বিশ্ব ইজতেমা ও আখেরি মোনাজাত

ইজতেমা আরবি শব্দ, অর্থ হলো সম্মেলন বা সম্মিলন। এর বানানানুগ উচ্চারণ হলো ‘ইজতিমা’; বাংলায় ইজতেমা বা এজতেমা লেখা হয়। ইজতেমা শব্দটিকে নানান বানানে লিখতে দেখা যায় এবং বিভিন্ন উচ্চারণে বলতে শোনা যায়। যেমন এস্তেমা, ইস্তেমা, ইস্তিমা ইত্যাদি। এগুলোর মূল হলো ‘সামা’, যার মানে শোনা বা শ্রবণ করা, সংগীত করা বা গীতি শোনা। সুতরাং, এস্তেমা বা ইস্তেমা অর্থ হবে শ্রবণেচ্ছা। ‘ইজতেমা’র সঙ্গে ‘ইস্তিমা’র শব্দগত ও উচ্চারণগত সম্পর্ক বা ভাবগত মিল দেখা গেলেও এর ভাব ও উদ্দেশ্য এবং অন্তর্নিহিত সম্পর্ক গৌণ।

‘বিশ্ব ইজতেমা’ হলো বিশ্বসভা, বিশ্বসম্মেলন, আন্তর্জাতিক সমাবেশ তথা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স। এর আরবি হলো আল ইজতিমা আল আলামি, আল ইজতিমা আদদুওয়ালি, আল ইজতিমাউ বাইনাল মিলালি। ‘বিশ্ব ইজতেমা’ নামের দুটি শব্দের প্রথমটি বাংলা, দ্বিতীয়টি আরবি শব্দ; যা উর্দু, ফারসি, হিন্দিতেও ব্যবহৃত হয়। সব মিলে ‘বিশ্ব ইজতেমা’ পরিভাষাটি বর্তমানে বাংলা রূপ লাভ করেছে। পরিভাষায় ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হলো দেওবন্দি ঘরানার অন্তর্গত মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) প্রবর্তিত ‘কালেমা, নামাজ, ইলম ও জিকির, ইকরামুল মুসলিমিন, তাছহিহে নিয়াত ও তাবলিগ’-এই ছয় মূলনীতির ভিত্তিতে পরিচালিত ‘তাহরিকুছ ছলাত’ বা ‘নামাজ আন্দোলন’ নামে প্রতিষ্ঠিত বর্তমানে ‘তাবলিগ জামাত’ নামে পরিচিত মসজিদকেন্দ্রিক দাওয়াতি কর্মধারার তিন দিনব্যাপী বার্ষিক কর্মশালা বা সমাবেশ, যা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অদূরে টঙ্গীর তুরাগতীরে প্রতিবছর সাধারণত জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বর্তমানে এতে বিশ্বের ১৩৫ টির অধিক দেশের মুসলমান অংশগ্রহণ করেন। এতে লাখ লাখ লোকের সমাগম হয়ে থাকে। এ উপলক্ষে এখানে বিশ্বের বৃহত্তম জুমার জামাত অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ব ইজতেমার আগে ১০ দিনের জোড় হয়ে থাকে। এ বছর ৫৩ তম বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

প্রথম দিকে এই বিশ্ব ইজতেমা শনি, রবি ও সোম-এই তিন দিন অনুষ্ঠিত হতো। সোমবার জোহরের আগে আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে এর সমাপ্তি ঘটত। কার্যত দেখা যেত, অধিকাংশ লোক শুক্রবার জুমার আগেই চলে আসেন, এতে তিন দিনের ইজতেমা চার দিনে গড়ায়। তাই পরবর্তী সময়ে সুবিধা বিবেচনায় শুক্র, শনি ও রবি করা হয়েছে। বিশ্ব ইজতেমায় ক্রমবর্ধমান লোকসংখ্যার কারণে ২০১১ সাল থেকে এই ইজতেমাকে দুই পর্বে ভাগ করা হয়। প্রতি পর্বে নির্ধারিত ৩২ জেলার লোক অংশগ্রহণ করে থাকতেন। এতেও সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান না হওয়ায় ২০১৬ সাল থেকে ৩২ জেলাকে পুনরায় দুভাগে বিভক্ত করে এক বছর পর পর ১৬ জেলার লোক অংশগ্রহণ করার পদ্ধতি চালু করা হয়। এতে প্রতিবছর দুই পর্বে মোট ৩২ জেলা অংশগ্রহণ করে এবং পরবর্তী বছর অন্য ৩২ জেলা অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। এবং বছরব্যাপী সুবিধামতো সময়ে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন জেলায় বা কয়েকটি জেলা মিলে তিন দিনের ইজতেমা ও ১০ দিনের ‘জোড়’ অনুষ্ঠিত হয়।

