রংপুর শহর কি জনগণের হবে?

রংপুর সিটি করপোরেশনের পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হলো। কিন্তু সড়ক সৌন্দর্যের নামে জনগণের শ্বাস নেওয়ার জায়গা ইতিমধ্যে গেছে, যদিও কারও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে এটা ছিল না। উল্টো সাবেক মেয়র শ্যামা সুন্দরী খালটিকে দূষণমুক্ত করার বদলে তার ওপর দিয়ে উড়ালসড়ক নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন। বলা হয়, বাড়ির বাইরে অধিক সময় কাটানোর সুযোগ একটি আদর্শ শহরের বৈশিষ্ট্য। একটি শহরে বাড়ি ও গণএলাকার (যেমন রাস্তা ও মাঠ) মাঝামাঝি কিছু একটা থাকতে হয়, সেটা হলো, পাড়া বা মহল্লাভিত্তিক মাঠ, পুকুর ইত্যাদি। এগুলো হচ্ছে পাড়ার এজমালি সম্পত্তি, এগুলোকে কেন্দ্রে রেখেই পাড়া বা মহল্লা গড়ে ওঠে। বিকেল ও বিশেষ উৎসবে এই জায়গাগুলোকে ঘিরেই খেলাধুলা, হাঁটা, বসা ও সামাজিক কাজকর্ম চলে।

একটি শহর কতটা সভ্য, সংস্কৃতিমান, আধুনিক ও জনগণের, তা বোঝা যায় তার গণএলাকার সংখ্যার ওপর। পাড়ার মতো শহরের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। তবে পাড়ার মাঠটি পাড়ার বাসিন্দাদের উপযোগী, তেমনি শহরেরটিও হতে হয় শহরের জনসংখ্যা ও তার বৈচিত্র্যের ওপর। ইয়ান গেল নামের একজন ডেনিশ স্থাপত্যশিল্পীর একটি ধ্রুপদি গ্রন্থের নাম লাইফ বিটুইন বিল্ডিংস। সেখানে তিনি জীবন ও স্থাপত্যের মধ্যে সংযোগের প্রয়োজন ব্যাখ্যা করেছেন। দেখিয়েছেন, কীভাবে সহাবস্থানের মাধ্যমে যোগাযোগের সূচনা হয়। কীভাবে স্থানভেদে যোগাযোগের সম্ভাবনা, পূর্বপরিচয় রক্ষার সুযোগ, সামাজিক পরিবেশগত তথ্য, অনুপ্রেরণার উৎস, উৎসাহব্যঞ্জক অভিজ্ঞতা, কার্যকলাপের আকর্ষণ (যেমন খেলাধুলা ও বিভিন্ন কার্যকলাপের অভ্যাস), কার্যকলাপ এবং রক্ষার অধিকার, পথচারীদের চলাচলে আকর্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে শহরবাসীর সম্পর্ক নির্মিত হয়। ইয়ান গেল অবকাঠামোর প্রভাবে যোগাযোগের সম্ভাবনা বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়ার পাঁচটি কারণ দেখিয়েছেন। দেখা ও শোনার বেলায়—১. দেয়াল, ২. অধিক দূরত্ব, ৩. উচ্চ গতি, ৪. বহুতল ও ৫. বিপরীতমুখিতা—এগুলো যোগাযোগের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

আগে লালবাগের মোড়ে বটগাছের নিচে নাটক ও সমাবেশ হতো। সিটি করপোরেশন বটগাছ দুটো কেটে সেই জায়গায় লাল রঙের একটি বাঘের ভাস্কর্য বসিয়ে দিয়েছে। এখন কড়া রোদে শুধু কংক্রিটের লাল বাঘটিই দাঁড়িয়ে আছে, মানুষ ও গাছ উধাও! গণএলাকার বিশেষত্বই হচ্ছে, যেখানে লোকজন সহজেই সমবেত হতে পারে এবং সেই জায়গাগুলোতে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ও বিনোদনমূলক ঘটনা সংঘটিত হয়। যেখানে মানুষে মানুষে যোগাযোগের, আড্ডার কিংবা খেলাধুলার সুবিধা বিদ্যমান। অথচ বিখ্যাত পায়রা চত্বর গ্রিল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে, নিষিদ্ধ হয়েছে আড্ডা ও যেকোনো সমাবেশ।

