চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ঝড় আসছে

মারুফ মতিন ভাই আমাকে একটা বই দিয়েছেন, ঢাকা শহরের অনেককেই তিনি বইটা উপহার দেন। বইটার নাম দ্য ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। লেখক বিশ্ব অর্থনীতি ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ক্লস শোয়াব। মারুফ মতিন ভাই মসলিন ক্যাপিটাল নামের একটা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা।

বইটা আমাকে বেশ ভাবাচ্ছে। লেখক যা বলছেন, যা বলেননি, আমি যা বুঝছি, যা ভাবছি, তা থেকে এই লেখা।

আমরা সবাই জানি, প্রযুক্তির সঙ্গে পৃথিবীর সমাজব্যবস্থার সম্পর্ক আছে। উৎপাদনের পদ্ধতি বদলে গেলে উৎপাদনের সম্পর্কও বদলে যায়। পৃথিবীতে একটা সময় আদিম সাম্যবাদী সমাজ ছিল। লাঙল আবিষ্কৃত হলো, কৃষির প্রচলন ঘটল, সেখান থেকে এল সামন্ততন্ত্র। জেমস ওয়াটের স্টিম ইঞ্জিন পুরো পৃথিবীকেই দিল বদলে, এল পুঁজিবাদ। আমরা জানলাম, মুনাফা হলো শ্রমের শোষণ।

লেখক অর্থনীতিবিদ শোয়াব বলছেন, সেটা ছিল প্রথম শিল্পবিপ্লব। তারপর বিদ্যুৎ আবিষ্কৃত হলো, মোটর এল, রেডিও, টেলিভিশন-সেটা ছিল দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব। তারপর এল ডিজিটাল যুগ, ইন্টারনেট। এটা তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। এখন আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মধ্যে আছি। গত কয়েক বছরে আমরা কতগুলো নতুন বাস্তবতার মধ্যে আছি, যেমন ধরা যাক ফেসবুক, টুইটার, উবার, আলিবাবা, এআইআরবিএনবি।

কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ অবশ্য বলছেন, এটা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নয়, তৃতীয় বিপ্লবেরই বর্ধিত সংস্করণমাত্র। আর এটা হলো ইন্টারনেট অব থিংসের যুগ। ২০২৫ সালের মধ্যে পৃথিবীতে কী কী নতুন বাস্তবতা দেখা দেবে, তার একটা তালিকাও শোয়াব দিয়েছেন তাঁর বইয়ে। তা থেকে আমি তুলে ধরছি:

১. ২০২৫ সালের মধ্যে শরীরে মোবাইল ফোন বসানো হবে। এখন যেমন পেসমেকার বসানো হয়, অনেকটা সে রকম। এর ফলে আমাদের স্বাস্থ্য থাকবে ভালো, আমরা স্বয়ম্ভূ হয়ে উঠব, আমাদের শিশুরা হারিয়ে যাবে না, আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারব নির্ভুল। ক্ষতি হবে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার, পলায়নবাদিতা আর আসক্তি বাড়তে পারে, তথ্যনিরাপত্তাও বিঘ্নিত হতে পারে।

২. ৮০ শতাংশ মানুষের একাধিক ডিজিটাল ঠিকানা থাকবে। ই-মেইল ঠিকানা বা ফোন নম্বরই শুধু নয়, ফেসবুকের মতো আরও নতুন পরিসর থাকবে মানুষের। তাতে যেমন মানুষে মানুষে সংযোগ কিংবা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাড়বে, তেমনি বাড়বে এ-সংক্রান্ত অপরাধ।

৩. চশমার সঙ্গে ইন্টারনেট যুক্ত থাকবে।

৪. ইন্টারনেট থাকবে পোশাকের সঙ্গে যুক্ত।

৫. ৯০ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকবে।

৬. ৯০ শতাংশ মানুষের পকেটে থাকবে সুপার কম্পিউটার।

৭. সবার জন্য থাকবে বিশাল (তথ্য) ভান্ডার।

৮. ইন্টারনেট অব থিংস। ইন্টারনেট ফর থিংস। সব জিনিসই ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। এমনকি এই গবেষণাও হচ্ছে যে গবাদিপশু মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।

৯. ঘর থাকবে সর্বদা সংযুক্ত। এখনই মার্সিডিজ বেনজ গাড়ি বলে দিতে পারে, ঘরে এখন হিটার চালু করো।

১০. স্মার্ট নগর। ৫০ হাজার লোকের শহরে কোনো ট্রাফিক সিগন্যাল লাগবে না। সবকিছু ইন্টারনেট আর সেন্সরের সঙ্গে যুক্ত থাকবে।

১১. সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বিগ ডেটার মাধ্যমে।

১২. চালকবিহীন গাড়ি।

১৩. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। করপোরেট অফিসের পরিচালকের রুমে একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমান মেশিন বসে পড়বে।

১৪. ৩০ শতাংশ হিসাব নিরীক্ষা হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে।

