যশোর রোডের আদিপ্রাণ বাঁচাও!

যিনি গাছ বাঁচিয়ে রাস্তা বানানোর রাস্তা খুঁজে পান না, তিনি আবার কেমন ইঞ্জিনিয়ার?
যিনি গাছ বাঁচিয়ে রাস্তা বানানোর রাস্তা খুঁজে পান না, তিনি আবার কেমন ইঞ্জিনিয়ার?

গাছখেকোদের এবার নজর পড়েছে প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো মহাশিরীষ শোভিত ঐতিহাসিক যশোর রোডের গাছের ওপর। দেশের আর কোথাও এমন দীর্ঘ ছায়ানিবিড় শিরীষসারি অবশিষ্ট নেই। বনখেকোরা কীভাবে এ দেশে বন সাবাড় করেছে, সে ইতিহাস এ দেশের সবার জানা। প্রকৃতি বিনাশে অতি উৎসাহীরা উন্নয়নের মহাসড়কে তোলার স্বপ্ন দেখিয়ে এবার যশোর-বেনাপোল সড়কের শেষ গাছগুলো গিলতে চায়। সে জন্য সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে তারা। প্রকল্প অনুমোদনের কাজ শেষ। মহারথীরা একযোগে তাতে সম্মতিও জানিয়েছেন। দেশে নেতৃত্ব দেওয়ার দায় যাঁদের, তাঁরা জনগণের মতামতের তোয়াক্কা করেন না; তাঁদের আসল উপদেষ্টা অসৎ কর্মচারীরা। বাংলাদেশ আলো করে আছেন এমন মহাক্ষমতাধর কর্তারা।


তাঁরা এমন এক প্রকল্প বানিয়েছেন, যা বাস্তবায়নে নাকি গাছ নিধনের কোনো বিকল্প নেই। সে কথা জানতে পেরে নিসর্গী ও প্রকৃতিবাদী লেখক বিপ্রদাস বড়ুয়া যথার্থ মন্তব্য করেছেন, যিনি গাছ বাঁচিয়ে রাস্তা বানানোর রাস্তা খুঁজে পান না, তিনি আবার কেমন ইঞ্জিনিয়ার? একেবারে দেশের মানুষের প্রাণের কথাটি বলেছেন তিনি। জাপানে একটি গাছ রক্ষার জন্য তারা কত-কী না করে! প্রতিটি বৃক্ষ যে একেকটি মহাপ্রাণ! এ কথার অর্থ যিনি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ, তাঁর মুখেই কেবল শোভা পায়, গাছ না কেটে যশোর-বেনাপোল রাস্তা চার লেন করা অসম্ভব।

আমরা চার লেন নয়, যশোর-বেনাপোল রোডকে দেখতে চাই ছয় লেন হিসেবে। কেননা, এটি এশিয়া মহাদেশীয় মহাসড়কের বাংলাদেশে অংশের প্রবেশদ্বার। আর সে পরিমাণ জমিও এ সড়কের দুপাশে আছে। সরকারের জমি। দরকার শুধু তা কাজে লাগানো।

যশোর-বেনাপোল সড়কটির ঐতিহাসিক অবদান প্রভূত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করেন কালীপদ পোদ্দার নামের যশোরের এক জমিদার। এই রাস্তা ব্যবহার শান্তিময় করার উদ্দেশ্যে তিনি শত শত দ্রুতবর্ধনশীল, ছায়াদানকারী মহাশিরীষ বা রেইন ট্রি লাগান রাস্তার দুপাশে। রাস্তাটি যশোর থেকে কলকাতা পর্যন্ত গেছে। বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে হরিদাসপুর থেকে কলকাতা পর্যন্ত এখনো তার পরিচিতি যশোর রোড নামেই। আমরা অবশ্য সে নাম ঘুচিয়ে দিয়েছি বহু আগেই। সেটা করেছি আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা এবং জ্ঞানের অভাব থেকে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক অপচিন্তা আর এই রাস্তা থেকে কালীপদ পোদ্দারের নাম-নিশানা মুছে ফেলার হীন চক্রান্ত। তবু গত শতকের শেষ পর্যন্ত যশোরের মানুষের কাছে এ রাস্তা কালীবাবুর রাস্তা বলেই পরিচিত ছিল। আর তখন পর্যন্ত ছত্রাকৃতি নির্মিত ক্যানোপি মুগ্ধ করত দর্শনার্থী কিংবা পথচারীদের। বহুদূর থেকে এই রাস্তার সৌন্দর্য উপভোগ করত মানুষ। নবীন প্রজন্মের কাছে হারিয়ে যাচ্ছে যেমন কালীপদ পোদ্দারের নাম, তেমনি তার সরকারি নাম যশোর রোডও।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একশ্রেণির মানুষ সবকিছু লোপাট করা শুরু করে। সে লোপাটের প্রথম বলি রাস্তার দুপাশের গাছপালা। গাছ কাটার মহোৎসব হয় এরশাদবিরোধী লাগাতার হরতালের সুযোগে। বিশাল বিশাল বৃক্ষ কর্তন ও লোপাটের এমন সুযোগ আর কখনো আসেনি। বিশ্বাস না হলে যশোর-বেনাপোল, যশোর-কুষ্টিয়া, যশোর-খুলনা কালিগঞ্জ-চুয়াডাঙ্গা বা ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর ইত্যাদি মহাসড়কগুলো ভালো করে দেখে নিতে পারেন। এই লোপাটে শরিক রাজনীতিক, আমলা, সড়ক ও বন বিভাগ আর পুলিশ বাহাদুরেরা। এবারও এই দঙ্গলই এক হয়েছে; তবে গায়ে উন্নয়নের নামাবলি।

