ইরানের নীতি বদলাতে হবে

জিওফ্রে হুন
জিওফ্রে হুন

ইরানের সাম্প্রতিক প্রতিবাদ আন্দোলনের সবচেয়ে অসাধারণ দিকটা হলো, এই আন্দোলন যাঁরা শুরু করেছিলেন, তা খুব সম্ভব তাঁদের বিরুদ্ধেই গেল। ২০০৯ সালের গ্রিন মুভমেন্টের পর এটাই ইরানের সবচেয়ে বড় আন্দোলন। ইরানের অতিরক্ষণশীল ধর্মনেতারা ভেবেছিলেন, দেশটির রাজধানীতে অর্থনীতি নিয়ে মানুষের বিক্ষোভ উসকে দিয়ে তাঁরা মধ্যপন্থী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির কর্তৃত্ব খাটো করবেন। কিন্তু ব্যাপারটি যদি সেটাই হয়, তাহলে বলতে হয়, বিদ্যমান ব্যবস্থা নিয়ে ইরানের মানুষের ক্ষোভটা ঠিক কোন পর্যায়ের, সেটা তাঁরা বুঝতে পারেননি, বিশেষ করে সেখানে তাঁদের ভূমিকা কী।

আরও পরিষ্কারভাবে বললে, প্রতিবাদ আন্দোলন যত বড়ই হোক না কেন, তাতে সরকারের পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী খুবই শক্তিশালী, বিদ্যমান ব্যবস্থায় তাদের অংশীদারত্বও কম নয়। এতে তারা ইরানের অর্থনীতির বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে।

এ ছাড়া আন্দোলনকারীদের নেতা নেই, নেই পরিষ্কার উদ্দেশ্য। পশ্চিমা শক্তিগুলো তাঁদের যতই উৎসাহ দিক না কেন, এটা পরিষ্কার যে আর যা-ই ঘটুক না কেন, ইসলামি চরমপন্থীরা ক্ষমতার ভিত্তি ধরে রাখবে বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও নিরাপত্তা কার্যক্রমের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করবে-এমনটা হবে না। তার মানে কিন্তু এই নয় যে কোনো কিছুই বদলাবে না। আবার তার মানে এ-ও নয় যে কাজে লাগানোর মতো পশ্চিমাদের হাতে কিছু নেই।

উদাহরণস্বরূপ এটাও হতে পারে যে রুহানি হয়তো শেষমেশ স্বেচ্ছায় বা জোরপূর্বক পদত্যাগ করবেন। কিন্তু প্রতিবাদকারীদের কাছে এটা তেমন একটা সফলতা হিসেবে বিবেচ্য হবে না। সর্বোপরি রুহানি সম্ভবত একজন মধ্যপন্থী প্রশাসক। কিন্তু দেশটির ধর্মীয় নেতারা মনে করেন, দেশটির সংবিধান জাগতিকতার প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। সরকারের ধর্মীয় পবিত্রতা এবং তার অসদুপায়ে অর্জিত অর্থ রক্ষায় যদি নিজের জনগণকে পাশবিকভাবে নিপীড়ন এবং দেশকে মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিতে হয়, তাহলে চরমপন্থীরা স্বেচ্ছায় তা করবে।

রুহানি পদত্যাগ করুন আর না-ই করুন, এটা এখন পরিষ্কার যে এই পরিস্থিতি চিরকাল চলতে পারে না। সম্ভবত খুব বেশি দিন তা চলবেও না। ইরানিদের বলা হয়েছিল, ২০১৫ সালে যে পারমাণবিক চুক্তি করা হয়েছিল, সেটা তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে বের করে আনবে। কিন্তু ধারাবাহিক দুর্নীতির কারণে অনেক কিছু ঘটে গেল, তাদের বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে এবং তরুণদের বেকারত্ব দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশ। বলা বাহুল্য, বৈশ্বিক দুর্নীতির সূচকে ইরানের স্থান নিচের দিকে। গ্যালাপ জরিপ অনুসারে, শুধু ইরাক ও দক্ষিণ সুদানের জনগণ নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ইরানিদের চেয়ে বেশি হতাশ।