১৯২০ সালে দিল্লির নিজামুদ্দিন নিবাসী দারুল উলুম দেওবন্দের পাস করা আলেম মাওলানা ইলিয়াস সাহেব ‘তাহরিকুছ ছলাৎ’ বা নামাজ আন্দোলন নামে ‘ইমান’ ও ‘আমাল’-এর এই দাওয়াতি কার্যক্রমের কর্মপদ্ধতি প্রবর্তন করেন। বিশ্ব তাবলিগের সদর দপ্তর এখনো সেখানে অবস্থিত। বাংলাদেশে তাবলিগের প্রধান কেন্দ্র হলো ঢাকার রমনার কাকরাইল জামে মসজিদ।

দাওয়াত ও তাবলিগ
দাওয়াত অর্থ ‘আহ্বান’, তাবলিগ অর্থ পৌঁছানো। শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুপম আদর্শের প্রতি মানুষকে ডাকাই হলো দাওয়াত। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তোমরা ডাকো তোমাদের রবের পথে, হেকমত (প্রজ্ঞা ও কৌশল) এবং সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে।’ (সুরা: ১৬ নাহল, আয়াত: ১২৫)। ইসলামের সহজ-সরল ও যৌক্তিক বিষয়গুলো মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার নাম হলো তাবলিগ। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘তোমরা আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত (বাণী) হলেও পৌঁছে দাও।’ (মুসলিম)। বিদায় হজের ভাষণে মহানবী (সা.)-এর সর্বশেষ বাক্য ছিল: ‘তোমরা যারা উপস্থিত রয়েছ, তারা অনুপস্থিতদের কাছে পৌঁছে দেবে।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)। দাওয়াত তাবলিগের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘আমর বিল মারুফ’ (সৎকাজের আদেশ) ও ‘নাহি আনিল মুনকার’ (মন্দ কাজে নিষেধ)।

এখান থেকে ছয় গুণে উদ্বুদ্ধ হয়ে বহু লোক আল্লাহর দেওয়া জান, আল্লাহর দেওয়া মাল, আল্লাহর দেওয়া সময় নিয়ে; আল্লাহর রাজি-খুশির উদ্দেশ্যে দ্বীনি দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনতের জন্য এক চিল্লা (চল্লিশ দিন), তিন চিল্লা, সাত চিল্লা, সাল (বছর) ও দশ চিল্লা এবং জীবন চিল্লার জন্য সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েন। দলনিরপেক্ষ ও রাজনীতিমুক্ত হওয়ায় তাবলিগ জামাত বিশ্বের সব দেশে দাওয়াতি কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে।

আখেরি মোনাজাত
আখের অর্থ শেষ, আখেরি অর্থ শেষের; মোনাজাত মানে দোয়া বা প্রার্থনা। আখেরি মোনাজাত অর্থ হলো সমাপনী দোয়া বা যে দোয়ার মাধ্যমে অধিবেশন সমাপ্ত করা হয়। ঢাকার তুরাগতীরে টঙ্গী ময়দানে তাবলিগ জামাতের তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমার শেষ দিনে বিদায়লগ্নে যে সুদীর্ঘ সম্মিলিত দোয়া বা মোনাজাত করা হয়, তা-ই আখেরি মোনাজাত নামে পরিচিত। আজকাল একাধিক দিবসব্যাপী অনুষ্ঠেয় মাহফিল বা একাধিক অধিবেশনে বিন্যস্ত অনুষ্ঠানমালার সর্বশেষ দোয়াকেও আখেরি মোনাজাত নামে অভিহিত করা হয়। যেকোনো মাহফিলের শেষের দোয়াকেও আখেরি মোনাজাত বলতে শোনা যায়।

হাদিস শরিফে রয়েছে: ‘দোয়া ইবাদতের মগজ বা মূল।’ (বুখারি ও মুসলিম)। তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ বিশেষ সময়ে এবং কোনো কাজের শুরুতে ও শেষে দোয়া করা সুন্নত। সম্মিলিতভাবে দোয়া করা মুস্তাহাব। কোনো মজলিশে কোনো একজনের দোয়া কবুল হলে তাঁর সৌজন্যে আল্লাহ তাআলা সবার দোয়া কবুল করবেন, আশা করা যায়। বড় মজমায় বা অধিক লোকের মাঝে এক বা একাধিক আল্লাহর মকবুল বা পেয়ারা বান্দা থাকার সম্ভাবনা প্রবল। এসব বিবেচনায় আখেরি মোনাজাত খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কাছে বা দূরে থেকে, যেকোনো অবস্থায়, যেকোনো অবস্থান থেকে, যেকোনো মাধ্যমে দোয়া বা মোনাজাতে শামিল হওয়া যায়।

নির্ধারিত ইবাদত, যথা ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য সর্বাধিক এবং এগুলো সর্বাগ্রে পালনীয়। অনির্ধারিত ইবাদত নফল ও মুস্তাহাবের স্থান এর পরে। ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত বাদ দিয়ে নফল বা মুস্তাহাব আমল করা জ্ঞানবানদের জন্য যুক্তিযুক্ত নয়।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
[email protected]