারণ, গত নির্বাচনের মতো একতরফা নির্বাচন দলটি আরেকবার করতে চাইবে না। বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক’ করার কৌশল বের করা দলটির জন্য কঠিন কিছু হবে না। নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন দল বা জোট গঠন অথবা কোনো দলে ভাঙন—এসব নানা কিছুই ঘটতে পারে। আর আওয়ামী লীগ তখন জোরের সঙ্গে এটা বলতে পারবে যে বিএনপি আসলে নির্বাচনমুখী দল নয়, নির্বাচনকে ভয় পায়।

বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা বর্জন কোনোটাই বিএনপিকে তেমন রাজনৈতিক ফায়দা দেবে না। তবে রাজনীতিতে খুব নিশ্চিত করে কিছু বলা আসলেই খুব কঠিন। আমরা শুধু অনুমানভিত্তিক নানা বিচার–বিশ্লেষণ করতে পারি। কিন্তু এটা অন্তত নিশ্চিত করেই বলা যাচ্ছে যে নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা না নেওয়ার হিসাব-নিকাশটি বিএনপির জন্য বড়ই কঠিন ও জটিল।  

এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।