যশোর রোড আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসের অপরিহার্য অংশ। স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরু থেকেই এই রোড ধরে ভারতীয় তো বটেই, বিশ্বের নানান দেশের, এমনকি বাংলাদেশের সাংবাদিকরাও এই পথে এসে স্বাধীনতাসংগ্রামের খবর সংগ্রহ করতেন। কলকাতার সঙ্গে সবচেয়ে সহজ যোগাযোগের মাধ্যম এই যশোর রোড। এই রাস্তা ধরে হাজার হাজার গৃহহারা মানুষ পাড়ি দেয় ভারতে। এই রাস্তা ধরেই বিদেশি রাজনীতিকেরা এসেছেন বাংলাদেশের লাখ লাখÿউদ্বাস্তুর অবর্ণনীয় দুঃখের ভাগীদার হতে। এই রাস্তা নিয়েই অ্যালেন গিন্সবার্গ রচনা করেন ভুবনজয়ী, হৃদয়স্পর্শী ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতা। সেটিই নোবেলজয়ী গায়ক বব ডিলানের কণ্ঠে বিখ্যাত কনসার্ট হয়ে সারা আমেরিকায় বাংলাদেশের প‌ক্ষেÿজনমত গঠনে সহায়তা করে। এই যশোর রোড ধরেই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য, সংসদ সদস্য, শত শত মুক্তিযোদ্ধা, দেশ-বিদেশের শত শত সাংবাদিক এসে ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর দেশের প্রথম মুক্ত জেলা শহর যশোরে জনসভা করেন। সে সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল যশোর রোডের গায়ে যশোর টাউন হল ময়দানে। এমন একটি ঐতিহাসিক সড়কের গুরুত্ব অনুধাবনে যারা ব্যর্থ, তাদের জন্য সত্যিই করুণা হয়।

আমরা জানি এবং দাবি করি, যশোর-বেনাপোল সড়ককে চার লেন কেন ছয় লেনে উন্নীত করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি জমিও রাস্তার দুপাশেই রয়েছে। এই শতকের গোড়ার দিকে যশোর-বেনাপোল অংশে রাস্তার দুপাশ থেকে জবরদখলকারীদের উৎখাত করা হয়েছিল। শুধু ঝিকরগাছা বাজারে কপোতা‌ক্ষের এপার-ওপার মিলে এক কিলোমিটার মতো রাস্তার দুপাশ দখলমুক্ত করা যায়নি। তবে ঝিকরগাছা ও নোয়াপাড়ায় বিকল্প, অর্থাৎ ডাইভারশন রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা দীর্ঘকালযাবৎ ফাইলবন্দী অবস্থায় রয়েছে।

সুতরাং যশোর-বেনাপোল রাস্তার মূল রাস্তার সব গাছ অক্ষত রেখে দুপাশ দিয়ে আরও দুটি দুই লেনের রাস্তা নির্মাণ সম্ভব। পেট্রাপোল বা হরিদাসপুর থেকে ভারতীয় অংশে এভাবেই মাঝখানে গাছ রেখে তারা চার লেনের রাস্তা বানিয়েছে। এর একটি ব্যবহার করা হবে ভারী যান চলাচলের জন্য, অন্যটি ছোট ও শ্লথগতির যান চলাচলের জন্য। শ্লথগতির যান চলাচলের লেনটি নির্মাণ করতে হবে অপেক্ষাকৃত নিচু করে যাতে এসব যান মূল সড়ক বা হাইওয়েতে উঠতে না পারে। এমন রাস্তা পাবনা, সিরাজগঞ্জে নির্মাণ করে ভালো ফল পাওয়া গেছে। এসব কথা আমাদের জনপ্রতিনিধি, প্রকৌশলী, জেলা প্রশাসক বা সংশ্লিষ্টজনদের অজানা নয়।

আমরা আশা করব, জনরোষ সৃষ্টি হওয়ার আগেই সংশ্লিষ্টদের বোধোদয় হবে এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণ করে এখানে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। আর তেমন পরিকল্পনা প্রণয়নে যারা ব্যর্থ, তাদের উচিত নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়া।

আমিরুল আলম খান: লেখক। সাবেক চেয়ারম্যান, যশোর শিক্ষা বোর্ড
[email protected]