১৫. রোবোটিকস। আমেরিকায় প্রথম রোবট ফার্মাসিস্ট কাজ করবে।

১৬. বিটকয়েন ও ব্লকচেইন। বিকল্প টাকা।

১৭. গাড়ি ভাগ করে নেওয়ার মতো আরও অনেক জিনিসই মানুষ ভাগাভাগি করে ব্যবহার করবে।

১৮. সরকারগুলোও ব্লক চেইন দিয়ে কর বা শুল্ক আদায় করবে।

১৯. ত্রিমাত্রিক প্রিন্টার খুব সস্তা হবে।

২০. ত্রিমাত্রিক প্রিন্টারের মাধ্যমে মানুষের চিকিৎসা হবে। প্রথম থ্রি-ডি প্রিন্টার থেকে নেওয়া যকৃৎ মানুষের শরীরে বসানো হবে।

২১. ৫ শতাংশ ভোগ্যপণ্য থ্রি-ডি প্রিন্টার থেকেই বানিয়ে নেওয়া যাবে।

২২. প্রথম মানবশিশু জন্ম নেবে, যার জিনোম কৃত্রিমভাবে উন্নততর করা হয়েছে।

২৩. মানুষের মস্তিষ্কে কৃত্রিম স্মৃতিভান্ডার বসানো হবে।

এগুলোর কোনোটা হবে, কোনোটা হবে না। কিন্তু সহজেই বোঝা যাচ্ছে, আগামী সাত বছরে তা-ই হতে যাচ্ছে, যা পৃথিবীর হাজার হাজার বছরে ঘটেনি। সময় খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে।

চালকবিহীন গাড়ি এর মধ্যেই এসে গেছে। স্মার্ট বাড়ি কাজ করতে শুরু করেছে। আপনার হাতের স্মার্টফোন বলে দেয়, আজকে বৃষ্টি হবে, ছাতা নিয়ে বের হন। আমেরিকায় বন্ধুর গাড়িতে বসে আছি, গাড়ি দুবার পাশের দাগে উঠে গিয়েছিল, গাড়ি বলতে লাগল, তোমার ঘুম পাচ্ছে, তুমি সামনে সাত মাইল দূরের কফিশপে গিয়ে কফি খাও।

একটা ওলটপালট যে শুরু হয়ে গেছে, তা স্পষ্ট। আর উৎপাদন-পদ্ধতি বদলে গেলে উৎপাদন-সম্পর্কও বদলে যায়। প্রথম শিল্পবিপ্লবের পরে এ কথা বলা সহজ ছিল যে শ্রমশোষণই মুনাফা। এখন বিল গেটস কিংবা জাকারবার্গ যে এত ধনবান হলেন, সেটা কোন শ্রমিকের শ্রম শোষণ করে? তাঁরা বড়লোক হয়েছেন বুদ্ধি দিয়ে।

এই আলোচনা আমরা কেন করছি? এ থেকে আমরা কী নেব?

এখনই পোশাকশিল্প স্বয়ংক্রিয় হতে শুরু করেছে। কোয়ালিটি কন্ট্রোল বা মান নিয়ন্ত্রণের কাজ করছে যন্ত্র। এখনই যন্ত্র কাপড় কাটতে শুরু করেছে। কিছুদিনের মধ্যেই যন্ত্র কাপড় সেলাইও করতে শুরু করবে। কাপড় ডিজাইন থেকে শুরু করে কাটা, সেলাই, প্যাকেজিং-সবই করবে যন্ত্র। এসব যন্ত্রের দাম দ্রুতই কমবে।

তখন ধরা যাক চীন! এ ধরনের যন্ত্র আবিষ্কার ও প্রস্তুত করে ব্যবহার করতে শুরু করলে তৈরি পোশাকের সব অর্ডার তারাই পেয়ে যাবে, কারণ তা হবে দামে সস্তা। আর মানব শ্রমিকের দরকার না পড়লে উন্নত দেশগুলো, ইউরোপ-আমেরিকাও তখন নিজেদের পোশাক নিজেরাই বানাতে থাকবে। আর আমাদের দেশে তো এই শিল্পের কাঁচামালও আমদানি করতে হয়। কাঁচামাল উৎপাদনকারী দেশগুলো নিজেরাই পোশাক তৈরি করতে শুরু করলে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প নিঃশেষ হয়ে যাবে। কোনো একটা শিল্প যে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়তে পারে, তা তো আমাদের চোখের সামনেই ঘটতে দেখলাম। চোখের সামনে ভিসিআর এল, ক্যাসেট এল, টেপ এল, চলেও গেল। চোখের সামনে ফুজি কিংবা কোডাক ফিল্মের বাজার পড়ে গেল।

ওপরে যে ২৩টি পরিবর্তনের কথা শোয়াবের বই থেকে নিয়ে লিখলাম, তার অভিঘাত কী হবে? বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই বলা হচ্ছে, মানুষ চাকরি হারাবে, কাজ হারাবে।