একটি শহরের পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করে সেখানকার গণএলাকার কার্যক্রম কতটা ও কীভাবে সংগঠিত হবে। হাঁটা, দাঁড়ানো, বসা, দেখা, শোনা এবং কথা বলার জন্য যদি জায়গাগুলো আকর্ষণীয় হয়, তাহলে খেলাধুলা, গল্প করা ও প্রতিবেশীদের মেশার সুযোগ বৃদ্ধি পায়। রংপুর নগর পরিকল্পকদের ধন্যবাদ, রোড ডিভাইডারগুলো বৃদ্ধ, পঙ্গু ও শিশুদের চলাচল না করতে পারার মতো এত উঁচু করেননি, নির্মাণ করেননি অমানবিক পদচারী–সেতু এবং শহরের ভেতরে চলতে দেননি বাস-ট্রাকের মতো যানবাহনগুলো। যদিও ঢাকা শহরের উন্নয়নধারণায় আক্রান্ত হয়ে কেউ কেউ এই দাবি করছেন। স্কুল-কলেজে যাওয়া, হাট-বাজার করা, অফিস-আদালত-কারখানায় আসা-যাওয়া করা প্রাণী মানুষের ছকবদ্ধ জীবনের অংশ। কর্মক্ষেত্র যেমনই হোক, প্রাণী মানুষকে এগুলো করতেই হবে। কিন্তু আড্ডা দেওয়া, বক্তৃতা শোনা, রাজনীতি করা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করা হচ্ছে মানুষের মানুষ হয়ে ওঠা। এগুলো বাইরেই সংঘটিত হয়। তাই মানুষ যত বাইরে থাকে, তত বেশি অন্যদের সঙ্গে দেখা হয়, সম্পর্ক মজবুত হয়।

একটি এলাকায় রাস্তার দুর্ঘটনা ও অন্যান্য অপরাধ থেকে মানুষ যতটা নিরাপদে থাকবে, এলাকাটি ততটাই সুবিধাজনক। যেখানে মানুষের সমাগম বেশি, সেখানে নিরাপত্তা তত বেশি। জাহাজ কোম্পানি মোড়ে সারা রাত লোকজন চলাচল করে, কিন্তু কেউ কখনো অপরাধমূলক ঘটনার কথা বলতে পারবেন না, সেটা ছিনতাই হোক বা নারী হেনস্তা। এখানে দিনের বেলায় কড়া রোদ ও চলাচলের কারণে ব্যস্ততা থাকে আর সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয়। রাত সাড়ে নয়টা থেকে শহরের প্রধান রাস্তাগুলোতে সবজি বিক্রেতারা ডালা নিয়ে বসে পড়েন। বিক্রি বাজারের ভেতরের চেয়ে ভালো হয়। কাছারি বাজারের রাস্তায় যখন বড় বড় গাছ ছিল, তখন সেখানে আড্ডাও ছিল। অন্যদিকে সরকারি কলেজ রোডে প্রচুর ছায়া থাকলেও আড্ডাগুলো ভেঙে গেছে, কারণ চায়ের ঝুপড়িগুলো উচ্ছেদ করা হয়েছে। আর টাউন হল চত্বরটি শহরের প্রাণ কেন? কারণ সীমানাপ্রাচীরে লোহার গ্রিল থাকায় রাস্তা থেকে চত্বরটির প্রতিটা কোনা দেখা যায়, প্রচুর ঘাস ও বসার জায়গা আছে, রোদ থেকে বাঁচার জন্য ছায়া ও বৃষ্টি উপভোগ করার ছাদ আছে এবং আছে বেশ কয়েকটি চায়ের দোকান, যেখানে তিন কাপ চা ছয়জনে ভাগ করে খাওয়া যায়। অবশ্য সবকিছুর মতো টাউন হল মাঠটিও বাণিজ্যিক মেলার দখলে যাচ্ছে।

মানুষ যখন সামাজিক হওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক হয়ে উঠল, শহর গড়ে ওঠার ইতিহাসের শুরুও তখন থেকেই। ইউরোপ-আমেরিকার শহরগুলোতে সমাজ ও রাষ্ট্র সহাবস্থান করে থাকলেও আমাদের শহরগুলো উদরপূর্তির জন্য। আমাদের যাবতীয় সামাজিকতা গ্রামের তরে বরাদ্দ। বলা হয়, ইতিহাসে শহরগুলো গড়েই উঠেছে গণজায়গাগুলোকে কেন্দ্র করে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যও তা-ই, জনগণকে বাড়ির বাইরে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজে বেশি বেশি করে যুক্ত রাখতে ভূমিকা নেওয়া। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সমাজের যত বেশি সংখ্যক মানুষ বুঝতে পারে যে সমাজে তারাও গুরুত্বপূর্ণ, তারাও অপরিহার্য, ততই ভালো।

কিন্তু বাংলাদেশে শাহবাগের ছবিরহাট থেকে শুরু করে রংপুরের পায়রা চত্বর গ্রিল দিয়ে ঘেরাও হয়ে যায়, নিষিদ্ধ হয় জমায়েত। রাষ্ট্রকর্তারা জনগণকে হুকুম জারি করেন সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফেরার। শহরগুলোও তাই গড়ে উঠছে জনবিচ্ছিন্ন হয়েই। নতুন নগরপিতা এই বিষয়গুলো আমলে নেবেন বলে আশা করি। তবে তার আগে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।

নাহিদ হাসান: প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রাম।