ট্রাম্পের আদেশের বলি নিরীহ মানুষ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাহী আদেশ দিতে ভালোবাসেন। মেয়াদের প্রথম বছর তিনি বিভিন্ন বিষয়ে ডজনখানেক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন। এর মধ্যে যেমন জাতীয় নিরাপত্তা আছে, তেমনি আছে বাণিজ্য। এই নির্বাহী আদেশগুলোর মধ্যে কিছু আদেশ যেমন মুসলমানদের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, মেক্সিকোর সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ প্রভৃতি গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। এসব নিয়ে সারা পৃথিবীতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। কিন্তু ট্রাম্পের আরও কিছু সিদ্ধান্ত সোমালিয়ার মতো দূরবর্তী দেশে ধ্বংস ও মৃত্যুর কারণ হয়েছে, যেটা একরকম মানুষের চোখের আড়ালে রয়ে গেছে।

ক্ষমতায় আসার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ট্রাম্প এক নির্দেশে সোমালিয়ার কিছু অংশকে ‘ঝঞ্ঝামুখর বৈরী অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার ফলে আগে মার্কিন বাহিনী সোমালিয়ার মতো দেশে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালানোর সময় বেসামরিক মানুষের জীবন রক্ষায় যেসব নিয়ম মেনে চলত, সে ক্ষেত্রে অনেক শিথিলতা এল। পেন্টাগনের দাবি, এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে তাঁর লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণের কর্তৃত্ব বাড়ল। আফ্রিকান ইউনিয়ন ও সোমালি বাহিনীর সহায়তায় দেশটির আল-শাবাব বাহিনীকে পরাজিত করার ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হবে। কিন্তু কার্যত এই আদেশে মার্কিন সেনাদের সোমালিয়ার ভেতরে ইচ্ছামতো মানুষ মারার দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এটা অবৈধ, অনৈতিক ও প্রতিক্রিয়ামূলক।

জর্জ বুশের ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ সময় যুক্তরাষ্ট্র সোমালিয়ায় বোমাবর্ষণ শুরু করে। কিন্তু বেসামরিক মানুষ তখন অত বেশি মারা পড়ত না। ট্রাম্পের এই নির্দেশে আগের আইন শিথিল হওয়ায় এ ধরনের হামলার সংখ্যা যেমন বেড়ে গেছে, তেমনি বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর হারও বেড়েছে। ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের তথ্যানুসারে, ২০০১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সোমালিয়ায় ৩৬টি মার্কিন ড্রোন হামলা হয়েছে। আর শুধু ২০১৭ সালেই সেখানে ৩৪টি বিমান ও ড্রোন হামলা হয়েছে। এতে দুই শতাধিক মানুষ মারা গেছে।

কাগজ–কলমে অধিকাংশ মার্কিন হামলার লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কিত আল-শাবাব বাহিনী। এই গোষ্ঠীর লক্ষ্য হচ্ছে, মোগাদিসুর সরকারের পতন ঘটিয়ে তার জায়গায় নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ কয়েক দশক ধরে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো এদের সঙ্গে কেবল লোক দেখানো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

এই প্রক্রিয়ায় মনে হচ্ছে, ওয়াশিংটন কেবল গোপন সমঝোতার ওপর নির্ভর করছে। আর যুক্তরাষ্ট্র যেসব বিমান ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে, তার নির্দেশ যে কারা দিচ্ছে, সেটা বলা মুশকিল। সোমালিয়া একসময় ‘ব্যর্থ দেশ’ ছিল, কিন্তু এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। দেশটি এখন আর অনাকাঙ্ক্ষিত বিদেশিদের খেলার মাঠ নয়। এখন মোগাদিসুতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রশাসন আছে, যার বিচার, আইন ও নির্বাহী বিভাগ ক্রিয়াশীল। ফলে আল-শাবাবের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তার নির্দেশনা দেবে মোগাদিসুর প্রশাসন, ডোনাল্ড ট্রাম্প নন।

সোমালিয়ার সংবিধানে পরিষ্কার বলা আছে, দেশটির সংবিধান অলঙ্ঘনীয়। দেশটির আইন ও নির্বাহী বিভাগ তার নিরাপত্তার জন্য দায়ী। ফলে তারাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সামরিক খাতে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাদের অনুমোদন ছাড়া অভিযান চালানো হলে তা দেশটির সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হবে, সে কারণে তা অবৈধ।

যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থের অজুহাতে সোমালিয়ার আল-শাবাব বাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। কেউ এটা অস্বীকার করছে না যে এসব হামলায় আল-শাবাবের সদস্যরা মারা যাচ্ছে না, কিন্তু এতে বেসামরিক মানুষই বেশি মারা যাচ্ছে। আমরা এটা জানতে পারছি কারণ, আল-শাবাব সাধারণত ঊর্ধ্বতন কমান্ডার ও যোদ্ধাদের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে। সোমালিয়ায় আল-শাবাবের ঊর্ধ্বতন কমান্ডার শেখ আল জাবাল গত বছরের আগস্ট মাসে মার্কিন ড্রোন হামলায় মারা গেলে তারা সামাজিক মাধ্যমে বিবৃতি দেয়, ‘ভীরু মার্কিন শত্রুবিমানগুলো তাঁর ওপর হামলার চেষ্টা করে। প্রথম হামলায় তিনি বেঁচে গেলেও পরের হামলায় শহীদ হন।’ আল-শাবাব জানে, কমান্ডার ও যোদ্ধাদের মৃত্যুর খবর লুকিয়ে লাভ নেই, অনায়াসে তা বেরিয়ে যাবে, তাই তারা সেই চেষ্টা করে না।

যুক্তরাষ্ট্র যখন দাবি করে, তারা সোমালিয়ায় ডজন ডজন ‘সন্ত্রাসী’কে হত্যা করেছে, তখন আমরা বুঝতে পারি, কোন দাবির সত্যতা কতটা। আর বেসামরিক মানুষ মারা যাওয়ার ব্যাপারটা গণমাধ্যমে গুরুত্ব না পাওয়ার কারণ হলো, হামলাগুলো সাধারণ আল-শাবাব নিয়ন্ত্রিত এলাকাতেই হয়। সে কারণে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের পক্ষে তা খতিয়ে দেখা কঠিন। স্থানীয় গণমাধ্যম কখনো কখনো ভুক্তভোগীদের নাম ও ছবি প্রকাশ করে। কিন্তু সেটা নির্ভর করে ওই ভুক্তভোগীর গোত্রের ওপর। নিহত ব্যক্তির গোষ্ঠী যদি ক্ষমতাহীন হয়, তাহলে সরকার অনায়াসে তাদের ‘সন্ত্রাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল’ আখ্যা দেয়।

২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র সোমালিয়ার দক্ষিণের জিজিব শহরে তিনটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়। যথারীতি যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর আফ্রিকা কমান্ড ‘সন্ত্রাসীদের হত্যা’ করা হয়েছে বলে বিবৃতি দেয়। তবে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সাতজন ছিল একই পরিবারের, বেসামরিক মানুষ। সোমালিয়ার গণমাধ্যমে তাদের মরদেহ ও ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষের ছবি প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাহীন গোষ্ঠীর মানুষ হওয়ায় তাদের আত্মীয়স্বজন যে বিচারের আরজি জানিয়েছিল, তা ওই সব মানুষের কবর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায়।

এরপর আরেকটি ঘটনায় ভুক্তভোগীদের আত্মীয়স্বজন এক অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নেয়। তারা স্বজনদের মৃতদেহ রাজধানীতে এনে প্রদর্শন করে। চাপে পড়ে সরকারি কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গে দেখা করে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হন।

মার্কিন হামলায় যারা প্রাণ হারাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই কৃষক ও ভবঘুরে। মার্কিন জনগণের সঙ্গে তাদের শত্রুতা নেই। মার্কিন বোমা হামলায় তাদের অনেকেই ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে। সম্প্রতি আমরা মোগাদিসুর জনাকীর্ণ শিবিরগুলোতে ‘ড্রোন শরণার্থীদের’ দলে দলে আসতে দেখেছি। বিশেষ করে শিশুরা সব সময় আকাশ থেকে বোমা পড়ার ভয়ে সন্ত্রস্ত।

ব্যাপারটা হলো, ট্রাম্প যা করছেন, তাতে সোমালিয়ায় নতুন প্রজন্মের আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী প্রজন্ম তৈরি হবে। সে জন্য তাঁকে আল-শাবাবের সঙ্গে যেমন লড়াই করতে হবে, তেমনি নির্দোষ সোমালিদের সন্ত্রস্ত করা বন্ধ করতে হবে। সফলতা অর্জন করতে গেলে তাঁকে আন্তর্জাতিক ও সোমালি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। অনৈতিক কাজ বন্ধ করে সোমালিয়ায় তিনি যে কৌশল অবলম্বন করেছেন, তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, আল-জাজিরাথেকে নেওয়া।

জামাল ওসমান: আফ্রিকার সাংবাদিক।