আমাদের দেশে বসে আমরা হয়তো পরিস্থিতিটা বুঝছিও না। এ দেশে এখন আর গরু গাড়ি চালায় কি না, জানি না। কিন্তু মানুষ তো রিকশা টানে। সেই দেশে ড্রাইভার ছাড়া গাড়ি চলবে, এটা কল্পনাতীত। কিন্তু পৃথিবীতে যদি পোশাকশিল্পে আর এত শ্রমিক না লাগে, তাহলে সেই কাজ বাংলাদেশে আসবে কেন? আর আমরা যে অভিবাসী শ্রমিকদের প্রবাসী আয়ের ওপর এত নির্ভর করি, তারা যদি কাজ না পায়, তাহলে আমাদের অর্থনীতির কী হবে?

এ দুটি খাতই তো আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বড় উৎস।

আমরা কী করব? দুবাইয়ের বিমানবন্দরে আমরা এখন টয়লেট পরিষ্কার করি। তখন ওই কাজও তো যন্ত্র করবে। অটোমেশন সর্বত্র হবে, নির্মাণ খাতেও হবে। অদক্ষ মানুষ কাজ হারাবে।

কাজেই ২০২৫ সালের দিকে বাংলাদেশ একটা বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সামনে পড়তে যাচ্ছে, যদি না আমরা এখনই এ বিষয়টা মনে রেখে অগ্রসর হই। আগাম প্রস্তুতি নিই। আগাম পরিকল্পনা করি।

এই নিয়ে বড় পরিকল্পকেরা ভাববেন, করণীয় ঠিক করবেন, সরকার এবং শিল্পোদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা পদক্ষেপ নেবেন। আমার ধারণা হলো, আমাদের প্রধান কর্তব্য দুটি।

১. আমাদের বিপুলসংখ্যক মানুষকে দক্ষ, শিক্ষিত, স্মার্ট করে তোলা। আমাদের যে প্রায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী আছে, তাদের সবচেয়ে ভালো শিক্ষা, নতুন যুগের উপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা।

এইখানটাতেই সবচেয়ে বেশি হতাশ হওয়ার কারণ আছে। আমাদের শিক্ষার মান ধসে পড়েছে। স্কুল-কলেজে প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক কারণে স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অযোগ্যদের নিয়োগ, ফাঁকি, কোচিং ইত্যাদি আমাদের গণশিক্ষাকে গণদূষণের শিকারে পরিণত করেছে। এবং নতুন যুগের নতুন চাহিদার বিষয়ে আমরা সচেতন নই। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো, সিলেবাস, শিক্ষকেরা, পরিকল্পকেরা তা নিয়ে ভাবিত নন। চিন্তিত নন। আমরা এখনো মধ্যপ্রাচ্যের দেশে ঝাড়ুদার পাঠানোর শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছি। এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।

২. দক্ষ জনশক্তি আশীর্বাদ। কিন্তু অদক্ষ জনসংখ্যা অভিশাপ। আমাদের এখন বোধ হয় জনসংখ্যা নিয়ে নতুন করে ভাবার এবং নব উদ্যমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের আন্দোলন শুরু করার দরকার আছে।

আমরা শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ দিতে পারি, সরকারকে ধন্যবাদ দিতে পারি, যে তাঁরা ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা ভেবেছেন। এখন ডিজিটাল বাংলাদেশকে তার পরের ধাপে নিয়ে যেতে হবে। ডিজিটাল পৃথিবী তার পরের ধাপে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে উত্তীর্ণ হচ্ছে। তার নেতিবাচক টর্নেডো এসে লাগবে আমাদের অর্থনীতির গায়ে। আমাদের তার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

শিক্ষা এবং একমাত্র মানসম্মত যুগোপযোগী শিক্ষাই এই সমস্যার একমাত্র সমাধান।

এবার একটু আশার কথা বলি। যেকোনো সংকট আবার নতুন সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দেয়। বাংলাদেশের মানুষের শেখার আর গ্রহণ করার ক্ষমতা অসাধারণ। অক্ষরজ্ঞান নেই, অথচ এসএমএস পড়তে পারে অনেকেই। অক্ষর চেনে না, কিন্তু ফোন করতে পারে তো প্রায় সবাই। এই বিনষ্ট শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর থেকেও বড় উদ্যোক্তা, বড় দূরদর্শী মানুষ বেরিয়ে আসতে তো দেখছি। বাংলা বা ইংরেজি বানান ঠিকমতো করতে পারেন না, কিন্তু বড় বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করছেন এমন মানুষও প্রচুর। কাজেই হতাশ হচ্ছি না। শুধু বলব, আগে আমাদের ছিল কেরানি তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা, এখন এসেছে পোশাককর্মী আর ঝাড়ুদার তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা। একটু সামনের দিকে তাকান। একটু নতুন করে ভাবুন।

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।