রুহানি এখন পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ইরানে সংস্কার শুরু করেননি বা তা করতে অপারগ। কিন্তু এই প্রতিবাদের মাঝে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির উত্তরণে তিনি আগের চেয়ে বেশি উৎসাহী। তিনি যদি ব্যর্থ হন, তাহলে আরও শক্তিশালী নেতৃত্বে ও পরিষ্কার লক্ষ্যে ইরানে দীর্ঘকাল প্রতিবাদ আন্দোলন হতে পারে।

এখন কথা হচ্ছে, ইরানের অর্থনৈতিক সংস্কারের আগে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে দেশটির সম্প্রসারণশীল পররাষ্ট্রনীতি অযৌক্তিকভাবে ব্যয়বহুল। ইয়েমেনে প্রক্সি যুদ্ধ চালানো, লেবাননে রাজনৈতিক দল ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরি এবং সিরিয়া ও ইরাকে আধিপত্য বজায় রাখতে গিয়ে তার বছরে শত শত কোটি ডলার খরচ হচ্ছে। ফলে বিক্ষোভকারীরা যখন স্লোগান দেন, ‘সিরিয়া থেকে বেরিয়ে আমাদের কথা ভাবুন’, তখন বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।

শুধু যে ইরানের জনগণ দেশের পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে আপত্তি জানাচ্ছে, তা নয়। অধিকাংশ পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানের ব্যাপারে খুবই উদ্বিগ্ন। এটা জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি অশ্রদ্ধা, যা আন্তর্জাতিক রীতির পরিপন্থী। আর ইরান যে যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় দেশগুলো ধ্বংস করে দেওয়ার প্রকাশ্য হুমকি দিচ্ছে, তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।

ইরানের এই সমস্যাজনক পররাষ্ট্রনীতি অব্যবস্থাপনার ফসল নয়, এটা বিষাক্ত আদর্শ। বস্তুত, এর পেছনে দুটি আপ্ত ধারণা আছে। প্রথমত, ইরানের নেতারা এ ব্যাপারে প্রত্যয়ী যে বৈশ্বিক ভূরাজনীতি জিরো সাম গেম, অর্থাৎ যে খেলায় একজন ঠিক ততটাই জেতে, আরেকজন ঠিক যতটা হারে; রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও তা-ই মনে করেন। দ্বিতীয়ত বা আরও বিপজ্জনক ব্যাপার হলো, ইরানের নেতারা বিশ্বাস করেন, পৃথিবীর শিয়া মুসলমানদের একত্র করাটা তাঁদের সৃষ্টিকর্তা-প্রদত্ত অধিকার। এর ফল হলো এক দেশে এক বৈরী সরকারের ক্ষমতা লাভ, যারা প্রতিবেশীর সফলতা হুমকি হিসেবে দেখে। এমনকি তারা যুদ্ধ বাধাতেও প্রস্তুত।

ব্যাপারটা হলো, গত কয়েক দশকে দেশটি মধ্যপ্রাচ্যে যে অগ্রগামী অবস্থান অর্জন করেছে, সেটা তারা ছাড়তে রাজি হবে না। কট্টরপন্থীরা এটিকে জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। চলমান প্রতিবাদের মুখেও পশ্চিমের হাতে সুযোগ আছে তারা ইরানকে আঞ্চলিক রাজনীতির উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছাড়তে বাধ্য করাতে পারে। ঐকমত্য হলে ইরানের ওপর বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হতে পারে। ইরানের নেতারা যদি ছাড় দিতে রাজি না হন, তাহলে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে।

নিশ্চিতভাবে ধর্মীয় চরমপন্থীরা যদি ইরানের সরকারের সব স্তরের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়, তাহলে অর্থনৈতিক সংস্কার ভেস্তে যাবে। কিন্তু রুহানি ক্ষমতায় থাকলে বা তাঁর জায়গায় আরেকজন মধ্যপন্থী ক্ষমতায় এলে দেশটির রোমাঞ্চকর পররাষ্ট্রনীতিতে ছেদ পড়তে পারে। এতে ইরানে ব্যাপক সহিংসতার আশঙ্কা কমে আসবে। অন্যদিকে ধর্মীয় চরমপন্থার বিরোধী শক্তি দানা বেঁধে উঠবে।

ইরান এক ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীর এখনই ইরান সরকারের প্রতি পরিষ্কার বার্তা পাঠানো উচিত, মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে না তুলে নিজের জনগণের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করা উচিত।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত।

জিওফ্রি হুন: যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী।